মণিপুরের এখন যা প্রয়োজন
needs-now

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং মণিপুরের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং দাবি করেছেন যে ১৩ জুন থেকে মণিপুরে জীবনহানির কোনো ঘটনা ঘটেনি। এটা কিন্তু মণিপুর শান্ত হওয়ার কোনো নির্দেশক নয়। জীবনহানি না ঘটলেও হিংসা শুরু হওয়ার পর ৫৫ দিন পেরিয়ে গেলেও একের পর এক সহিংস ঘটনা ঘটেই চলেছে। এবং মণিপুরের অশান্ত পরিমণ্ডলের কেন্দ্রে রয়েছে মেইতেই জনগোষ্ঠী ও কুকি জনজাতির মধ্যে যে সংঘাত, সেই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাস ফিরে আসার কোনো লক্ষণই চোখে পড়ছে না। নরেন্দ্র মোদী তো মণিপুরের সংকট নিয়ে আজ পর্যন্ত একটা শব্দও উচ্চারণ করেননি। অমিত শাহ ও বীরেন সিং’দের কাছেও ঐ রাজ্যের পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করে তোলার কোনো উপায় আছে বলে দেখা যাচ্ছে না।

মণিপুর সংকটের সমাধান অধরা থেকে যাওয়ায় এবং মণিপুর নিয়ে সর্বস্তরে প্রশ্ন উঠতে থাকায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ গত ২৪ জুন দিল্লীতে সর্বদলীয় বৈঠক ডাকেন। সেই বৈঠক থেকে কোনো সমাধান সূত্র বেরোয় নি, বরং প্রশ্ন ওঠে — নরেন্দ্র মোদী যখন বিদেশ সফরে তখন এই বৈঠক ডাকা হল কেন। নরেন্দ্র মোদীকে অপ্রীতিকর প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া থেকে রেহাই দেওয়ার জন্যই কি তাঁর অনুপস্থিতিতে এই বৈঠকের আয়োজন? ঐ বৈঠক থেকে দাবি উঠল সর্বদলের প্রতিনিধিদের ইম্ফলে যেতে দিতে হবে। আরও বলা হলো যে, মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী শুধু পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করতেই ব্যর্থ নন, তাঁর মেইতেইপন্থী মানসিকতা রাজ্যের সমস্ত জনগোষ্ঠীর মুখ্যমন্ত্রী হওয়া থেকে তাঁকে বিচ্যুত করেছে। অতএব, মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বীরেন সিং থাকলে সমাধানের সন্ধান দুরাশা হয়েই থেকে যাবে।

মেইতেই ও কুকিদের পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতা কতটা গভীর আকার নিয়েছে তার বাস্তব প্রতিফলন ঘটেছে অরুণাভ সইকিয়ার লেখা, ‘রিপোর্টারের ডায়েরিঃ আমি দু’পক্ষের মধ্যবর্তী এলাকা পেরোলাম’ শীর্ষক নিবন্ধে। ঐ নিবন্ধে তিনি জানাচ্ছেন, ইম্ফলে কোনো কুকি আর নেই, পার্বত্য এলাকাতেও নেই কোনো মেইতেই মানুষ। যার যার পরিচিতির যে অঞ্চল সেখানে তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে — পার্বত্য অঞ্চলের মেইতেইদের ইম্ফলে এবং ইম্ফলে থাকা কুকিদের পার্বত্য জেলায়। এটাই নাকি শান্তি প্রক্রিয়ার ইতিবাচক পদক্ষেপ! তাঁর নিবন্ধ জানাচ্ছে, “সচিবালয় থেকে থানা, সমস্ত স্থানেই রয়েছে খালি চেয়ার। মানুষের দল ব্যাঙ্কগুলোতে ভিড় করে জানতে চাইছেন এক শাখা থেকে আর এক শাখায় অ্যাকাউন্ট বদলের প্রক্রিয়াটা কী।” খালি চেয়ারগুলো যে স্থানান্তরে চলে যেতে বাধ্য হওয়া কুকি কর্মীদের তা বোধহয় না বললেও চলবে। তিনি আরও জানিয়েছেন, কুকি কর্মী না থাকায় ৩ মে থেকে সরকারি বেতারে কুকি ভাষায় কোনো সম্প্রচার সম্ভব হয়নি।

