গৃহশ্রমিক হিসাবে সরকারী স্বীকৃতি আদায়ের লড়াই জোরদার হোক
domestic-worker-be-strengthened

গত ১৬ই জুন আমরা আরও একটা আন্তর্জাতিক গৃহশ্রমিক দিবস পেরিয়ে এলাম। ভারতে বহু নারীই গৃহশ্রমিক হিসাবে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করেন। গৃহশ্রমিক সেই ব্যক্তি যিনি অন্যের বাড়িতে মজুরির বিনিময়ে বাড়ির কাজ অর্থাৎ গৃহকর্ম করেন। NSS ২০০৫’র সমীক্ষা অনুযায়ি ভারতে ৪৭ লক্ষ গৃহশ্রমিক আছেন যদিও স্বাভাবিক নিয়মে এবং অনান্য কর্মক্ষেত্রে নারীর ধারাবাহিক সংখ্যালঘুত্ব বর্তমানে নারী গৃহশ্রমিকদের সংখ্যা কয়েকগুন বৃদ্ধি করেছে। বিভিন্ন গবেষক ও সংগঠকদের হিসাব মতে বর্তমানে দেশে গৃহশ্রমিকের সংখ্যা ৯ কোটি। তবে সরকারী তথ্য এবং গবেষণা সংস্থাগুলির সাংখ্যিক দরাদরির বাইরে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে সারা দেশে ৫ কোটিরও বেশি গৃহশ্রমিক আছেন এবং এদের মধ্যে অধিকাংশই নারী এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে। প্রচলিত ভাষায় গৃহশ্রমিকদের ‘কাজের মেয়ে’, গৃহ পরিচারিকা ইত্যাদি বলা হয়। বিভিন্ন রাজ্যে তাদের বিভিন্ন স্থানীয় নামেও ডাকা হয়, শ্রমিক পরিচয়টিকে স্বীকৃতি দিতে আমরা গৃহশ্রমিক শব্দটি ব্যবহার করি এবং সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

এখন এই শ্রমিক পরিচয়ের অর্থ, সরকারের কাছ থেকে শ্রমিকের সম্মান আদায় করা এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বীকৃতি ও নিশ্চয়তার অধিকার দাবি করা। কিন্তু ভারতে গৃহশ্রমিকদের জন্য কোনও বিশেষ আইন নেই। তবে গৃহশ্রমিকরা অবশ্যই কয়েকটি আইনের আওতায় পড়েন যেমন অসংগঠিত শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা আইন (২০০৮) আর কর্মক্ষেত্রে যৌনহেনস্থা আইন (২০১৩)। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গে আছে সামাজিক সুরক্ষা যোজনা (২০১৭)। কর্ণাটক, কেরালা, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাডু, বিহার, রাজস্থান, মেঘালয় ইত্যাদি রাজ্যে ন্যূনতম মজুরি সম্বন্ধে নোটিস জারি হয়েছে। আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী যদিও মাসকয়েক আগে গৃহশ্রমিকদের জন্য নুন্যতম বেতন কাঠামো ঠিক করবেন বলেছিলেন, কিন্তু সেটা তার অনান্য কথার মতই আখেরে জনমোহিনী বাগাড়ম্বর কিনা তা নিয়ে খোদ গৃহশ্রমিকরাই ধন্দে আছেন। কারণ সরকার অন্ততপক্ষে একজন গৃহশ্রমিককে রাজ্য শ্রম দপ্তরের নির্দেশ অনুযায়ী (সিরিয়াল নম্বর ২৮, মেমো নং ১২২/Stat/৫/RW/১২/২০২২/LCS/JLC, তারিখ ২৭ ডিসেম্বর ২০২২) ঘর পরিস্কার ইত্যাদি কাজের জন্য নুন্যতম ৩৭৬ টাকা প্রতি দিন অর্থাৎ ৪৭ টাকা প্রতিঘণ্টা মজুরি দেওয়ার নিয়মে কেন জোর দেয়না কিম্বা সামাজিক সুরক্ষার প্রকল্পে গৃহশ্রমিকদের জন্য বিশেষ সংরক্ষন চালু করে না সে প্রশ্নও উঠতে শুরু করেছে।

