বিবৃতি
মনিপুর জ্বলছে — বিজেপির নীতির ফলেই
manipur-is-burning

[ মে মাসের গোড়াতে মনিপুরে একদিকে মেইতেই এবং অন্যদিকে কুকি-নাগা-চিন ও অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মধ্যে শুরু হওয়া সংঘাতে যতি পড়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। উভয় দিক থেকেই হিংসা ও ক্রূরতার নারকীয় ঘটনাগুলো ঘটেই চলেছে। হিংসার ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১১০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন, ৪০০ জন আহত, ৬০,০০০ মানুষ ঘরছাড়া ও ২০০টি গ্রামের ৫০০০ বাড়ি আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সরকারি অস্ত্রাগার থেকে লুট হয়েছে বহু অস্ত্র ও গোলাবারুদ এবং কুকিদের ২০০টি চার্চ ভস্মীভূত হয়েছে। মনিপুরের ১০ জন বিধায়ক (যারমধ্যে ৭ জন বিজেপির) পৃথক শাসনাঞ্চলের দাবি তুলেছেন। মনিপুরের এই হিংসাদীর্ণ ও সংকটজনক পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মুখে কুলুপ এঁটেছেন, মনিপুর নিয়ে একটি ট্যুইটও করেননি, মন-কি-বাত মনিপুর প্রসঙ্গকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেছে এবং মনিপুরের প্রতিনিধি গোষ্ঠীকে সাক্ষাতের সময়ও তিনি দেননি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ হিংসা শুরু হওয়ার ২৬ দিন পর ২৯ মে থেকে ১ জুন মনিপুর সফর করলেও শান্তি ফেরার লক্ষণ সেখানে সম্পূর্ণরূপেই অনুপস্থিত। ভারতের নাগরিকরা তাই যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। সম্প্রতি মনিপুর নিয়ে একটি বিবৃতি প্রকাশ পেয়েছে, যাতে স্বাক্ষর করেছেন ৫৫০’রও বেশি নাগরিক সংগঠনের প্রতিনিধি, বিদ্বজ্জন, আমলা ও আইনজীবী। সংগঠনগুলোর মধ্যে রয়েছে পিইউসিএল, সহেলি উইমেনস রিসার্চ সেন্টার, ন্যাশনাল এলায়েন্স অব পিপলস মুভমেন্টস, এআইডিডব্লিউএ, উইমেন এগেনস্ট সেক্সুয়াল ভায়োলেন্স, ইন্ডিয়ান ক্রিশ্চিয়ান উইমেন্স মুভমেন্ট ও অন্যান্যরা। বিবৃতিটিতে মনিপুরের সংঘাতময় পরিস্থিতির বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ ধরা পড়েছে, এবং সেটির গুরুত্ব বিবেচনা করে তার ভাষান্তর আমরা এখানে রাখছি। - সম্পাদকমণ্ডলী ]

মনিপুরে মেইতেই জনগোষ্ঠী এবং জনজাতি কুকি ও জো সম্প্রদায়ের মধ্যে অব্যাহত জাতিগত হিংসায় আমরা গভীর উদ্বিগ্ন। আমরা এই হিংসা অবিলম্বে থামানোর দাবি জানাচ্ছি, যে হিংসা জীবন, জীবিকা ও সম্পদের বিপর্যয় ঘটাচ্ছে এবং জনগণের মধ্যে আরও সন্ত্রাস সৃষ্টি করছে।

