ন্যায়বিচার লাভে সংগ্রামকে অব্যাহত রাখলেন মহিলা কুস্তিগিররা
struggle-for-justice

যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে আন্দোলনরত মহিলা কুস্তিগিররা অবশেষে প্রাথমিক সাফল্য পেলেন গত শুক্রবার ২৮ এপ্রিল, যা এল কুস্তি ফেডারেশনের প্রধান ব্রিজভূষণ শরণ সিং’এর বিরুদ্ধে দিল্লী পুলিশের দুটো এফআইআর দায়েরের মধ্যে দিয়ে। রাজধানী দিল্লীর যন্তরমন্তরে সমবেত হয়ে দ্বিতীয় দফার আন্দোলন মহিলা কুস্তিগিররা শুরু করেছিলেন ২৩ এপ্রিল। তার আগে গত ২১ এপ্রিল কনট প্লেস থানায় এক নাবালিকা-সহ সাত মহিলা কুস্তিগির কুস্তি ফেডারেশনের প্রধান ব্রিজভূষণ শরণ সিং’এর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ দায়ের করেন। ন্যায়বিচার লাভের দাবিতে অনড় থেকে তাঁরা সুপ্রিম কোর্টেরও শরণাপন্ন হন। কুস্তিগিরদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় এবং পিএস নরসিমার বেঞ্চ জরুরি ভিত্তিতে মামলাটির শুনানি গ্ৰহণ করে বললেন, “দেশের প্রতিনিধিত্ত করা কুস্তিগিররা যৌন হেনস্তার মতো গুরুতর অভিযোগ তুলেছেন। আদালত এই আবেদন এড়িয়ে যেতে পারে না।” সুপ্রিম কোর্টের এই হস্তক্ষেপের পরিণতিতেই এলো ঐ এফআইআর দ্বয়।

এবার আমরা একটু ফিরে তাকাই প্রথম পর্বের আন্দোলনের দিকে। মহিলা কুস্তিগিররা কুস্তি ফেডারেশনের প্রধান ব্রিজভূষণ শরণ সিং’এর বিরুদ্ধে যৌন নিগ্ৰহের অভিযোগ এনে আন্দোলন শুরু করেন এ’বছরের ১৮ জানুয়ারি। সেদিন ৩০ জন মহিলা কুস্তিগির যন্তরমন্তরে সমবেত হয়ে বললেন, কুস্তি ফেডারেশনের প্রধান ব্রিজভূষণ শরণ সিং’এর হাতে তাঁদের শুধু যৌন নিগ্ৰহই ঘটছে না, তাঁদের মানসিক চাপ ও যন্ত্রণাও তীব্র হয়ে উঠছে এবং তাঁরা খুনের হুমকিও পাচ্ছেন। এই মহিলা কুস্তিগিরদের মধ্যে ছিলেন সাক্ষী মালিক, বিনেশ ফোগট, সরিতা মোর, সঙ্গীতা ফোগট, সুনিতা মালিক ও অন্যান্যরা। এদের বেশ কয়েকজনই আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায়, অলিম্পকসের মতো ক্রীড়া প্রতিযোগিতার মঞ্চে পদক লাভ করে ভারতকে গৌরবান্বিত করেছেন, ক্রীড়া ক্ষেত্রে ভারতের ভাবমূর্তিকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। কুস্তি ফেডারেশনের প্রধানের যৌন নিগ্ৰহের কৌশলকে উন্মোচিত করে বিনেশ ফোগট সাংবাদিকদের সামনে বললেন, “এই যৌন নিগ্ৰহ প্রতিদিন ঘটছে। প্রশিক্ষণ শিবির কেন সংগঠিত হয় লক্ষ্ণৌতে? এর কারণ, সেখানে সিং’এর নিজের একটা বাড়ি আছে এবং সেখানে মেয়েগুলোর কাছ থেকে সুযোগ নেওয়াটা সুবিধাজনক।”

কুস্তিগিরদের প্রতিবাদ নাগরিক সমাজের কাছ থেকে ক্রমেই আরো বেশি সমর্থন লাভ করতে লাগল এবং একটা জাতীয় ইস্যু হয়ে উঠল। নরেন্দ্র মোদীর সরকার বুঝল, বিজেপি সাংসদ ব্রিজভূষণ শরণ সিং’কে কেন্দ্র করে কুস্তিগিরদের প্রতিবাদ চলতে থাকলে তাদের মুখোশ খুলতে থাকবে, বিপদ বেড়ে চলবে। এই প্রতিবাদ থামাতে কিছু একটা করা দরকার। আসরে নামলেন “গোলি মারো”, মন্তব্য খ্যাত ক্রীড়ামন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর। তিনি বললেন, মহিলা কুস্তিগিরদের অভিযোগ খতিয়ে দেখার জন্য একটা কমিটি গঠন করা হবে, এবং কমিটি চার সপ্তাহের মধ্যে রিপোর্ট দেবে। তিনি আরও জানালেন, কমিটি যতদিন না রিপোর্ট দিচ্ছে ততদিন ব্রিজভূষণ কুস্তি ফেডারেশনের প্রধানের পদ থেকে সরে দাঁড়াবেন। মন্ত্রীর প্রতিশ্রুতিতে আস্থা রেখে কুস্তিগিররা ২০ জানুয়ারি তাঁদের প্রতিবাদ স্থগিত করলেন এবং মন্ত্রীর তৈরি ওভারসাইট কমিটির রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলেন।

