মহিলা কুস্তিগিরদের আন্দোলন : এক উজ্জ্বল উদাহরণ
a-shining-example

ন্যায়বিচার লাভের লক্ষ্যে কুস্তি ফেডারেশনের অপসারিত প্রধান ব্রিজভূষণ শরণ সিং’এর গ্রেপ্তারির জন্য মহিলা কুস্তিগিররা কয়েকমাস ব্যাপী যে আন্দোলন চালিয়েছেন, আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না হলেও তার কার্যত সমাপ্তি ঘটেছে। কুস্তিগিররা রেল দপ্তরে তাঁদের কাজে যোগ দিয়েছেন এবং কেউ কেউ আসন্ন এশিয়ান গেমসে প্রতিযোগী হওয়ার যোগ্যতা অর্জনের লক্ষ্যে অনুশীলনেও নেমেছেন। ব্রিজভূষণ গ্রেপ্তার না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত রাখার যে অঙ্গীকার তাঁরা করেছিলেন, সেই আন্দোলন থেমে যাওয়ায় ন্যায়বিচার লাভের প্রক্রিয়ার কি সমাপ্তি ঘটল? ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে যৌন নিগ্ৰহের জোরালো ও বিশদ অভিযোগ দায়ের হলেও তিনি গ্রেপ্তারিকে এড়িয়ে যেতে পারলেন কেমন করে? গোড়ায় আমরা বরং এই দ্বিতীয় বিষয়টি নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করি, এই আন্দোলন কী প্রভাব রেখে গেল তার মূল্যায়নে বরং পরে আসা হবে।

দিল্লী পুলিশ প্রথমে কুস্তিগিরদের অভিযোগ নিতে না চাইলেও সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপে তারা ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে দুটি এফআইআর দায়ের করতে বাধ্য হয়। তারমধ্যে একটি ছিল পকসো আইনে এক নাবালিকার এবং অন্যটি ছিল ছয় প্রাপ্তবয়স্ক কুস্তিগিরের যৌন নিগ্ৰহ ঘটার অভিযোগ। পকসো আইনে অভিযোগ দায়ের হলে অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করাটাই রীতি, যাতে অভিযুক্ত অভিযোগকারী এবং সাক্ষীদের ওপর চাপ তৈরি করতে না পারে। পুলিশ কিন্তু ব্রিজভূষণকে গ্রেপ্তার করল না। মোদী সরকার, তার মন্ত্রী, পুলিশ ও প্রশাসন সবাই ন্যায় প্রদানের বিপরীতে অভিযুক্ত ব্রিজভূষণকে বাঁচাতেই সক্রিয় হলো। নাবালিকা ১০ মে ম্যাজিস্ট্রেটের সমনে তার বয়ানে বলেছিল, এক প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক জেতার পর একসাথে ছবি তোলার অছিলায় ব্রিজভূষণ তার যৌন হেনস্থা ঘটান। নিজের ঘরে নাবালিকাকে ডেকেও তার যৌন নিগ্ৰহে উদ্যত হন। ব্রিজভূষণকে গ্রেপ্তারের জন্য এই অভিযোগই যথেষ্ট ছিল। সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মদন বি লকুরও সম্প্রতি বলেছেন, “অনেক আগেই তাকে গ্রেপ্তার করা উচিত ছিল, কিন্তু সে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর বিবৃতি দিচ্ছে এবং তার ঘনিষ্ঠ লোকজন সাক্ষীদের হুমকি দিচ্ছে।” কিন্তু গ্রেপ্তার না করে সময় অতিবাহিত হতে দিয়ে পকসো আইন থেকে ব্রিজভূষণের নিস্তারের পথ খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল পুলিশ ও প্রশাসন। নাবালিকার দ্বারা যৌন নিগ্ৰহের অভিযোগের প্রত্যাহারই সেই কৌশল রূপে দেখা দিল। আর নাবালিকার বাবা ও তাদের পরিবারের ওপর চাপ সৃষ্টির মধ্যে দিয়েই তা সম্ভবপর হতে পারে। এবং হলোও তাই। নাবালিকার বাবা ৫ জুন আদালতে গিয়ে যৌন নিগ্ৰহের আগের বয়ানকে পাল্টালেন। বললেন, প্রতিযোগিতায় মেয়ের বিরুদ্ধে বৈষম্য করা হয়েছিল। কুস্তি রেফারি মেয়েকে পয়েন্ট দেননি, ফলে এক প্রতিযোগিতায় যোগদান তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাই ফেডারেশনের বিরুদ্ধে রাগের বশে তিনি যৌন নিগ্ৰহের অভিযোগ এনেছিলেন। তাঁর মেয়ের ওপর কোনো যৌন নিগ্ৰহ ঘটানো হয়নি।

