বিচার যখন হয়ে উঠল প্রহসন
when-the-trial

গণতন্ত্রকে সক্রিয় ও সচল হতে গেলে বিচারবিভাগের নিরপেক্ষতা অপরিহার্য – এই আপ্তবাক্যের অভ্রান্ততা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ কোনোকালে ছিল না, আজও নেই। তবে, আদালতের রায়ের মান্যতা আবশ্যক হলেও কিছু-কিছু রায়ই কিন্তু কাঠগড়ায় উঠছে। সুপ্রিম কোর্টের কাছ থেকে ন্যায়বিচার লাভ একেবারে দুর্লভ না হলেও কিছু ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আদালতের অবস্থান এবং বহু ক্ষেত্রেই হাইকোর্ট ও নিম্ন আদালতগুলোর রায় ন্যায্য প্রতিপন্ন হওয়ার চেয়ে স্বৈরাচারী শাসক স্বার্থের অভিমুখীই হচ্ছে। এখানে আমরা সাম্প্রতিক সময়ে আসা উত্তরপ্রদেশ ও গুজরাত আদালতের দুটি রায় নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করব যেগুলো ন্যায়বিচার প্রদানের বিপরীতে প্রহসন হয়েই দেখা দিয়েছে।

একটা রায় এ বছরের ৩১ মার্চ এল উত্তরপ্রদেশের মিরাটের এক আদালত থেকে গণহত্যা সংঘটিত হওয়ার ৩৩ বছর পর, এবং ঐ রায়ে বিচারক লখবিন্দার সিং সুদ ৩৯ জন অভিযুক্তকেই বেকসুর খালাস দিয়ে দেন। রায়টা ছিল উত্তরপ্রদেশের প্রাদেশিক পুলিশ বাহিনী (পিএসি) এবং দাঙ্গাবাজ হিন্দু জনতার হাতে নারী-শিশু-সহ ৭২ জন মুসলিম জনগণের নিহত হওয়া প্রসঙ্গে। তৎকালীন কংগ্রেসি প্রধানমন্ত্রী রাজিব গান্ধি ১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাবরি মসজিদের তালা খুলে দেওয়ায় দেশের বিভিন্ন অংশেই সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়, এবং সেই উত্তেজনা ধিকিধিকি চলতেই থাকে। ১৯৮৭র মে মাসে উত্তরপ্রদেশের মিরাটে দাঙ্গা পরিস্থিতি সংকটজনক হয়ে ওঠে, ১৭ মে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায় পরস্পরের সঙ্গে প্রাণঘাতী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। কংগ্রেসী মুখ্যমন্ত্রী বীরবাহাদুর সিং কারফিউ জারি করেন, এবং জেলায় শান্তি বজায় রাখার জন্য রাজ্য সরকার ১১ কোম্পানি পিএসি পাঠায়। পিএসি গিয়েই মুসলিম জনগণের ওপর আক্রমণ শুরু করে। যেদিন গণহত্যা সংঘটিত হয়, সেই ২৩ মে পিএসি-র সঙ্গে হিন্দু দাঙ্গাবাজ জনতা হাত মিলিয়ে মালিয়ানায় হত্যার তাণ্ডবে মেতে ওঠে। মালিয়ানায় ঢোকা এবং বেরোনোর পাঁচটা পথকেই বন্ধ করে দেওয়া হয়, পিএসি ও মারমুখী হিন্দু জনতা বন্দুক ও তরোয়াল-বর্ষার মতো অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে, এবং স্থানীয় জনগণের মতে ৭২ জন মুসলিম জনগণকে হত্যা করা হয়।  সরকার ঘটনার পরপরই এফআইআর করার কথা ভাবতে পারেনি, প্রধানমন্ত্রী রাজিব গান্ধি ৩০ মে মালিয়ানা পরিদর্শনের পরই কেবল এফআইআর করা হয়।

বিচারক তাঁর রায়ে বললেন, “সাক্ষীরা অভিযোগ করেছে, এক সাধারণ উদ্দেশ্যের চরিতার্থতায় অভিযুক্তরা বেআইনী সমাবেশ ঘটিয়েছিল। এই মামলায় সম্পত্তি লুট হওয়ার যে কথা বলা হয়েছে, অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তির কাছ থেকেই তা উদ্ধার করা যায়নি। ঘটনার সময় ব্যবহৃত কোনো অস্ত্রই অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কাছ থেকে উদ্ধার করা যায়নি। লিপিবদ্ধ নথিতে এমন কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ নেই যা স্পষ্ট করে জানায় যে কোন্ অভিযুক্তর নির্দিষ্ট অপরাধ সংঘটনে সুনির্দিষ্ট ভূমিকা ছিল এবং বাদী পক্ষকে আক্রমণের জন্য কোন অভিযুক্ত কোন অস্ত্র ব্যবহার করেছিল। সমস্ত অভিযুক্তর বিরুদ্ধেই অভিযোগগুলো একই ধাঁচে করা হয়েছে।”

