পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রাক্কালে চাষের লাভক্ষতি সংক্রান্ত কিছু খোঁজখবর
on-the-eve-of-panchayat-elections-some-inquiries-

পঞ্চায়েত নির্বাচন এসে গেল। আগামী দিনগুলোতে রাজ্য রাজনীতি এই নিয়ে সরগরম থাকবে৷ একদিকে যেমন রাজনৈতিক চাপান-উতোর চলবে, তেমনি বাহুবলের আস্ফালনের খবরে যে সংবাদমাধ্যম ভরে থাকবে, তা নিয়েও কোনও সন্দেহ নেই। আশঙ্কাকে সত্যি প্রমাণ করে ভোট ঘোষণা হতে না হতেই মারামারি এমনকী প্রাণহানির ঘটনাও ঘটতে শুরু করে দিয়েছে এরমধ্যেই।

এইসব গরম খবরে আলোড়িত হতে হতে কিছু জরুরি প্রসঙ্গের দিকে তেমন করে নজর দেওয়া হয় না। অথচ রাজ্যের স্বার্থে, বৃহত্তর সমাজ ও সুস্থ রাজনীতির স্বার্থে নজর দেওয়া দরকার৷

অকৃষি অর্থনীতির প্রভূত বিকাশ সত্ত্বেও আমাদের দেশ তথা রাজ্যের গ্রামীণ অংশ এখনো মূলত কৃষিনির্ভর৷ একজন কৃষক অবশ্য শুধুই চাষের কাজ করেন তা নয়। দেখা যাবে যিনি ধানের মরসুমে ধানের চাষ করছেন, তিনিই হয়তো অন্য সময়ে গ্রাম লাগোয়া শহরে যাচ্ছেন দিনমজুরির কাজ করতে। যিনি মূলত দিনমজুরি করেন নানা জায়গায়, দেখা যাবে তিনিও হয়তো ধানের মরসুমে প্রতিবেশীর জোতে ক্ষেতমজুর হিসেবে কাজ করছেন কটা দিন। প্রান্তিক কৃষক নিজের জমিতে যেমন খাটেন, তেমনি অন্যের জমিতে বা অন্য কাজে শ্রম দিয়ে আয়ের চেষ্টা করেন বলেই তিনি প্রান্তিক কৃষক। আবার মধ্য কৃষক নিজের জমিতে চাষের জন্য নিজে শ্রম দেন আবার শ্রমশক্তি কেনেনও কিছু পরিমাণে। ধনী চাষি অবশ্য নিজে চাষে অল্প শ্রম দেন বা দেন না। শ্রমশক্তি কিনেই তার জমির চাষবাস হয়।

অর্থাৎ চাষের কাজ এখনো গ্রামে মজুরি শ্রমিকের একটা আয়ের বড় জায়গা। এই মজুরিটা কতটা হবে তা নির্ভর করে চাষের লাভ লোকসানের ওপর। আজকের পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ অর্থনীতি বুঝতে, গ্রামের মানুষ কেমন আছেন তা জানতে চাষের লাভ-ক্ষতি ও কৃষি অকৃষি আয় নিয়ে সাম্প্রতিক গবেষণা কী তথ্য তুলে আনছে সে দিকে চোখ রাখা যেতে পারে।

ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলিতে কিছুদিন আগে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের কৃষি-চিত্র সম্পর্কে। রথীন্দ্রনাথ প্রামাণিক সেই গবেষণা নিবন্ধে চারটি জেলার ওপর করা এক সমীক্ষার ভিত্তিতে এমন কিছু বিষয় আমাদের সামনে নিয়ে এসেছেন, যা বেশ মনযোগ দাবি করে। এই সমীক্ষা করা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের চারটি জেলার কয়েকটি ব্লকে। জেলাগুলির মধ্যে আছে উত্তরবঙ্গের উত্তর দিনাজপুর ও জলপাইগুড়ি, দক্ষিণবঙ্গের বর্ধমান ও পুরুলিয়া। দু’টি জেলা — উত্তর দিনাজপুর ও বর্ধমান অগ্রণী কৃষি জেলা। অপর দু’টি জলপাইগুড়ি ও পুরুলিয়া কৃষিতে পিছিয়ে থাকা। এই চারটি জেলায় করা সমীক্ষা থেকে বোঝার চেষ্টা করা হয়েছিল কৃষি থেকে আয় কেমন হচ্ছে, কৃষকদের স্বচ্ছলতা আর দারিদ্র কেমন, পারিবারিক আয়ের মধ্যে কৃষি ও অকৃষি বিভিন্ন দিকের অনুপাত কেমন ইত্যাদি। বিভিন্ন ফসল চাষের আনুপাতিক লাভ লোকসানের হিসাবও নিতে চেয়েছে এই সমীক্ষা।