পুলিশ তাদের অভিপ্রেত হাতিয়ার পেয়ে গেল। নাবালিকার বাবার পরিবর্তিত বয়ান নিয়ে তারা দৌড়ল পাতিয়ালা হাউস কোর্টে। সেখানে বলল, তাদের তদন্তে পকসো আইনে অভিযোগের কোনো সত্যতা তারা খুঁজে পায়নি! অতএব, ঐ অভিযোগকে বাতিল করা হোক। পুলিশের ডেপুটি কমিশনার প্রণব তয়াল বললেন, নাবালিকা ও তার বাবার বয়ানের ভিত্তিতে তদন্ত শেষ হওয়ার পরই পুলিশ পকসো আইনে মামলা বাতিল করার রিপোর্ট আদালতের কাছে জমা করেছে।

তবে, নাবালিকার বাবার ওপর সৃষ্ট চাপের পরিণামেই যে বয়ানের বদল ঘটেছে সংবাদপত্রে তাও প্রকাশিত হয়েছে। দ্য হিন্দু পত্রিকার ৮ জুন সংস্করণ নাবালিকার বাবার এই বিবৃতির উল্লেখ করেছে যে, “আমি আদালতে আমার বয়ান পরিবর্তন করেছি কেননা আমি আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম।… আমার পরিবার, আমার মেয়ে এবং নিজের সম্পর্কেও আতঙ্কিত।… আমার পরিবার নিরবচ্ছিন্ন আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে।” তিনি আরও জানিয়েছেন, যে ব্যক্তিরা তাঁকে হুমকি দিয়েছে তাদের নাম তিনি প্রকাশ করতে পারবেন না। অতএব, যারা তাঁকে শাসিয়ে, ভয় দেখিয়ে বয়ান পরিবর্তনে বাধ্য করেছে, তারা যেই হোক — রক্তের সম্পর্কের মানুষজন বা ব্রিজভূষণের অনুচরই হোক — তাদের লক্ষ্য যে পকসো আইনের আওতা থেকে ব্রিজভূষণকে বার করে আনাই ছিল, তা নিয়ে প্রশ্নের কোনো অবকাশ থাকতে পারে না। আদালত ৪ জুলাই পকসো আইনে ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাহারের পুলিশের আবেদনের বিচার করবে। আদালতের বিচারপতি কি পুলিশের রিপোর্টের ওপরই সম্পূর্ণ রূপে নির্ভর করবেন, নাকি চাপ সৃষ্টির পরিণামেই অভিযোগের বয়ানে বদল এসেছে বলে সংবাদপত্রে যে রিপোর্ট বেরিয়েছে, সেটিও তাঁর বিবেচ্য হবে? মোদী জমানায় আদালতের ভেতর থেকে বহু ক্ষেত্রেই যে শাসক অনুগামী স্বর উঠে আসছে তাতে বয়ান বদলের পিছনে থাকা আসল কারণ বিচারপতির কাছে খুব একটা গুরুত্ব পাবে বলে মনে হয় না।