প্রসঙ্গত ২০১১ সালে ILO ডোমেস্টিক ওয়ার্কার্স কনভেনশন (১৮৯ নং) প্রচলন করে। এই কনভেনশনটিকে সাধারণতঃ ILO C১৮৯ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। বহু দেশ এবং তাতে ভারতও আছে যারা এখনও এই কনভেনশনটিকে নিজের আইনের কাঠামোয় কার্যকরী করার অঙ্গিকার নেয়নি। ILO C১৮৯এ গৃহশ্রমিকদের মজুরি, ওভারটাইম, কাজের সময়, বিশ্রাম, নিরাপত্তা ইত্যাদি নিয়ে নির্দেশ দেওয়া আছে। পরিযায়ী গৃহশ্রমিকদের কথাও বিশেষভাবে বলা আছে। ILO C১৮৯’র উদ্দেশ্য গৃহশ্রমিকরাও অন্যান্য সব শ্রমিকদের মতই যেন অধিকার ও সুযোগ সুবিধা পায়। ভারতরাষ্ট্র এই আন্তর্জাতিক চুক্তিপত্রে এখনও সম্মতি দেয়নি যদিও ভারতে এখনও গৃহশ্রমিকদের মজুরি, কাজের সময়, ছুটি, অসুখবিসুখের জন্য সহায়তা, কর্মজীবন থেকে অবসর গ্রহণ ইত্যাদি নিয়ে কোনও নিয়মনীতি নেই। অধিকাংশ গৃহশ্রমিকরাই নিরক্ষর অথবা স্বল্প সাক্ষর এবং তাদের কাজের চুক্তি নিয়োগকারির সঙ্গে মৌখিকভাবেই হয়। বেশিরভাগ নিয়োগকারিই গৃহশ্রমিকদের প্রতি সপ্তাহে একটি করে ছুটি দিতে নারাজ। মনে রাখতে হবে যে অধিকাংশ গৃহশ্রমিকরা দলিত অথবা আদিবাসি সমাজ থেকে আসেন। এখনও গৃহশ্রমিকদের প্রতি ব্যবহারে জাতিবিদ্বেষ ও বৈষম্য দেখা যায়। অনেকেই গৃহশ্রমিকদের ভাঙা, রংচটা বাসনে খেতে দেন, নিয়োগকারির পরিবারের জন্য নির্দিষ্ট বাসনে গৃহশ্রমিকদের খেতে দেওয়া হয়না, নিয়োগকারিদের শৌচালয় ও স্নানের ঘরও গৃহশ্রমিকদের ব্যবহার করতে দেওয়া হয়না। উচ্চবর্ণের হিন্দু নিয়োগকারিরা মুসলমান গৃহশ্রমিকদের কাজ দিতে চান না। ভারতের বহু শহরেই এখন বিলাসবহুল আবাসন তৈরি হয়েছে এবং হচ্ছে। বহু জায়গায় এই ধরনের আধুনিক ব্যবস্থায় দেখা যাচ্ছে যে আবাসনের বাসিন্দা ও তাঁদের আত্মীয় বন্ধুদের জন্য সংরক্ষিত লিফটে গৃহশ্রমিক ও সেই আবাসনে অন্যান্য পরিষেবা দিতে আসা শ্রমিকদের ওঠার নিয়ম নেই।

ভারতবর্ষে বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে দু’দশকেরও বেশি সময় ধরে গৃহশ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে নারীবাদী অধিকার আন্দোলনের কর্মী অঞ্চিতা ঘটক বলেছেন

“গৃহশ্রমিকদের সঙ্গে কাজ করতে করতে আমার সহকর্মীরা ও আমি দেখেছি যে তাঁরা বেশিরভাগই খুব কম মজুরি পান। কলকাতা শহরে বহু গৃহশ্রমিক আছেন যারা চার পাঁচটা বাড়িতে কাজ করেও মাসে ১০,০০০ টাকার কম উপার্জন করেন। এছাড়া জাতিবিদ্বেষ, অর্থনৈতিক শোষণ এবং চলমান সব ধরণের অচলাবস্থার প্রভাবে গৃহশ্রমিকরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে থাকেন।”

