মোদীর মার্কিন সফর : ভারতকে মার্কিন বিদেশ নীতির অনুগামী করে তোলার সংকেত
us-foreign-policy

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ২১-২৪ জুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর ছিল ‘রাষ্ট্রীয় সফর’। মোদী এরআগে পাঁচবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর করলেও সেগুলোর কোনোটাই রাষ্ট্রীয় সফর ছিল না। সাধারণ সফরের সঙ্গে ‘রাষ্ট্রীয় সফরের’ ফারাক হলো এই যে — এই সফরকে সর্বোচ্চ সফরের মর্যাদা দেওয়া হয়, সফরকারী রাষ্ট্রপ্রধানের দেশের সঙ্গে মিত্রতা ও জোট প্রভূত গুরুত্ব পায়, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে শক্তিশালী করা এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ভিত্তিতে কূটনৈতিক সম্পর্ককে গভীরতর করে তোলাটাও লক্ষ্য হয়। নরেন্দ্র মোদীর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘রাষ্ট্রীয় সফর’এর বিষয়সূচির মধ্যে অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তি ও নিরাপত্তার বিষয়গুলো ছিল, তবে সার্বিক বিচারে অগ্রাধিকারে ছিল ভূ-রাজনৈতিক এজেন্ডা। অর্থাৎ, মার্কিনের বিদেশ নীতির চরিতার্থতায় ভারতকে শামিল করাটা যদি এই ‘রাষ্ট্রীয় সফর’এর একটা লক্ষ্য হয়ে থাকে, তবে নরেন্দ্র মোদীও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ‘মৈত্রী’ ও পারস্পরিক ‘সহযোগিতা’র বকলমে মার্কিন বিদেশ নীতির পক্ষ অবলম্বনকেই স্পষ্ট করেছেন।

রাশিয়ার সঙ্গে শীতল যুদ্ধের অবসানের পর যে একমেরু বিশ্বের অভ্যুদয় ঘটেছিল, যখন গোটা দুনিয়ার ওপর ছড়ি ঘোড়নোটাকে আমেরিকা তার স্বকীয় বৈশিষ্ট্য করে তুলেছিল, আজকের বিশ্ব পরিস্থিতিটা তার থেকে আলাদা। আজ বিশ্বে কয়েকটা মেরুরই উদ্ভব ঘটেছে, আমেরিকা-সহ ন্যাটোর প্রতাপের পরোয়া না করে রাশিয়া ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে, আর শক্তিধর অর্থনৈতিক শক্তি হিসাবে আবির্ভাব ঘটেছে চীনের। শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, রাজনৈতিক প্রভাব এবং সামরিক শক্তির দিক থেকেও আমেরিকার সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে চীন। বিশ্বে তার আধিপত্য ফিরে পেতে চীনকে রোখা, চীনের অর্থনীতিতে সংকোচন ঘটানো, চীনের প্রভাবকে খর্বিত করাটা আমেরিকার বিদেশ নীতির গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা হয়ে রয়েছে। বর্তমানের মার্কিন-চীন দ্বন্দ্বকে অনেক ভাষ্যকারই দ্বিতীয় ঠান্ডা যুদ্ধের সূচনা বলে অভিহিত করছেন। ভারতের সঙ্গে চীনের সীমান্ত বিরোধ ও সেখানে অস্থিতিশীলতা রয়েছে। এছাড়া, দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে ভারত চীনকে প্রতিদ্বন্দ্বী বলেই মনে করে। দু’দেশের মধ্যে এই ধরনের বিরাজমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে চীনের প্রভাব-প্রতিপত্তির নিয়ন্ত্রণে আমেরিকার চোখে ভারত প্রতিরোধের এক শক্তি হয়ে উঠতে পারে। চীন সম্পর্কে ভারতের বৈরিতাকে বাড়িয়ে তোলা এবং চীনকে বিপদ জ্ঞান করে সেই বিষয়ে সহমত গড়ে তোলাটাও মার্কিনের এক অভিপ্রায়। এবারের মার্কিন সফরে মোদী এই বিষয়ে ইতিবাচক সাড়াই দিয়েছেন।