দেখা যাচ্ছে যে এইসব জেলায় প্রধান যে সব জিনিসের চাষ হয় তার মধ্যে আছে ধান, গম, পাট, বিভিন্ন রকমের ডাল, আলু, শাকসবজি ও ফল। দেখা যাচ্ছে যে শাকসব্জি ও ফল ছাড়া অন্যান্য চাষে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হচ্ছে অনেকক্ষেত্রে এবং ক্ষতির বহর এতই বেশি মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে এত ক্ষতির মুখোমুখি হওয়া চাষাবাদের ভবিষ্যৎ কেমন। বেশিরভাগ গ্রামীণ পরিবারের আয়ের বড় অংশই এখন আসে অকৃষি বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে। সমীক্ষা করা জেলাগুলিতে দেখা যাচ্ছে যে গ্রামীণ পরিবারগুলির মাসিক গড় আয় ৮,২৭০ টাকা। এরমধ্যে চাষবাস থেকে আসে ২,৪৮৭ টাকা মতো। যা সামগ্রিক আয়ের মাত্র ৩০ শতাংশ। এরমধ্যে ফসলের চাষ থেকে আসে ২৪ শতাংশ, পশুপালন থেকে ৫ শতাংশ আর ফলমূল শাকসব্জী ইত্যাদি অন্যান্য চাষ থেকে আসে ১ শতাংশ।

আয়ের বেশিরভাগটাই আসে নানারকম ভাতা ও মজুরি বা মাইনে থেকে। প্রায় ৪৬ শতাংশ আয়ের উৎস এই মজুরি বা ভাতা। ব্যবসা থেকে আসে ১৮ শতাংশ আয়। অন্যান্য উৎস থেকে আসে ৬ শতাংশ।

চাষ থেকে আয়ের ক্ষেত্রে ওপরে একটা গড়পড়তা হিসেব দেওয়া হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় কিন্তু চাষ থেকে আয়ের ব্যাপারটি কিন্তু একরকম নয়। যেমন উত্তর দিনাজপুর আর বর্ধমানের চাষিরা আয়ের জন্য খাদ্যশস্যর চাষের ওপর বেশি নির্ভর করেন, শাকসব্জি চাষের ওপর জলপাইগুড়িতে নির্ভরতা বেশি। আবার পুরুলিয়াতে পশুপালনের ওপর নির্ভরশীলতা বেশি।

কৃষক পরিবারের আয়ের অনুপাত চাষের জমির পরিমাণের ওপর অনেকটাই নির্ভর করে। প্রান্তিক কৃষক পরিবার যাদের জমির পরিমাণ খুব কম, তাদের পারিবারিক মাসিক আয়ের ৮৬ শতাংশই আসে অকৃষি উৎস থেকে। মাঝারি পরিমাণ জমি যাদের আছে, তাদের পারিবারিক মাসিক আয়ের ৬৩ শতাংশ আসে অকৃষি উৎস থেকে। জমির পরিমাণ সংক্রান্ত তথ্যও এই সমীক্ষা থেকে উঠে এসেছে। দেখা যাচ্ছে ৭৭ শতাংশ পরিবারই প্রান্তিক চাষি। তাদের জমির পরিমাণ ১ হেক্টর বা সাড়ে সাত বিঘারও কম। যাদের থেকে ১ থেকে ২ হেক্টর জমি আছে, সেইরকম ছোট চাষি মোট কৃষকের ১৮.৭৫ শতাংশ। মধ্য কৃষক, যাদের জমির পরিমাণ ৪ থেকে ১০ হেক্টর তারা ৩.৩ শতাংশ আর বড় কৃষক, যাদের জমির পরিমাণ ১০ হেক্টর বা ৭৫ বিঘার বেশি, তারাও মোট কৃষকের ৩.৩ শতাংশ।

শুধু যে জমির পরিমাণের ওপর কৃষি ও অকৃষি আয়ের অনুপাতই বদলে যায় তা নয়। সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে অকৃষি আয়ের একটি প্যাটার্ন বা ধারাও জমির পরিমাণের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। মধ্য বা ধনী চাষি পরিবারগুলির অকৃষি আয়ের উৎস হল ব্যবসা, পরিবহণ, দোকানদারি বা চাকরি। অন্যদিকে প্রান্তিক ও ছোট পরিবারগুলির অকৃষি আয়ের উৎস হল বিভিন্ন ধরনের ঠিকা কাজ।