women-wrestlers-movement

ছয় প্রাপ্তবয়স্ক কুস্তিগিরের অভিযোগের কারণে যে এফআইআর হয়েছিল তার ভিত্তিতে পুলিশ — এবং তাদের দাবি অনুযায়ী তদন্তের পর — ব্রিজভূষণ এবং তার সহযোগী বিনোদ তোমরের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছে। সেই চার্জশিটে দন্ডবিধির যে ধারাগুলোর প্রয়োগ হয়েছে সেগুলো হল ৩৫৪ (শ্লীলতাহানি), ৩৫৪এ (যৌন ইঙ্গিতবাহী মন্তব্য) এবং ৩৫৪ডি (স্টকিং বা চুপিসারে পিছু নেওয়া)। এই ধারাগুলোর কোনোটাতেই শাস্তি হিসাবে কারাবাসের মেয়াদ পাঁচ বছরের বেশি নয়, ফলে, সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুসারে ব্রিজভূষণের গ্রেপ্তারির সম্ভাবনা নেই। এবং ভারতীয় বিচার ব্যবস্থার গতিপ্রকৃতি অনুসারে বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘস্থায়ী হবে বলেই মনে হয়। অতএব, ব্রিজভূষণ তার কাজকারবার যথারীতি চালিয়ে যেতে পারবে, নিজের ঘনিষ্ঠ লোকজন দিয়ে কুস্তিগিরদের হুমকি দিয়ে যেতে থাকবে এবং নির্বাচনে দাঁড়াতে ও বিজেপির হয়ে প্রচার করতেও তার অসুবিধা হবে না।

ক্রীড়ামন্ত্রী অনুরাগ সিং ঠাকুরের সঙ্গে ৭ জুন কুস্তিগিরদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেই বৈঠকে ক্রীড়ামন্ত্রী কুস্তিগিরদের কিছু প্রতিশ্রুতি দেন এবং বলেন যে পুলিশ ১৫ জুন চার্জশিট পেশ করবে। এরথেকে এই অনুমান অস্বাভাবিক নয় যে, পুলিশ তদন্ত করে কী চার্জশিট দেবে এবং কবে দেবে তা বিজেপির লোকজনই ঠিক করে দিয়েছে! যাই হোক, ক্রীড়ামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর কুস্তিগিররা ১৫ জুন পর্যন্ত আন্দোলন স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেন, এবং আন্দোলন আবার শুরু হতে পারে এমন কোনো লক্ষণ নেই। তবে কুস্তিগিরদের আন্দোলন থেমে গেলেও জনগণের মধ্যে ব্রিজভূষণ ও বিজেপি বিরোধী ক্ষোভে ও ন্যায়বিচার লাভের প্রত্যাশায় কোনো ছেদ পড়েনি। গত ১৪ জুন কুস্তিগিরদের সমর্থনে দিল্লীতে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম জাতীয় মহিলা পঞ্চায়েত। এআইডিডব্লিউএ, এআইপিডব্লিউএ, সারা ভারত মহিলা সাংস্কৃতিক সংগঠন, সেন্টার ফর স্ট্রাগলিং উইমেন সহ ১২টা মহিলা সংগঠন ছিল ঐ মহিলা পঞ্চায়েতের উদ্যোক্তা। সেদিনের ঐ অনুষ্ঠানে অনেক মহিলা বুদ্ধিজীবীও অংশ নেন যাদের মধ্যে ছিলেন জয়া হাসান, উমা চক্রবর্তী, মৃদুলা মুখার্জী, সইদা হামিদ, নিবেদিতা মেনন ও অন্যান্যরা। ঐ অনুষ্ঠান থেকে বেশ কিছু দাবি উঠে আসে যেগুলোর মধ্যে কয়েকটা ছিল,

১) ব্রিজভূষণ শরণ সিংকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করতে হবে।

২) মহিলা কুস্তিগিরদের যৌন নিগ্ৰহে যথোচিত ব্যবস্থা গ্ৰহণে ব্যর্থতার জন্য ক্রীড়ামন্ত্রী অনুরাগ সিং ঠাকুরকে পদত্যাগ করতে হবে।

৩) ভারতীয় দন্ডবিধির ১১৬এ ধারায় সেই সমস্ত পুলিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতে হবে যারা প্রথমে এফআইআর নিতে চায়নি এবং পকসো আইন অনুসারে ব্যবস্থা নেয়নি।

৪) সাক্ষীগণ ও তাদের পরিবারের ওপর হুমকি প্রদানের বহু রিপোর্ট আসার পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে প্রতিবাদকারী কুস্তিগিরদের পেশ করা অভিযোগের তদন্ত করতে হবে।