আমেরিকা চারটে দেশকে নিয়ে কোয়াড নামে একটা জোট বানিয়েছে, আমেরিকা ছাড়া জোটের অন্য সদস্যরা হলো ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও জাপান। চরিত্রগত ভাবে এটা একটা সামরিক জোট যার ঘোষিত লক্ষ্য ‘ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয়’ অঞ্চলে চীনের প্রভাবের মোকাবিলা করা। মার্কিন কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে বাইডেন তাঁর ভাষণে বললেন, “ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে মুক্ত, অবাধ, নিরাপদ এবং সমৃদ্ধশালী হিসাবে গড়ে তুলতে” আমেরিকা ভারতের সহযোগিতায় কোয়াড জোট তৈরি করেছে। এরসাথে সুর মিলিয়ে মোদী অধিবেশনে তাঁর বক্তৃতায় বললেন, “এই অঞ্চলকে ঘিরে তৈরি হয়েছে সংঘাত ও বলপ্রয়োগের মেঘ। এখানের সুস্থিতি আমাদের সম্পর্কের মূল উদ্বেগগুলির একটি।… কারও একচেটিয়া আধিপত্যকে আমরা স্বীকার করি না।” কোয়াড নিয়ে আমেরিকার দৃষ্টিভঙ্গি ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে মিলে যাওয়া মোদীর চীন-বিরোধী এই বচন বাইডেন ও মার্কিন কংগ্রেসের অন্য সদস্যদের কানে নিশ্চয় অমৃতবর্ষণ করেছিল!

গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে আমেরিকা যে দ্বিচারিতায় সিদ্ধহস্ত, মোদীর মার্কিন সফর তাকে আরও একবার প্রতিপন্ন করল। যে রাষ্ট্রগুলো আমেরিকার বশ্য হতে অস্বীকার করে, তাদের ওপর অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিতে মার্কিনের হাতিয়ার হয় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার। কিন্তু রাষ্ট্র মার্কিনের অনুগত হলে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের হাজারো পীড়ন ও নিয়ন্ত্রণকে দেখা হয় উপেক্ষার চোখে। দেশদ্রোহ ও ইউএপিএ আইনের নির্বিচার প্রয়োগ বিরোধী স্বরের কেমন কণ্ঠরোধ করছে, সরকার তার সমালোচকদের কিভাবে জেলে পুরছে, ভারতবাসী তার ভুক্তভোগী। আর এই ইতিহাস বিশ্বের কাছেও অবিদিত নয়। মার্কিন কংগ্রেসের ৭৫ জন সাংসদ প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কাছে চিঠি লিখে জানালেন — তিনি যেন ভারতে মানবাধিকার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, বহুত্বর ওপর আক্রমণের বিষয়গুলো মোদীর কাছে তুলে ধরেন। আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ওবামা বললেন, “আমার যুক্তি হল, ভারতে যদি এমনকি সংখ্যালঘুদের রক্ষা করা না হয় তাহলে সে দেশ ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে পারে। অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ যদি বিরাট আকার ধারণ করে, তাহলে কী হতে পারে তা আমরা দেখছি।” ওবামার এই বিবৃতির উৎস সম্ভবত মণিপুরে ঘটে চলা দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে চলমান সংঘাত ও তার পরিণামে মর্মান্তিক বিপর্যয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদে দু’বার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা প্রগতিবাদী প্রার্থী বার্ণি স্যান্ডার্সও বললেন, “প্রধানমন্ত্রী মোদীর সরকার সংবাদমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের ওপর দমন নামিয়েছে, রাজনৈতিক বিরোধীদের জেলে পুরছে, এবং আগ্রাসি হিন্দু জাতীয়তাবাদকে উস্কিয়ে তুলেছে যা ভারতের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য কোনো পরিসর রাখেনি। মোদীর সঙ্গে বৈঠকে প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে এই বিষয়গুলো তুলতে হবে।” ভারতে গণতন্ত্রের এই নিকৃষ্ট পরিস্থিতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে কয়েকজন মার্কিন সাংসদ কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশন বয়কট করেন। তাদের অন্যতম রাশিদা তালেব বললেন, “মানবাধিকার লঙ্ঘন, গণতন্ত্র বিরোধিতার দীর্ঘ ইতিহাস যাঁর রয়েছে, আমাদের দেশের রাজধানীতে সেই মোদীকে একটা মঞ্চ দেওয়া হয়েছে। এটা অত্যন্ত লজ্জার।” হোয়াইট হাউসের বাইরেও মোদী বিরোধী প্রতিবাদ সংগঠিত হতে দেখা গেছে এবং বিক্ষোভ প্রদর্শনকারীদের হাতে ধরা প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল — মোদী ভারতকে নাৎসি দেশ বানিয়ে তুলেছেন। কিন্তু যাঁর কাছে এই সমস্ত আবেদন হয়েছিল, সেই মার্কিন রাষ্ট্রপতি বাইডেনের কাছে কি বিষয়গুলো আদৌ গুরুত্ব পেয়েছিল?