এই হিংসা সূত্রপাতের আশু কারণ ছিল মেইতেই জনগোষ্ঠীকে তফসিলি জনজাতির মর্যাদা দেওয়ার জন্য রাজ্য সরকারকে মনিপুর হাইকোর্টের ২০২৩’র এপ্রিলের এক পরামর্শ (মেইতেই সদস্যরা অবশ্য ওবিসি এবং কিছু ক্ষেত্রে তফসিলি জাতির মর্যাদা পেয়ে থাকে)। আর সেটা হলে মেইতেই জনগোষ্ঠী সেই সমস্ত জমিও অধিকার করতে পারবে, যে জমিগুলো জনজাতি সম্প্রদায়গুলোর জন্য সংরক্ষিত রয়েছে। মে মাস জুড়ে সংঘটিত হল হিংসার বহু ঘটনা এবং উভয় পক্ষই সশস্ত্র হওয়ায় গৃহযুদ্ধের এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হল, আইন ও শৃঙ্খলা সম্পূর্ণ রূপে ভেঙে পড়ল। তারপর থেকে আমরা নিরাপত্তা বাহিনী, পুলিশ ও সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর হাতে অভূতপূর্ব মাত্রার পৈশাচিকতা ও ব্যাপক আকারের নিপীড়ন প্রত্যক্ষ করে চলেছি।

বিজেপি এবং কেন্দ্রে ও রাজ্যে তাদের সরকার বিভেদকামী রাজনীতি চালানোর জন্যই মনিপুরের এক বড় অংশ আজ জ্বলছে। আরো অনেক জনজীবন ধ্বংস হওয়ার আগেই চলমান এই গৃহযুদ্ধ থামানোর দায়টা তাদের ওপরই বর্তাচ্ছে। এই হিংসায় পুরুষ, নারী ও শিশুরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, ৩০০’র বেশি উদ্বাস্তু শিবিরে ৫০,০০০’রও বেশি মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন এবং লক্ষাধিক মানুষ ঘরছাড়া।

বাস্তবিকই, এ’বছরের জানুয়ারি থেকেই পরিস্থিতি শোচনীয় হতে শুরু করে যখন বিজেপি নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকার সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে ‘অবৈধ অভিবাসীদের’ অপসারিত করতে থাকে, যারা তাদের কথামতোই ১৯৭০’র দশক থেকেই মনিপুরে বসতি স্থাপন করতে শুরু করেছে। রাজ্য সরকার বনে বসবাসকারী জনজাতিদের ‘অবৈধ দখলদার’ বলে ঘোষণা করে চুড়াচাঁদপুর, কাংপোকপি ও টেংগানৌপাল জেলায় উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে।

বিজেপি সারা দেশেই যা করে থাকে সেই ধারাতেই নিজের রাজনৈতিক স্বার্থে দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসা জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যেকার জাতিগত উত্তেজনাকে আরও একবার বাড়িয়ে তুলছে। স্পষ্টতই, বলপ্রয়োগ করে ও জোর খাটিয়ে রাজ্যে নিজের অবস্থানকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার মধ্যেই রয়েছে বিজেপির ভূমিকা। সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে আলোচনায় উৎসাহ দেওয়ার কোনো প্রচেষ্টা আজ পর্যন্ত না চালিয়ে বিজেপি উভয় জনগোষ্ঠীরই মিত্র হওয়ার ভাণ করে তাদের মধ্যেকার ঐতিহাসিক উত্তেজনার গভীরতাকে আরও প্রসারিত করছে।

কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় সরকারই সাংবিধানিক সংস্থানগুলোকে হাতিয়ার করে গণতান্ত্রিক আলোচনা ধারা, যুক্তরাষ্ট্রীয়তা ও মানবাধিকারের সুরক্ষার ধারণাগুলোকে ধ্বংস করছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে কুকিদের বিরুদ্ধে চালিত নিকৃষ্টতম হিংসায় স্থায়ী রূপ দিয়েছে আরামবাই টেংগল ও মেইতেই লীপুন’এর মতো মেইতেই সংখ্যাগুরুবাদী গোষ্ঠীগুলো, আর তার সাথেই চলেছে গণহত্যার ঘৃণাভাষণ এবং শাস্তি থেকে অব্যাহতির কর্তৃত্ববাদী প্রদর্শনী। এই দুটির প্রথমটি হল একটি পুনর্জাগরণ গোষ্ঠী যারা মেইতেইদের সনমাহি ঐতিহ্যে ‘প্রত্যাবর্তন’ ঘটাতে চাইছে; আর দ্বিতীয়টির স্পষ্টতই রয়েছে হিন্দু শ্রেষ্ঠত্ববাদী দিশা। মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং এই গোষ্ঠী দুটোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। উভয় গোষ্ঠীই কুকি জনগোষ্ঠীকে ‘অবৈধ বহিরাগত’ এবং ‘মাদক সন্ত্রাসবাদী’ বলে কলঙ্কিত করে। মেইতেই লীপুন প্রধান এক সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে সর্বসমক্ষে এটা বলতে দ্বিধা দেখাননি যে, মেইতেইদের আপত্তি জানানো স্থানগুলো থেকে কুকিদের “নিশ্চিহ্ন করা হবে”। তিনি কুকি জনগোষ্ঠীকে অভিহিত করেন ‘অবৈধ’, ‘বহিরাগত’ রূপে; ‘পরিবারের অংশ না হওয়া’ রূপে; ‘মনিপুরের দেশজ নয়’ এবং মনিপুরের ‘ভাড়াটে বসবাসকারী’ হিসাবে। এর আগে মুখ্যমন্ত্রী নিজেই এক কুকি মানবাধিকার কর্মীকে ‘মায়ানমারের লোক’ বলে অভিহিত করেছিলেন; এটা ছিল সেই প্রচারের প্রতিই সমর্থন যা বলে থাকে যে মেইতেই জনগোষ্ঠী অশান্ত মায়ানমার থেকে চলে আসা উদ্বাস্তুদের কাছ থেকে জনসংখ্যাগত বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে। এই উদ্বাস্তুরা যেহেতু মনিপুরে যে জনজাতিরা থাকে সেই জনজাতিরই মানুষ, মেইতেই সংখ্যাগুরুবাদী গোষ্ঠীগুলো তাই এই জুজুকেই উস্কিয়ে তোলে যে সংখ্যার দিক থেকে জনজাতিদের বৃদ্ধি ঘটায় তারা সংখ্যাগুরু মেইতেইদের জনসংখ্যাকে ছাপিয়ে যাবে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে ‘অবৈধ’ অভিহিত করে অমানবিকিকরণ ঘটানোর যে ভাষা সেটা অসমে এনআরসি চলার সময় ব্যবহার করেছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং অসমের মুখ্যমন্ত্রী। সেই ভাষাই এখন উত্তর-পূর্বের আর একটা রাজ্যে সম্প্রসারিত হয়েছে, আর বিজেপি ঘৃণা, হিংসা বিদেশী ভয়ের অগ্নিশিখাকে উস্কিয়ে তুলছে।

এখানে উল্লেখ্য যে, ২০২২’র বিধানসভা নির্বাচনে কুকি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো বিজেপিকে ভোট দেওয়ার আবেদন জানিয়েছিল, এবং মনিপুর বিধানসভায় দশ কুকি বিধায়কের মধ্যে সাত জনই বিজেপির। কুকি গোষ্ঠীগুলোও বিজেপির অনুকরণেই তাদের প্রচার চালায়, এবং কুকি নেতারা যে সময় ভারতীয় রাষ্ট্রের স্বার্থের সঙ্গে সহযোগিতা করেছিলেন সেই দৃষ্টান্তকে জাহির করে মেইতেইদের ভারত-বিরোধী বলে দেগে দেয়। প্রাপ্ত রিপোর্ট জানাচ্ছে, চলমান হিংসায় নিহতদের ব্যাপক সংখ্যাধিকই হলো কুকি সম্প্রদায়ের। প্রাপ্ত খবর থেকে জানা গেছে যে কুকিদের ২০০টা চার্চ ভস্মীভূত হয়েছে, এবং তার সাথেই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে স্কুল, শস্যাগার এবং ঘরবাড়ি।

