কর্পোরেট লুঠ আর সাম্প্রদায়িক বিষের জোড়া ব্যাধি থেকে ভারতীয় অর্থনীতিকে উদ্ধার করুন
corporate-loot-and-communal-venom

২০১৪ থেকে আমরা বিজেপির নির্বাচনী সভা সমাবেশে প্রায়ই একটা কথা শুনি, ‘ডবল ইঞ্জিন সরকার’। মোদী-শাহ’র এটা সবচেয়ে পছন্দের এক উপমা। কেন্দ্রের ক্ষমতা বিজেপির নিয়ন্ত্রণে। তার ভিত্তিতেই তাই রাজ্যে ভোট চাইতে গিয়ে এই শব্দবন্ধ তারা হরদম ব্যবহার করেন। এবার অর্থনীতির বর্ণনা দিতে গিয়ে মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা বিমান চালনা সংক্রান্ত একটা শব্দের আমদানি করেছেন। সিইএ ভি অনন্ত নাগেশ্বরনের মতে ভারতীয় অর্থনীতি এখন ‘অটো-পাইলট মোডে’ আছে এবং ২০৩০ পর্যন্ত ৬.৫-৭ শতাংশ হারে অর্থনীতির বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে! মোদী সরকারের নয় বছরের বেশিরভাগ সময়েই আমরা দেখেছি, অর্থনৈতিক বৃদ্ধি থমকে গেছে এবং মুখ থুবড়ে পড়েছে। বিমুদ্রাকরণ, জিএসটি ও লকডাউনের তিন ধাক্কায় এবং বেসরকারিকরণ, কর্মীসংকোচন ও ঠিকাপ্রথার নীতির জন্য বেকারত্ব এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি সর্বকালীন রেকর্ড ছাড়িয়েছে। কিন্তু এখন চূড়ান্ত গুরুত্বপূর্ণ লোকসভা নির্বাচনের আগে আমাদের বলা হচ্ছে, অর্থনীতি অটো-পাইলট মোডে নিরাপদে উড়ে চলেছে, সরকারের এখানে কিচ্ছুটি করার নেই!

আত্মপ্রশংসামূলক প্রচার সাধারণত দাঁড়িয়ে থাকে দু’টি খুঁটির উপর ভর দিয়ে — জিডিপি’তে পরিমিত বৃদ্ধির অস্থায়ী পরিসংখ্যান আর জিএসটি সংগ্রহের বৃদ্ধি। সংখ্যাগুলো এখনও অস্থায়ী। কিন্তু সরকার আর তার সুরে সুর মিলিয়ে চলা মিডিয়া ইতিমধ্যেই ঢাকে কাঠি দিয়ে ফেলেছে। প্রথম যে বিষয়টি আমাদের মনে রাখতে হবে, এখন যে ৬.৫-৭ শতাংশ বৃদ্ধির দাবি করা হচ্ছে, তার ঠিক আগে কোভিড অতিমারির সময়ে জিডিপি বিরাট মাত্রায় সংকুচিত হয়েছিল। তার মানে, ভারত এখন কেবল সেই অতিমারীর সময়কার পতনকে সামলে উঠছে। দ্বিতীয়ত, বর্তমান বৃদ্ধি এখনও স্থিতিশীল নয় বরং খুবই অসম। বিভিন্ন সেক্টরের দিকে চোখ ফেরালে দেখা যাবে এই বৃদ্ধি কেন্দ্রীভূত হয়েছে মাত্র তিনটি ক্ষেত্রে — পরিষেবা, নির্মাণ এবং পর্যটনে। আয় বন্ধনীর দিক থেকে উপরতলার ২০ শতাংশ বৃদ্ধিকে চালিত করছে আর নিচেরতলার ৮০ শতাংশ মানুষ ক্রমশ আরো দারিদ্র্যে ডুবে যাচ্ছে। আর্থিক পুনরুদ্ধারের এই অসম প্যাটার্নের সঙ্গে সাদৃশ্য আছে ইংরেজি বর্ণমালার কে অক্ষরটির সঙ্গে।

অক্সফ্যামের রিপোর্ট ‘ধনীদের বেঁচে থাকা’ (বোধ হয় ‘ধনীদের মহোৎসব’ নাম দিলে আরও ভালো হয়) আমাদের সামনে এই অসম বৃদ্ধির এক মারাত্মক ছবি এবছরের গোড়ায় তুলে ধরেছিল। বিলিয়নেয়ারদের সংখ্যা খাড়াভাবে বেড়ে ২০২০-তে ১০২ থেকে ২০২২-এ হয়েছে ১৬৬। ভারতে ২০১২ থেকে ২০২১ পর্যন্ত সৃষ্ট সম্পদের ৪০ শতাংশ কেন্দ্রীভূত হয়েছে জনসংখ্যার মাত্র এক শতাংশের হাতে। আর মাত্র তিন শতাংশ সম্পদ রয়েছে নিচের তলার ৫০ শতাংশ মানুষের হাতে। ব্যক্তিগত ভোগব্যয়, বিশেষ করে অত্যাবশ্যক পণ্য ও পরিষেবার গণ উপভোগ স্তরের আগের অবস্থায় ফেরা সম্ভব হয়নি মানুষের আয় কমে যাওয়া এবং ক্রয়ক্ষমতার ক্ষয়ের জন্য। দু’চাকার গাড়ি এবং এন্ট্রি লেভেল যাত্রীবাহী গাড়ির বিক্রি কমে গেছে কিন্তু ব্যয়বহুল গাড়ি ও অন্যান্য বিলাসবহুল ভোগসামগ্রীর বিক্রি বেড়ে গেছে।