what-manipur-needs-now_0

মোদী মণিপুর নিয়ে মুখে কুলুপ আঁটলেও আরএসএস কিন্তু মণিপুর পরিস্থিতি নিয়ে তাদের অভিমত জানিয়েছে। আরএসএস নেতা দত্তাত্রেয় হোসবালে তাঁর সাম্প্রতিক এক বিবৃতিতে বলেছেন, “গত ৪৫ দিন ধরে মণিপুরে যে হিংসা চলছে তা অত্যন্ত উদ্বেগের। লাল হারাওবা উৎসব চলার সময় ৩ মে ২০২৩ চুড়াচাঁদপুরে সংগঠিত প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে মণিপুরে যে হিংসা ও অনিশ্চয়তার শুরু, তার নিন্দা করতে হবে।… বর্তমান সংকটের যে কারণ, অর্থাৎ প্রত্যেকের মধ্যে আস্থার অভাবকে কাটানোর আবেদন আরএসএস সবার কাছে জানাচ্ছে। এরজন্য প্রয়োজন উভয় সম্প্রদায়ের সর্বাঙ্গীণ প্রচেষ্টা।” এই বিবৃতির মধ্যে দিয়ে হোসবালে পরিস্থিতির অবনতির দায় কুকিদের ঘাড়েই চাপালেন। কুকি ও নাগারা চুড়াচাঁদপুরে ৩ মে প্রতিবাদ সংগঠিত করেছিল মেইতেইদের জনজাতির মর্যাদা দেওয়ার হাইকোর্টের সম্মতির বিরুদ্ধে। ঐ রায়ে মণিপুর হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি এম ভি মুরলীধরণ মেইতেইদের জনজাতির মর্যাদা দেওয়ার সুপারিশ কেন্দ্রের কাছে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন (সুপ্রিম কোর্ট অবশ্য বলেছে যে ঐ নির্দেশ দেওয়ার অধিকার হাইকোর্টের নেই)। এই রায়ের লক্ষ্য স্পষ্টতই ছিল কুকিদের সুবিধাকে খর্ব করা এবং মেইতেইদের অতিরিক্ত সুবিধা প্রদান। ঐ সংগঠিত প্রতিবাদের আগেই কিন্তু কুকি-বিরোধী পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছিল বীরেন সিং প্রশাসন। ২৬ এপ্রিল শুরু হয়েছিল বনাঞ্চল থেকে কুকিদের উচ্ছেদ অভিযান। বীরেন সিং নিজে মায়ানমার থেকে পার্বত্য অঞ্চলে অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে সংখ্যাগুরুবাদী আওয়াজ ওঠাচ্ছিলেন। সংখ্যায় খুব অল্প, মায়ানমার থেকে আসা সম্ভবত কয়েকশ মাত্র শরণার্থী কুকি জনজাতিদের সঙ্গে মৈত্রীতে আবদ্ধ। অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বলে দেগে দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে আস্ফালনের আসল লক্ষ্য ছিল কুকিরাই। কুকিদের মাদক চাষের অভিযোগেও অভিযুক্ত করা হচ্ছিল। কুকি জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে যে যুদ্ধবিরতি বলবৎ রয়েছে তাকে বাতিল করা, অর্থাৎ কুকিদের বিরুদ্ধে সেনা অভিযানের আওয়াজ ওঠাচ্ছিল মেইতেই সংখ্যাগুরুবাদী বাহিনী। এই সমস্ত কিছুকে বিবেচনায় নিয়ে গুয়াহাটির উত্তর-পূর্বাঞ্চল সামাজিক কেন্দ্রর ডিরেক্টর ওয়াল্টার ফার্নান্ডেজ তাঁর ‘অশান্তিতে পড়া এক ভূখণ্ড’ নিবন্ধে যথার্থভাবেই বলেছেন, “এই ঘটনাগুলো থেকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানোটা যুক্তিসঙ্গত হবে যে, এই সংঘাত ছিল সুপরিকল্পিত, তাতে অর্থ জুগিয়েছিল এবং তাকে নিখুঁতভাবে বাস্তবায়িত করেছিল ক্ষমতায় থাকা লোকজন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিরাপত্তা বাহিনী নীরব দর্শক হয়েই ছিল।… আদালতে মামলা, উচ্ছেদ, সংঘাত এবং আলোচনা ভেঙে পড়ার মধ্যে স্পষ্টতই সংযোগ রয়েছে।” অনেকের জানা থাকলেও এখানে এর উল্লেখ অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, মেইতেইরা হিন্দু ধর্ম অনুসরণ করে, আর কুকি-নাগারা হল খ্রিস্টান। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে চলমান সংঘর্ষে বিপর্যস্ত বেশি হয়েছে কুকিরাই। এখনও পর্যন্ত ১৩০’র বেশি নিহতের অধিকাংশই কুকি, তাদের বসবাসের ২০০টারও বেশি গ্রামে আগুন লাগানো হয়েছে, ৬০,০০০ বাস্তুচ্যুত ও শরণার্থী শিবিরে থাকাদের মধ্যে তারাই ব্যাপক সংখ্যাধিক, তাদের প্রায় ২৫০টা চার্চকেও পোড়ানো ও ধূলিসাৎ করা হয়েছে। এগুলো সম্পর্কে দত্তাত্রেয় হোসবালেরা কি আদৌ অবহিত নন? আর ঘৃণা ও বিদ্বেষের বিষোদগার অব্যাহত রেখে কি আস্থা-বিশ্বাস ফেরানো সম্ভব?