এটা অত্যন্ত বেদনাদায়ক যে আজ যাকে ভুয়ো খবর বলা হয়, সেটা আসলে যুগ যুগ ধরে চলে আসা গুজবেরই কৌশলগত ব্যবহার যাকে কাজে লাগিয়ে সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে সংঘাতকে উস্কিয়ে তোলা হয় এবং তাতে সবচেয়ে অসহায় হয়ে পড়ে নারীরা। প্রাপ্ত সংবাদ জানাচ্ছে, সংখ্যাগুরুবাদী মেইতেই গোষ্ঠীগুলো কুকিদের হাতে মেইতেই মহিলাদের ধর্ষণের ভুয়ো খবর ছড়ায়, এবং সেটাই কুকি-জো নারীদের গণপ্রহার এবং ধর্ষণের ওজর হয়ে ওঠে। নতুন পাওয়া রিপোর্ট জানাচ্ছে, উন্মত্ত দাঙ্গাবাজ জনতা নাকি নারীদের আক্রমণ করার সময় চিৎকার করে বলছে, “ওকে ধর্ষণ কর, ওর ওপর উৎপীড়ন চালাও”, তবে, এর সত্যতা যাচাই করা দরকার। আমরা যেমন হিংসার অব্যাহত তান্ডব অবিলম্বে বন্ধ করার দাবি জানাচ্ছি, তার সাথে এই প্রয়োজনটাও উঠে আসছে যে, হিংসা থামলেই নাগরিক সমাজের স্বাধীন, কোনো দলের অনুগামী নয় এমন সদস্যদের হিংসায় বেঁচে যাওয়া ও শোকার্ত মানুষদের সঙ্গে দেখা করতে হবে; হত্যা ও ধর্ষণের রিপোর্টের সত্যতা যাচাই করতে হবে; এবং প্রিয়জন, ঘরবাড়ি ও চার্চ হারানোয় মানসিকভাবে বিপর্যস্তদের সংহতি জানাতে হবে এবং সম্ভাব্য সমস্ত ধরনের সহায়তার হাতও বাড়িয়ে দিতে হবে।

সারা দেশের উদ্বিগ্ন নাগরিক হিসাবে আমরা দাবি জানাচ্ছি যে,

১) প্রধানমন্ত্রীকে নীরবতা ভঙ্গ করে মনিপুরের বর্তমান পরিস্থিতির দায় নিতে হবে।

২) উস্কিয়ে তোলা বিভেদ ও ঘৃণা প্রশমনের জন্য আদালতের তত্ত্বাবধানে একটা ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে যা তথ্যগুলোকে প্রতিষ্ঠিত করবে এবং ন্যায়বিচারের ভিত্তি প্রস্তুত করবে এবং প্রস্তুত করবে মনিপুরের জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বিচ্ছিন্নতার কারণ স্বরূপ গভীর যে ক্ষত তার নিরাময়ের ভিত্তি।

৩) ভার্মা কমিশন সুপারিশ করেছিল যে ‘সংঘর্ষ প্রবণ এলাকায় যৌন হিংসার জন্য দায়ী ব্যক্তিবর্গকে’ সাধারণ অপরাধ আইনের অধীনেই বিচার করতে হবে, এবং সেই অনুসারে রাষ্ট্রীয় বাহিনী এবং রাষ্ট্রশক্তির বাইরে লোকেদের হাতে ঘটা যৌন হিংসার সমস্ত ঘটনার বিচারের জন্য একটা ফাস্ট ট্র্যাক আদালত তৈরি করতে হবে।

৪) যে সমস্ত মানুষ ঘর ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন তাদের জন্য সরকারকে ত্রাণের ব্যবস্থা করতে হবে এবং নিজ নিজ গ্রামে যাতে তারা ফিরে আসতে পারে তা সুনিশ্চিত করতে হবে; তাদের ঘর ও জীবন নতুন করে নির্মাণ করতে হবে। যারা নিকটজনদের হারিয়েছে, আহত হয়েছে এবং ঘরবাড়ি, শস্য, গবাদি পশু ও অন্যান্য সামগ্রী হারিয়েছে তাদের জন্য এককালীন ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। ঘরে ফেরা, পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণের এই প্রক্রিয়ার তত্ত্বাবধান করবে এলাকার সঙ্গে সুপরিচিত অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের একটা দল, যাদের নিয়োগ সম্ভবত করবে হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্ট।

খণ্ড-30
সংখ্যা-20