সম্পদ বন্টনের চূড়ান্ত অসম ব্যবস্থাটি আরও জোরালো করে তুলেছে বিত্তবানদের অনুকূল কর ব্যবস্থা ও ব্যাঙ্ক পরিষেবা। ভারতে কোনো সম্পদ বা উত্তরাধিকার কর নেই, ওদিকে কার্যকর কর্পোরেট করের হার ক্রমশ কমছে। ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা ক্রমাগত আরও বেশি করে ধনীদের স্বার্থে চালিত হচ্ছে। বড় বড় ঋণ খেলাপী, ঋণ ‘রাইট অফ’ বা মুছে ফেলা, এবং সমস্ত বেল আউট প্যাকেজ ব্যাঙ্ক ব্যবস্থাটাকে অতি-ধনীদের হাতে সমস্ত সম্পদ কেন্দ্রীভূত করার এক হাতিয়ারে রূপান্তরিত করেছে। ব্যক্তিগত লাভের জন্য জনসাধারণের টাকার কীরকম অপব্যবহার হয়, আদানি গোষ্ঠীর উত্থান ও সংকট তার এক ‘চোখ খুলে দেওয়া’ দৃষ্টান্ত। আদানি গোষ্ঠীর ঝড়ের গতিতে নজর কাড়া উত্থানের নেপথ্যে রয়েছে সমান্তরাল আরেক প্রক্রিয়া — ভারতের পরিকাঠামোগত সম্পদের নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাত থেকে আদানি গোষ্ঠীর হাতে চলে যাওয়া! আর এখন, হিন্ডেনবার্গের রিপোর্টে আদানি গোষ্ঠী রীতিমত ধরাশায়ী হওয়ার পর, আমাদের আবারও সাক্ষী থাকতে হল আরেক কলঙ্কজনক ঘটনার — এলআইসিআই এবং এসবিআই’এর মত সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বলি দেওয়া হল আদানি গোষ্ঠীকে বাঁচাতে!

ভারত যখন অনেক বড় বড় অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, মোদী সরকার কঠোর অর্থনৈতিক বাস্তবতাকে একেবারে ঝেড়ে ফেলতে পারছে না। তাই, ভারত জুড়ে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণকে তীক্ষ্ণতর করে এবং সংখ্যালঘুদের ‘বলির পাঁঠা’ বানিয়ে, সেই বাস্তব সত্যকে চাপা দিতে চাইছে। বিহারে ‘হিন্দুরাষ্ট্রের’ প্রচার চালানোর জন্য এক ‘অলৌকিক বাবার’ আমদানি হয়েছিল। মহারাষ্ট্রে মুসলিম-বিরোধী হিংসাকে ইন্ধন যোগাতে টিপু সুলতান এবং অওরঙ্গজেবের মত ঐতিহাসিক চরিত্র দু’টিকে কলঙ্কিত করা হচ্ছে। এমনকি এনসিপি নেতা শরদ পাওয়ারকে ‘নব কলেবরে অওরঙ্গজেব’ বলে কুৎসা ও অপমান করা হচ্ছে। উত্তরাখণ্ড, যেখানে বিজেপি সরকারকে যোশীমঠ সংকট, চাকরি-প্রতারণা ও অঙ্কিতা ভাণ্ডারী নামে এক তরুণীর নৃশংস হত্যা — এসবের জন্য জনসাধারণের ঘৃণা ও রোষের মুখে পড়তে হচ্ছে, সেখানে সঙ্ঘ বাহিনী পুরো মাত্রায় জাতিগত নিধনের আশ্রয় নিয়েছে। মুসলিমদের দোকান পাট বন্ধ করে দেওয়া ও তাদের তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য হিংস্র প্রচার চালাচ্ছে, ‘লাভ জিহাদ’ আর ‘জমি জিহাদ’এর উৎপাতকে নতুন করে চাঙ্গা করে তুলছে আর ‘দেবভূমি’কে তথাকথিত ‘জিহাদীদের’ হাত থেকে বাঁচানোর ডাক দিচ্ছে। শুধু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সৌভ্রাত্রকেই ধ্বংস করছে না এই বিষাক্ত রাজনীতি, ভারতের অর্থনৈতিক সংকটকেও ঘনীভূত করে তুলছে এবং সাংবিধানিক প্রজাতন্ত্র হিসাবে ভারতের জাতীয় ঐক্য ও স্থিতিশীলতাকে বিপন্ন করে তুলছে। কর্ণাটক গত মে মাসের নির্বাচনে এই ছককে পরাস্ত করেছিল। গোটা ভারতকে আজ এই ফ্যাসিবাদী অ্যাজেন্ডাকে পরাস্ত করার জন্য তৈরি থাকতে হবে।

- এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ১৯ জুন ২০২৩

খণ্ড-30
সংখ্যা-20