এই রায়ের পর এখন মিরাটে, মালিয়ানার পাড়ায়-পাড়ায় ঘুরছে এই প্রশ্নগুলো – ৭২ জন মানুষ যদি নিহত হয়ে থাকে তবে কাদের হাতে তাদের হত্যা হয়েছিল? লুট হওয়া সম্পত্তি যদি উদ্ধার না হয়ে থাকে, যে অস্ত্র দিয়ে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল তা যদি খুঁজে না পাওয়া গিয়ে থাকে, দায়ের করা এফআইআর-এ অভিযুক্তদের অপরাধ যদি সুনির্দিষ্টভাবে উল্লিখিত না হয়ে থাকে তবে দায়টা কার? এটা কি প্রশাসনের ব্যর্থতাকেই ইঙ্গিত করে না? প্রশাসন কি অভিযুক্তদের শাস্তি দিতে আদৌ আগ্ৰহী ছিল? মালিয়ানার পাশাপাশি ১৯৮৭র ২২ মে হাসিমপুরাতেও সংঘটিত হয়েছিল গণহত্যা যাতে পিএসির সদস্যরা ৪২ থেকে ৪৫ জন মুসলিমকে ট্রাকে তুলে নিয়ে গিয়ে গুলি চালিয়ে হত্যা করে ক্যানেলের জলে ভাসিয়ে দিয়েছিল। সেই গণহত্যায় অভিযুক্ত পিএসি সদস্যদের শাস্তি প্রদানে যিনি প্রশংসনীয় ও দৃষ্টান্তমূলক ভূমিকা পালন করেন, সেই আইপিএস অফিসার বিভূতি নারায়ণ রাই মালিয়ানার রায় সম্পর্কে জানিয়েছেন – “এই রায় একেবারে শুরু থেকেই পুলিশের মামলাটাকে দুর্বল করে তোলার পরিণাম। এফআইআর-এ বেশকিছু ফাঁক-ফোকর ছিল। এফআইআর-এ অভিযুক্ত পিএসি সদস্যদের নামের উল্লেখ ছিল না। ময়নাতদন্তের রিপোর্টগুলোকে পাল্টে দেওয়া হয়। হিংসায় বেঁচে যাওয়া মানুষদের বিবৃতিগুলোকে ভুলভাবে নথিবদ্ধ করা হয়। হাসিমপুরার মতোই সরকারি প্রতিষ্ঠানের লোকজন বিষয়টাকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল।” এখানে উল্লেখ্য, পুলিশ নির্দিষ্ট অভিযুক্তদের খুঁজে বার করার পরিবর্তে ভোটার তালিকা থেকে ইচ্ছে মতো ৯৩ জনের নাম তুলে নিয়ে অভিযুক্তদের তালিকা বানিয়েছিল, যাদের মধ্যে বেশকিছু ব্যক্তি গণহত্যা সংঘটিত হওয়ার অনেক আগেই মারা গিয়েছিল এবং এটাও মামলা দুর্বল হয়ে পড়ার অন্যতম কারণ ছিল।

আর, বিচারকও কি ন্যায়বিচার প্রদানে অভিযুক্তদের শাস্তি দেওয়ার লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন? অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পেশ হওয়া অভিযোগগুলো প্রমাণের লক্ষ্যেই কি তিনি সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্ৰহণ করেছিলেন? রায় বেরোনোর পর এক সাক্ষী মহম্মদ ইসমাইল জানিয়েছেন (যিনি দাঙ্গায় তাঁর প্রায় পুরো পরিবারকেই হারান) – “আমার বক্তব্য নথিবদ্ধ করাটাকে বিচারক প্রয়োজনীয় মনে করেননি। আমাকে জানুয়ারির গোড়ায় আদালতে হাজির হতে বলা হয়েছিল। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখলাম বিচারক ছুটিতে গেছেন। আর এখন আমি খবরের কাগজ থেকে এই রায়টা জানতে পারলাম।”