মণিপুর সংকটের সমাধানের লক্ষ্যে সেখানে যা চলছে তাকে গৃহযুদ্ধ বলে মেনে নিয়ে তার পিছনের কারণগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে। বহু সংস্কৃতির যে রাজ্য মণিপুর এবং যাকে ধ্বংসের চেষ্টা হয়েছে, সেই বহুত্বকে অবশ্যই ফিরিয়ে আনতে হবে। উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে আলোচনা ও বার্তালাপের পরিমণ্ডল সৃষ্টি করতে হবে। এরজন্য রাজ্য সরকারের নেতৃত্বে পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্নের কোনো অবকাশ থাকতে পারে না। অমিত শাহর সঙ্গে সর্বদলীয় বৈঠকে আরজেডি নেতা মনোজ ঝা সঠিকভাবেই বলেছেন, “সবাই এই ধারণার ওপর জোর দিয়েছেন যে, মণিপুরের প্রয়োজন উপশমের এক স্পর্শ, তার এমন এক মুখের দরকার যা ঐক্যবদ্ধ করবে এবং বিভেদ সৃষ্টির মুখ নয়।” অনেকে সমাধানের পথ হিসাবে সেনাশাসন এবং মণিপুরে আফস্পা বা সেনাবাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইনের প্রত্যাবর্তনের কথা বলছেন। ভারতীয় জনগণের অভিজ্ঞতায় আফস্পা’র ওপর ভর করা সেনাশাসন জনগণের চরম দুর্ভোগ ও বিপর্যয়ের কারণই হয়, মনোরমার ধর্ষণ ও হত্যা-সহ সেনা নির্যাতনের কয়েক হাজার ঘটনার সাক্ষী মণিপুর নিজেই। অতএব মণিপুর সমস্যা সমাধানের নির্ধারক শর্ত হতে হবে প্রশাসনের অলিন্দ থেকে সংখ্যাগুরুবাদী মানসিকতার বিসর্জন, সমস্ত সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের স্বীকৃতি, ঘৃণা-বিদ্বেষ বচনের পরিহার, সম্মান ও মর্যাদার পারস্পরিক প্রদান। এক কথায়, সংখ্যাগুরুবাদী বিদ্বেষ ও বিভাজনের আরএসএস এজেন্ডাকে ঝাড়ে-মূলে বিদায় জানানো। 

- জয়দীপ মিত্র

খণ্ড-30
সংখ্যা-21