মোদী তাঁর ন’বছরের শাসনে ভারতে কোনো সাংবাদিক সম্মেলন করেননি। কিন্তু যেকোনো কারণে বা চাপেই হোক, ইচ্ছা না থাকলেও তাঁকে দুই সাংবাদিকের কাছ থেকে প্রশ্ন নিতে হয়েছিল। গণতন্ত্রের সংকট প্রসঙ্গে প্রশ্নের জবাবে মোদী বলেন, “ভারতের ধমনীতে প্রবাহিত হচ্ছে গণতন্ত্র। ভারত বাঁচে গণতন্ত্রে। পূর্বসূরীরা গণতন্ত্রের বয়ানেই লিখেছিলেন সংবিধান। মোদী সরকারও গণতন্ত্রেরই উপাসক। জাতি ধর্মের কোনও বৈষম্য সেখানে নেই।” ভারতে প্রতিদিনই যা ঘটে চলেছে এই উক্তিতে তার সম্পূর্ণ বিপরীত উপস্থাপনা। এর হাজারো দৃষ্টান্ত রয়েছে, মুসলিম নিগ্ৰহের একেবারে হালফিলের একটা নিদর্শন উল্লেখ করা যাক। গত ২৫ জুন কাশ্মীরের পুলওয়ামার একটা মসজিদে ঢুকে রাষ্ট্রীয় রাইফেলসের জওয়ানরা সেখানে উপস্থিত উপাসকদের বন্দুকের ডগায় ‘জয় শ্রী রাম’ বলতে বাধ্য করলেন। গণতন্ত্র ছাড়া মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিরোধী ও প্রতিবাদী কণ্ঠের দমন নিয়ে প্রশ্নের কোনো উত্তরই মোদী দিলেন না।

মোদী সফরে অর্থনৈতিক দিক থেকে কয়েকটা চুক্তি আমেরিকার সঙ্গে হয়েছে। এরমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ দুটো চুক্তির মধ্যে একটা হল, ভারত আমেরিকার কাছ থেকে ৩১টা হানাদার ড্রোন কিনবে যার মূল্য হবে ৩.১ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ, প্রতিটি ড্রোনের ক্রয়মূল্য হবে ১১০ মিলিয়ন ডলার। অথচ, প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যাচ্ছে, জেনারেল অ্যাটোমিক্স কোম্পানির তৈরি এই ড্রোন মার্কিন সরকার বাজার থেকে প্রতিটি কেনে ৫৬.৫ মিলিয়ন ডলারে। এইভাবে বাজারের দামের থেকে অনেক বেশি দামে এই ড্রোন ভারতকে মার্কিন সরকারের কাছ থেকে কিনতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিপুল লাভের বিনিময়ে ভারত সরকারের তহবিলের নয়ছয় ছাড়া এটাকে অন্য কিছু কী বলা যায়। এছাড়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেল ইলেক্ট্রিক কোম্পানি হিন্দুস্থান অ্যারোনটিক্স লিমিটেডের সঙ্গে যৌথভাবে ভারতে যুদ্ধ বিমানের জেট ইঞ্জিন তৈরি করবে। চীনের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার প্রযুক্তিতে ভারতকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যও এরমধ্যে রয়েছে বলে অনেক বিশেষজ্ঞের অভিমত।

বাইডেন বলেছিলেন, “গণতন্ত্র ও স্বৈরাচারের মধ্যে লড়াই” হবে তাঁর জমানার নির্ধারক বৈশিষ্ট্য। কিন্তু মোদীকে লাল কার্পেট বিছিয়ে তিনি জানিয়ে দিলেন, আমেরিকার আধিপত্যবাদী রণনৈতিক স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতে সেটা একেবারেই অন্তঃসারশূন্য বাগজাল। ভারতের গণতন্ত্র নিয়ে, গণতন্ত্রের প্রতি তাঁর সরকারের নিষ্ঠা নিয়ে মার্কিন কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে মোদী যে মিথ্যাচার করলেন, বাইডেনদের কাছে সেটাই শিরোধার্য হল। মোদী যখন বললেন যে, “দিল্লী ও ওয়াশিংটনের মধ্যে সম্পর্ক আগের তুলনায় এখন অনেক বেশি শক্তিশালী ও গভীর”, সেই সম্পর্কে নিহিত উপাদানগুলো হলো প্রভুত্বকামী মার্কিন বিদেশ নীতির প্রতি মোদী সরকারের আনুগত্য, চীনকে নিয়ন্ত্রণের পারস্পরিক অভিপ্রায়। বিশ্বে শান্তি স্থাপন ও দারিদ্র্য মোচনের কোনো অভিলাষ ঐ ‘শক্তিশালী ও গভীর’ সম্পর্ককে প্রণোদিত করেনি। অতএব, ট্রাম্প বা বাইডেন, মার্কিন রাষ্ট্রের শীর্ষে যাঁরাই থাকুন না কেন, বিশ্বে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে চালিত মার্কিন বিদেশ নীতির স্বার্থে নরেন্দ্র মোদীর মতো গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিধনকারী ও স্বৈরাচারী রাষ্ট্র প্রধানরা তাঁদের কাছে সর্বদাই স্বাগত!

খণ্ড-30
সংখ্যা-21