সাম্প্রতিক কালের অন্য আর একটা যে রায়ে ন্যায়বিচার মুখ থুবড়ে পড়ে তা হল ২০০২-এর ২৮ ফেব্রুয়ারি নারোড়া গাম গণহত্যায় আমেদাবাদের বিশেষ আদালতের বিচারক শুভদা বক্সীর ২০ এপ্রিলের রায় যাতে ৬৭ জন অভিযুক্তকেই বেকসুর খালাস দেওয়া হয়। নারোড়া গাম ছিল নরেন্দ্র মোদীর শাসনাধীনে গুজরাতে ২০০২-এর মুসলিম-বিরোধী দাঙ্গার অন্যতম অকুস্থল। সেদিন একই মুসলিম পরিবারের নারী-শিশু-সহ ১১ জনকে ঘরে আটকে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়। ঐ মামলায় অভিযুক্ত হয়েছিলেন ৬৭ জন এবং অভিযুক্তদের মধ্যে ছিলেন সেই সময়ের মোদী সরকারের মন্ত্রী মায়া কোডনানী এবং বজরং দলের নেতা বাবু বজরঙ্গি। বহু প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী আদালতে তাঁদের সাক্ষ্যে বলেন, ঘটনার দিন তাঁরা মায়া কোডনানীকে নারোড়া গামে সশরীরে হাজির থাকতে এবং দাঙ্গায় প্ররোচনা দিতে দেখেছিলেন। আর, অমিত শাহ ২০১৭র ফেব্রুয়ারি মাসে মায়া কোডনানীর হয়ে সাক্ষী হিসাবে হাজিরা দিয়ে আদালতে বলেন, ১১ জনকে পুড়িয়ে মারার দিন তিনি সকাল সাড়ে আটটায় মায়া কোডনানীকে বিধানসভায় দেখেছিলেন এবং বেলা সওয়া এগারটা নাগাদ সোলা সিভিল হাসপাতালেও তাঁকে উপস্থিত থাকতে দেখেছিলেন। কাজেই, দাঙ্গার সময় নারোড়া গামে কোডনানীর উপস্থিতি অবিশ্বাস্য। অমিত শাহর সদর্প সাক্ষ্যের চাপে নারকীয়তা চাক্ষুষ করা প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য তলিয়ে গেল এবং শাসক দলের প্রতাপান্বিত নেতার সাক্ষ্য বিচারকের কাছে শিরোধার্য হল। এই গণহত্যার তদন্ত যাতে দ্রুত সমাধা হয় তার জন্য সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বিশেষ তদন্তকারী দল বা সিট গড়া হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের ‘দ্রুততার’ বাস্তবায়ন ঘটল গণহত্যা সংঘটিত হওয়ার ২১ বছর পর সমস্ত অভিযুক্তকে বেকসুর খালাস দেওয়ার মধ্যে দিয়ে, এবং রায় ঘোষণার পর আদালত চত্বর বিস্ফোরিত হল ‘জয় শ্রীরাম’, ‘ভারত মাতা কি জয়’ ধ্বনির অট্টনাদে। বিচারকের কানেও সেই আওয়াজ নিশ্চয় পৌঁছেছিল! তবে, গণহত্যার এই ঘটনার বিচারের পর যে প্রশ্নগুলো রয়ে গেল এবং চর্চায় ফিরে এল তা হলো: পুলিশের উপস্থিতিতেই যে নারকীয় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল, তাতে কাদের হাত ছিল? তাদের সনাক্ত করাটা কি খুবই দুঃসাধ্য ছিল? গুজরাত সরকার কাদের পাশে দাঁড়াতে আগ্ৰহী ছিল – নিহতদের পরিবারের নাকি অভিযুক্তদের?

অতএব, প্রশ্ন আজ উঠছে ন্যায়বিচারের অভিভাবকের দৃঢ়তার অভাব নিয়ে, বহু মামলাতেই ন্যায়বিচার প্রদানে বিচারবিভাগের ব্যর্থতা নিয়ে। এরই পাশাপাশি বিচারের প্রহসনে পর্যবসিত হওয়াও এক চর্চিত বিষয় হয়ে উঠেছে, এবং “গণতন্ত্রের জননী” রূপী এই দেশে বিচারবিভাগের নিরপেক্ষতা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে থাকছে না। জনগণের বুনিয়াদি অধিকারের রক্ষায় আদালতের ব্যর্থতাও প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে। সরকারের স্বেচ্ছাচারী পদক্ষেপকে সমালোচনায় ফেলে নাগরিকের নিপীড়ন প্রতিরোধ ও অধিকার সুরক্ষার পরামর্শ আদালতের কাছ থেকে কদাচই আসে। এছাড়া, আদালতকে ও বিচারপতিদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনার মোদী সরকারের প্রচেষ্টাতেও কোনো খামতি নেই। আদালতকে সরকারের বশংবদ পরিণত করা চলবে না, বিচারের প্রহসন নয়, চাই ন্যায়বিচার – এই দাবি অত্যন্ত সংগতভাবেই আজ হয়ে উঠেছে নাগরিক আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা।

- জয়দীপ মিত্র

খণ্ড-30
সংখ্যা-14