ঐ মহিলা পঞ্চায়েতে কুস্তিগির সাক্ষী মালিকের মা সুদেশ মালিক সহ হরিয়ানার বহু মহিলা, দিল্লী ও রাজস্থানের মহিলা আন্দোলনের কর্মীরা যোগ দেন। প্রবল প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কুস্তিগিরদের কঠিন লড়াইয়ের প্রতি সমর্থন ও সংহতি জানানো হয় এবং পঞ্চায়েতে অংশগ্রহণকারীদের বক্তব্যে সংগ্রামী ঐক্যের প্রয়োজনীয়তার কথাও উঠে আসে।

কুস্তিগিরদের এই আন্দোলনকে কালিমালিপ্ত করতে এবং যৌন নিগ্ৰহ সমর্থনের বিজেপির কলঙ্ককে মুছে দিতে সমবেতভাবে সুকৌশলী এই প্রচার চালানো হচ্ছে যে, এটা যত না মহিলা কুস্তিগিরদের ন্যায়বিচার ও মানমর্যাদা লাভের লক্ষ্যে আন্দোলন, এরমধ্যে তার চেয়ে বেশি রয়েছে রাজনৈতিক অভিপ্রায়। কংগ্রেস ও অন্যান্য বিজেপি-বিরোধী শক্তিই এই আন্দোলনের পিছনে মদত হিসাবে রয়েছে ও প্ররোচনা জুগিয়েছে। তবে এই প্রচার তেমন আমল পায়নি, বিপরীতে নানা দিক থেকেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও বিজেপির কপটাচার ও শঠতাকে সর্বসমক্ষে প্রকট করে দিয়েছে। কুস্তিগিরদের যৌন নিগ্ৰহ বিরোধী আন্দোলনের গোটা পর্যায়ে নীরব থেকে এবং নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধনের দিন ২৮ মে কুস্তিগিরদের টেনে-হিঁচড়ে জেলে নিয়ে গিয়ে ও যন্তরমন্তরে তাদের আন্দোলন মঞ্চ ভেঙে দিয়ে নরেন্দ্র মোদী প্রতিপন্ন করলেন যে, নারীর ক্ষমতায়ন এবং বেটি বাঁচাও-বেটি পড়াও’এর তাঁর বাগজাল আসলে শূন্যগর্ভ প্রতিশ্রুতি। তাঁর কাছ থেকে নারীদের ন্যায়বিচার লাভের প্রত্যাশা দুরাকাঙ্খা ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না। এই আন্দোলন দেখিয়েছে, লিঙ্গন্যায় বিজেপির চরিত্রে সম্পূর্ণ রূপে অনুপস্থিত। এই আন্দোলন আরও দেখিয়েছে, সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে নিজেদের কব্জায় নিয়ে এসে স্বেচ্ছাচারীভাবে চালানোর মতো ক্রীড়াক্ষেত্রকেও বিজেপি তাদের স্বেচ্ছাচারের মুলুক বলে জ্ঞান করে, ব্রিজভূষণ যেমন কুস্তি ফেডারেশনকে নিজের জমিদারি করে তুলেছিলেন। ন্যায়বিচার লাভের যে লক্ষ্যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, আদালতের বিচার প্রক্রিয়ায় তার অর্জনের আশু সম্ভাবনা না থাকলেও জন আদালতে ব্রিজভূষণ অবশ্যই যৌন নিগ্ৰহকারী ও পীড়ক বলেই গণ্য হবেন। শুরু থেকেই এই আন্দোলন ছিল এক চরম অসম আন্দোলন, গোটা রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে কৃষক জনগণের এক অংশের সমর্থনের ভিত্তিতে যৌন নিগ্ৰহের শিকার মহিলা কুস্তিগিরদের আন্দোলন। কিন্তু এই আন্দোলনের ন্যায়পরায়ণতা ও দৃঢ়তা এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, মোদী সরকার ও বিজেপির মতো প্রতাপশালী ও ধড়িবাজ শক্তিকেও তা হিমশিম খাইয়েছে, আন্তর্জাতিক ক্রীড়া সংস্থার সমর্থনও লাভ করেছে, এমনকি বিজেপির সামাজিক ভিত্তিতেও ফাটল ধরিয়েছে। মহিলা কুস্তিগিরদের এই আন্দোলন নারী আন্দোলনের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ও অনুপ্রেরণা হয়েই থেকে যাবে।

- জয়দীপ মিত্র
 

খণ্ড-30
সংখ্যা-20