সাত সদস্যের ওভারসাইট কমিটি গঠন করা হল, কিন্তু কমিটির গঠন নিয়ে সাক্ষী মালিক, বিনেশ ফোগট, বজরং পুনিয়ারা সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। কমিটির প্রধান করা হল খ্যাতনামা বক্সার মেরি কমকে যিনি ২০১৬ সালে বিজেপি মনোনীত রাজ্যসভার সদস্য হন। কমিটির আর এক সদস্য খেলরত্ন পুরস্কার প্রাপক যোগেশ্বর দত্ত ২০১৯ সালে বিজেপিতে যোগ দেন এবং প্রকাশ্যেই ব্রিজভূষণের সমর্থনে বিবৃতি দিয়েছেন।

বিনেশ ফোগট’এর তুতো বোন ববিতা ফোগটকেও কমিটির সদস্য করা হয় যিনি হরিয়ানার বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। কমিটিকে এইভাবে বিজেপি অনুগত লোকজন দিয়ে ভরানো হল যার উদ্দেশ্য পরিষ্কার — কমিটির রিপোর্ট যেন ব্রিজভূষণের অনুকূলে থাকে।

কুস্তি ফেডারেশনের প্রধান ব্রিজভূষণ শরণ সিং’এর পরিচিতি ও খ্যাতি কী ধরনের? তিনি ক্ষমতাসম্পন্ন রাজনীতিবিদ, উত্তরপ্রদেশের কাইসারগঞ্জ ক্ষেত্র থেকে বিজেপি সাংসদ এবং ১২ বছরেরও বেশি সময় ধরে কুস্তি ফেডারেশনের চেয়ারম্যান হয়ে রয়েছেন। অনেকেই তাঁকে এক ‘মাফিয়া’ বলে জানেন এবং তাঁর দাপটের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস করেন না। কুস্তিগিরদের দায়ের করা অভিযোগ-সহ ওঁর বিরুদ্ধে ৪০টা মামলা রয়েছে — যেগুলোর মধ্যে অপরাধের প্রায় সব ধরনের অভিযোগই দেখা যায়। তিনি বাবরি মসজিদ ধ্বংসেও যুক্ত ছিলেন।

কলাম লেখক মুকুল কেশভন ৩০ এপ্রিলের দ্য টেলিগ্রাফ সংবাদপত্রে ‘গ্রে সাইলেন্স’ শীর্ষক নিবন্ধে জানিয়েছেন, “গুলি করে এক ব্যক্তিকে হত্যার কথা তিনি টেলিভিশনেই স্বীকার করেছেন, সব ধরনের অভিযোগেই অভিযুক্ত হয়েছেন — ডাকাতি থেকে খুন পর্যন্ত। তাঁর সমর্থনে যাঁরা রয়েছেন তাঁরা হলেন দিল্লী পুলিশ যারা সুপ্রিম কোর্ট হস্তক্ষেপ না করা পর্যন্ত এফআইআর দায়ের করেনি, রয়েছেন সলিসিটর জেনারেল, যিনি যথাযোগ্য প্রক্রিয়ার অজুহাতে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তাকে সমর্থন করেছেন এবং ক্রীড়ামন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর যিনি ওভারসাইট কমিটির রিপোর্টের মধ্যে গোটা বিষয়টাকে চাপা দিয়েছেন যাদের রিপোর্ট এখনও প্রকাশ করা হয়নি।” আর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিবেচনাতেও মহিলা কুস্তিগিরদের সম্ভ্রম ও ইজ্জতের প্রতিষ্ঠা একেবারেই গুরুত্ব পেল না। গোটা ব্যাপারটায় নীরব থেকে তিনি জানিয়ে দিলেন, মহিলাদের ন্যায়বিচার লাভের চেয়ে ‘মাফিয়া’ চরিত্রের বিজেপি সাংসদের সুরক্ষাই তাঁর কাছে অধিকতর গুরুত্বের। সাক্ষী মালিক মোদীর এই মনোভাবকে কটাক্ষ করে বলেছেন, “প্রধানমন্ত্রী মোদী স্যার বেটি বাঁচাও ও বেটি পড়াও’এর কথা বলেন এবং সবার ‘মন কী বাত’ শোনেন। তিনি কি আমাদের ‘মন কী বাত’ শুনতে পারেন না? আমরা পদক পেলে তিনি আমাদের তাঁর বাড়িতে আমন্ত্রণ জানান এবং আমাদের যথেষ্ট সম্মান দেখান ও নিজের মেয়ে বলে অভিহিত করেন।… আমাদের মন কী বাত শোনার জন্য তাঁর কাছে আমরা আবেদন জানাচ্ছি। কুস্তিগিরদের আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন কপিল দেব, বীরেন্দ্র সেহবাগ, নভজ্যোত সিং সিধু, মদনলাল, হরভজন সিং’এর মতো কিছু প্রাক্তন ক্রিকেটার। সমর্থন এসেছে অলিম্পিকে জ্যাভলিন ছোঁড়ায় স্বর্ণপদক প্রাপ্ত নীরজ চোপড়া এবং শুটিংয়ে স্বর্ণপদক প্রাপ্ত অভিনব বিন্দ্রার কাছ থেকে। টেনিস তারকা সানিয়া মির্জা, মহিলা হকি খেলোয়াড় রানি রামপাল এবং আরও কিছু ক্রীড়াবিদ কুস্তিগিরদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।

কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হল, বর্তমান ক্রিকেটারদের কেউই কুস্তিগিরদের ন্যায়বিচারের দাবির প্রতি সমর্থন জানানোটাকে কর্তব্য বলে মনে করতে পারেননি। বিনেশ ফোগট অত্যন্ত মর্মাহত হয়েই বলেছেন, ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর ‘সাহস ওঁদের না থাকাটা’ তাঁকে ‘যন্ত্রণা’ দেয়। আমাদের কম বিস্মিত করে না ভারতীয় অলিম্পিক কমিটির সভাপতি পিটি ঊষার মন্তব্যও। নিজে মহিলা অ্যাথলিট হয়ে মহিলা কুস্তিগিরদের সম্মান-মর্যাদা রক্ষায় তিনি বিবেকী হতে পারলেন না। উল্টে কুস্তিগিরদের সমালোচনায় বললেন, “কুস্তিগিররা রাস্তায় নেমে যে প্রতিবাদ সংগঠিত করছেন সেটা শৃঙ্খলাহীনতার পরিচায়ক। এটা ভারতের ভাবমূর্তিকে কলঙ্কিত করছে।” পিটি ঊষার এই মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে দিল্লী মহিলা কমিশনের প্রধান স্বাতী মালিওয়াল বলেছেন, “এইভাবেই শৈশবের নায়িকারা সম্মান হারান”। বিজেপি মন্ত্রীসভার সুপারিশে রাষ্ট্রপতি পিটি ঊষা এবং আরও তিনজনকে দক্ষিণের রাজ্যগুলো থেকে রাজ্যসভার সদস্য রূপে মনোনীত করেন, আর তার পিছনে দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে প্রভাব বিস্তারের অভিপ্রায়ও বিজেপির ছিল। বিজেপি তাঁকে রাজ্যসভার সদস্য করায় বিজেপি সাংসদের নষ্টামির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সৎসাহসটুকু তিনি দেখাতে পারলেন না।

যদি বলা হয়, অর্থ ও নামযশের মোহের কাছে করো কারো মনুষ্যত্ববোধ ও মানবপ্রীতিও বিকিয়ে যায় তবে বোধহয় খুব ভুল বলা হবে না।

দু’টো এফআইআর’এর পর দিল্লী পুলিশ কুস্তিগিরদের যন্তরমন্তরের প্রতিবাদ স্থল ছেড়ে যেতে বলেছে। ঐ স্থলের বিদ্যুৎ সংযোগ ছিন্ন করা হয়েছে, জল ও খাবার সরবরাহকে আটকানো হয়েছে, মারধর করা হয়েছে ঐসব জিনিসের সরবরাহকারীদের। তবে কুস্তিগিররাও প্রতিবাদে অবিচল রয়েছেন। বজরং পুনিয়া বলেছেন, “ন্যায়বিচার না পাওয়া পর্যন্ত আমরা প্রতিবাদ জানিয়ে যাব, পুলিশ প্রশাসন আমাদের ওপর যত অত্যাচারই করুক না কেন।” আর বিনেশ ফোগটও বলেছেন, “এই লড়াইটা শুধু একটা এফআইআর দায়েরের জন্যই নয়। এই লড়াইটা ন্যায়বিচার পাওয়ার, ওকে শাস্তি দেওয়ার, ওকে জেলে পাঠানোর এবং ও যে সমস্ত পদ অধিকার করে রয়েছে সেগুলো থেকে অপসারিত করার লড়াই।” কুস্তিগিররা ভালো করেই জানেন তাঁদের প্রতিপক্ষ কতটা শক্তিধর। প্রবল প্রতাপসম্পন্ন এই ক্ষমতাধরদের বিরুদ্ধে সাক্ষী মালিক-বিনেশ ফোগট-বজরং পুনিয়ারা নিজেদের ক্যারিয়ার বিপন্ন করেও লড়াই জারি রেখেছেন, ক্রীড়া মন্ত্রকের কপটাচার ও ছলচাতুরিকে উপেক্ষা করে, শূন্যগর্ভ প্রতিশ্রুতিতে প্রতারিত না হয়ে ভয়ের বাতাবরণ ছিন্ন করে শাসকদের চ্যালেঞ্জ জানিয়ে চলেছেন। বিরল দৃষ্টান্তের স্পর্ধিত এই সংগ্রামের সহস্র সেলামই প্রাপ্য!

- জয়দীপ মিত্র

খণ্ড-30
সংখ্যা-13