তবে চাষ থেকে আয় যেভাবে দ্রুত হারে কমছে, তাতে সব ধরনের গ্রামীণ পরিবারই ক্রমশ বেশি বেশি করে বিভিন্ন অকৃষি কাজের দিকে ঝুঁকছেন। কৃষির অলাভজনক হয়ে পড়ার আতঙ্কজনক তথ্য এই সমীক্ষা থেকে উঠে এসেছে।

প্রতি হেক্টর (সাড়ে সাত বিঘা) জমি চাষ করে কোন ফসলে কতটা লাভ ক্ষতি হচ্ছে আর জেলাভিত্তিক এই ছবিটা কীভাবে বদলে বদলে যাচ্ছে — সেই হিসাবটা দেখা যাক। বর্ধমানে একর প্রতি ধান চাষে লাভ ৫,৬৪৪ টাকা আর উত্তর দিনাজপুরে সেটা ৩,৭১৮ টাকা। আবার ধান চাষে লাভের বদলে ক্ষতি হচ্ছে জলপাইগুড়ি ও পুরুলিয়া জেলায়। জলপাইগুড়িতে হেক্টর প্রতি ক্ষতি ১,৮৮২ টাকা আর পুরুলিয়ায় এটা হেক্টর প্রতি ৪,১৩৩ টাকা। আলু চাষে বর্ধমানে হেক্টর প্রতি লাভ ১২,৮৯৪ টাকা। কিন্তু উত্তর দিনাজপুর, পুরুলিয়া, জলপাইগুড়ি — সর্বত্রই আলু চাষিরা ব্যাপক লোকসানের মুখোমুখি হয়েছেন। হেক্টর প্রতি আলু চাষে উত্তর দিনাজপুরে ৫৪,৩১৮ টাকা ক্ষতি হয়েছে, পুরুলিয়াতে হয়েছে ৬১,৩৬৫ টাকা আর জলপাইগুড়িতে ৬২,৩৬৪ টাকা। গম, ডাল, তৈলবীজ বা পাট চাষেও সর্বত্রই হয় ক্ষতি হয়েছে বা সামান্য লাভ হয়েছে, পরিশ্রমেরও দাম মেলেনি।

কেবল ফল ও শাকসব্জি চাষ চাষিকে সর্বত্রই লাভের মুখ দেখিয়েছে। উত্তর দিনাজপুরে এই ধরনের চাষের তথ্য নেই। বর্ধমানে এই চাষে লাভ হেক্টর প্রতি ১,৭৮,৭৫৮ টাকা, পুরুলিয়াতে ২৫,২২৪ টাকা আর জলপাইগুড়িতে ১,৯৩,৮৬০ টাকা। তবে খুব সামান্য জমিতেই এইসব চাষ হয়, তাই সামগ্রিকভাবে ম্লান কৃষি-চিত্রকে এই পরিসংখ্যান উজ্জ্বল করতে পারে না।

চাষ কেন লাভজনক নয়, কেন এতে ক্ষতি — সেই নিয়ে এই গবেষণাপত্রে কিছু পর্যবেক্ষণ রয়েছে। মূলত ১৯৯০’র পর থেকে চাষের ক্ষেত্রে মন্দা দেখা গেছে। নয়া আর্থিক নীতিমালার সঙ্গে এর সরাসরি সম্পর্ক আছে। যেভাবে কৃষিতে রাষ্ট্রীয় ব্যয়বরাদ্দ কমেছে, বিভিন্ন ভর্তুকি তুলে নেওয়া হয়েছে, বিভিন্ন পরিকাঠামোগত সুযোগ সুবিধে অপ্রতুল হয়েছে, কৃষিপণ্যর সরকারি খরিদ কমেছে, সরকারী ঋণের সুবিধে কমে চড়া সুদের মহাজনী ঋণের ফাঁদে চাষি নতুন করে আবদ্ধ হয়েছে — তা কৃষির ক্ষেত্রে বিরাট সঙ্কট ডেকে এনেছে। কৃষির সঙ্কটমোচনের প্রশ্নটি তাই নীতি বদলের লড়াইয়ের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত।

পঞ্চায়েত নির্বাচনে আমাদের প্রচারে দুর্নীতি, সাম্প্রদায়িকতা, ফ্যাসিবাদী ও স্বৈরতান্ত্রিক আগ্রাসনের নানা জ্বলন্ত ও দৈনন্দিন সমস্যাগুলি তো আসবেই। তার পাশাপাশি খুব গুরুত্বপূর্ণ ভাবেই আনা দরকার চাষের অলাভজনক হয়ে পড়া ও তার সমাধান হিসেবে সরকারী নীতি বদলের দিকটিকেও।

- সৌভিক ঘোষাল

খণ্ড-30
সংখ্যা-19