অতিমারীর সময় অধিকাংশ গৃহশ্রমিক ও তাদের পরিবারের নিদারুণ ক্ষতি হয়েছে। ২০২০ সালের ২৪ মার্চ যখন প্রথম লকডাউন ঘোষিত হল তখন দেখা গেল যে গৃহশ্রমিকদের কাজে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। কলকাতায় দেখা গেল যে বেশিরভাগ নিয়োগকারীরাই মার্চ মাসের মাইনে দিতে উদ্যোগ নিলেন। মনে রাখতে হবে যে মার্চ মাসে গৃহশ্রমিকরা প্রায় পুরো মাসটাই কাজ করেছিলেন। এপ্রিল মাস শেষ হতেই দেখা গেল যে চিত্রটা অন্য। যদিও তখন লকডাউন পুরোমাত্রায় জারি এবং সকলেরই বাড়ি থেকে বেরোনো বারণ তবুও বহু নিয়োগকারিরা আর গৃহশ্রমিকদের মজুরি দিতে রাজি হলেন না। মনে রাখতে হবে যে এই সময়ে অসংগঠিত ক্ষেত্রের বহু শ্রমিকেরই রোজগার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। গৃহশ্রমিকদের পরিবারের অন্যান্যরাও অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিভিন্ন অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেই রোজগার করেন।

অতিমারীর সময় খুবই স্পষ্টভাবে দেখা গেল যে কোনও রকম সরকারি সুযোগ সুবিধা না থাকার ফলে গৃহশ্রমিক এবং অন্যান্য বহু শ্রমিকই খুবই কঠিন পরিস্থিতিতে পড়লেন। আমরা জানতে পারলাম যে বহু পরিযায়ী শ্রমিকেরা হাজার হাজার কিলোমিটার হেঁটে অতিক্রম করলেন, কারণ যানবাহন চলছিল না। অতিমারীর মধ্যে — লকডাউন পরবর্তী সময়েও — দেখা গেছে যে বিভিন্ন সরকারি পরিষেবা নিয়মিতভাবে গৃহশ্রমিক ও অন্যান্য গরিব মানুষদের কাছে পৌঁছোয় না। যেমন রেশন ব্যবস্থায় যা পাওয়ার কথা তার চেয়ে তাঁরা অনেক কম পান। রোজগারে টান পড়া এবং দৈনন্দিন জীবন ব্যাহত হওয়ার ফলে সরকারি পরিষেবার বিকল্প খোঁজাও তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি।

গৃহশ্রমিকদের সঙ্গে কথাবার্তার সময় এইটাই মনে হওয়া স্বাভাবিক যে তাঁদের পরিস্থিতির জন্য নিয়োগকারীরাই দায়ী। নিয়োগকারীদের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কয়েকটি জায়গা আমি এই প্রবন্ধে উল্লেখ করেছি। গৃহশ্রমিকদের অবস্থার উন্নতি করতে হলে এবং তাঁদের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভারত সরকার যদি ILO C১৮৯-কে নিজের আইনের কাঠামোয় কার্যকরী করার অঙ্গিকার করে (যাকে র‍্যাটিফাই করা বলে) তাহলে গৃহশ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এই পদক্ষেপ নেওয়ার ফলে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গৃহশ্রমিকদের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সরকারকে আইন এবং বিভিন্ন নিয়ম প্রচলন করতে হবে যার ফলে গৃহশ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন অধিকার যেমন মজুরি, কাজের সময়, ছুটি, স্বাস্থ্য, কাজে নিয়োগ করার নিয়ম ইত্যাদি রক্ষা করা যাবে বলে আশা করা যায়।

গৃহশ্রমিকরা নিরন্তর বাঁচার লড়াই লড়ছেন। সরকারের উপরে তো অবশ্যই দায়িত্ব পড়ে গৃহশ্রমিকদের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করার। আইন প্রণয়ন করার সঙ্গে সঙ্গে যথেষ্ট আর্থিক বরাদ্দও করতে হবে যাতে আইনগুলি কার্যকরী করা যায়। তাছাড়া নিয়মনীতিগুলি লাগু করার সদিচ্ছা তো অবশ্যই থাকতে হবে। নিয়োগকারীরাও গৃহশ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অগ্রণি ভূমিকা নিতে পারেন যেমন তাঁদের উচিত মজুরি দেওয়া, সাপ্তাহিক ছুটি দেওয়া, মাতৃত্বকালিন ছুটির ব্যবস্থা করা, বৈষম্যমূলক আচরণ ত্যাগ করা ইত্যাদি। সরকারের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে গৃহশ্রমিকদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া যেমন প্রয়োজন, একই সঙ্গে বিভিন্ন নাগরিক অধিকার ও পরিষেবা যাতে প্রত্যেকটি গরিব মানুষের কাছে সহজেই পৌঁছোয় তারও ব্যবস্থা নিতে হবে।

- সংগ্রাম মণ্ডল

(কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অঞ্চিতা ঘটক)

খণ্ড-30
সংখ্যা-20