অভিন্ন দেওয়ানি বিধি সম্পর্কে – কিছু কথা কিছু প্রশ্ন
few-words-and-some-questions

গত ১৪ জুন ২০২৩, ভারতের ২২তম আইন কমিশন উইনিফর্ম সিভিল কোডের (অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বা UCC) উপর একটা পাবলিক নোটিশ জারি করেছে। যার মধ্য দিয়ে অভিন্ন কোড সম্পর্কে ব্যক্তি এবং সংস্থার মতামত এবং ধারণা জানতে চেয়েছে।

উইনিফর্ম সিভিল কোড (UCC) সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে পরামর্শ/আলোচনা/কাগজপত্রের আকারে মতামত ইমেল, অনলাইনে জমা বা চিঠি পাঠানোর মাধ্যমে পাঠানো যেতে পারে। এই সম্পর্কিত মতামত পাঠাতে হবে ১৪ জুলাই ২০২৩’র মধ্যে।

এটাই বোধহয় ভারতবর্ষে প্রথম নিদর্শন হয়ে থাকবে আইন কমিশন নিজে কোনো খসড়া প্রস্তুত না করে দেশের ব্যক্তি বা সংস্থার মতামত জানানোর জন্য নোটিশ জারি করল। দেওয়ানি বিধির বহু দিক আছে। ইতিমধ্যে বেশকিছু অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালুও আছে। যেমন — চুক্তি আইন, দেওয়ানি কার্য বিধি, পণ্য বিক্রয় আইন, সম্পত্তি হস্তান্তর আইন, অংশীদারি আইন, এভিডেন্স আইন ইত্যাদি। তাহলে বাকি থাকছে ব্যক্তিগত বা ধর্ম বা সম্প্রদায় বা জাতি উপজাতি, আদিবাসীদের নিজস্ব আইন বা প্রচলিত সংস্কৃতি বা প্রথা সম্পর্কিত আইন। আমরা জানি উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিতে প্রায় ২০০-র বেশি জনজাতির নিজস্ব আইন আছে। সংবিধান নাগাল্যান্ড, মেঘালয়, মিজরাম-এর নিজস্ব স্থানীয় বিধিকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এমনকি হিন্দু আইনের বেশকিছু নিজস্ব বিধিও স্বীকৃত। এ প্রসঙ্গে বলা যায় সংবিধানের কাঠামো নির্মাতাদের যদি সারা দেশে এক আইন লাগু করার ভাবনা থাকত তাহলে ব্যক্তিগত আইনের বিষয়টি নিয়ে সংসদকে একাধিক ক্ষমতা দেওয়া থাকত। আমরা জানি অভিন্ন দেওয়ানি বিধিকে সংবিধানের মৌলিক অধিকারের অনুচ্ছেদে রাখা নিয়ে গণ পরিষদে মতবিরোধ হয়েছিল। ভোটের মাধ্যমে এর মীমাংসা হয়েছিল। সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের নেতৃত্বাধীন সাব কমিটি ৫-৪ ভোটে জেতে এবং সিদ্ধান্ত হয় ইউনিফর্ম সিভিল কোডকে সংবিধানের মৌলিক অধিকারের বাইরে রাখা হবে। যে কারণে এই বিষয়টি সংবিধানে রাষ্ট্রীয় নীতির নির্দেশ মূলক নীতিতে (Directive principles of State Policy) ৪৪ নম্বর অনুচ্ছেদে রাখা হয়েছে। আমরা এটাও জানি সংবিধানের ২৫, ২৬(বি) এবং ২৯ নম্বর অনুচ্ছেদে ব্যক্তির ধর্মীয় মৌলিক অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে এবং বিভিন্ন সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার অধিকার দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন তো থাকছেই, তাহলে আইন কমিশন অভিন্ন দেওয়ানি বিধির ঠিক কোন বিষয়ের উপর মতামত চাইছে তা স্পষ্ট নয়।

এটা প্রথম না, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২০১৬ সালে জাস্টিস বি সি চৌহানের চেয়ারম্যানে গঠিত ২১তম আইন কমিশনকে বিষয়টি দেখতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। আইন কমিশন সরাসরি কমিশনের পক্ষ থেকে ২০১৮ সালে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছিল (যার মধ্যে স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট, দ্য প্রটেকশন অফ ডোমেস্টিক ভাওলেন্স অ্যাক্ট ইত্যাদি ধর্ম নিরপেক্ষ আইনগুলিকে শক্তিশালী করা এবং তার ব্যাপকতা বাড়ানো সহ বিভিন্ন ধর্মের মহিলাদের আধিকার বিষয়ক) যেগুলি নিয়ে পরবর্তীতে আর কোন আলোচনাই করা হয়নি। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের নিয়ে তাঁদের মতামত সংগ্রহ করাই যেত।

আমরা দেখলাম কিছুদিন আগে মধ্যপ্রদেশের ভুপালের এক সভায় মোদীজি এই অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করার প্রস্তাবটি আনলেন। জাস্টিস রিতু রাজ অয়াস্থির চেয়ারম্যানশিপে ২২তম আইন কমিশনকে দায়িত্ব দেওয়া হল। আইন কমিশন তড়িঘড়ি নোটিশ জারি করল ১৪ জুলাই ’২৩-এর মধ্যে মতামত জানাতে। এখন শোনা যাচ্ছে এই বাদল অধিবেশনেই বিলটি আনা হবে এবং আইন প্রণয়ন করা হবে। এটাও শোনা যাচ্ছে মোদীজি মহিলাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্যোগী হয়েছেন।

প্রশ্ন তো উঠবেই, মহিলাদের অধিকার সম্পর্কে উদ্বিগ্ন মোদী সাহেবকে দেখা গেল ২০০২ সালে বিলকিস বানুকে গণধর্ষণ করেছিল এবং তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করেছিল যে ১১ জন সাজাপ্রাপ্ত আসামী তাদেরকে বেকসুর খালাস করে দিতে। সম্প্রতি বিজেপি সাংসদ ব্রীজ ভূষণ দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার মহিলা কুস্তিগিরদের উপর নামিয়ে আনা হল নির্মম পাশবিক আক্রমণ। এছাড়াও তো আছে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নির্যাতিতা মহিলাদের আর্ত চিৎকার — যা মোদীজি শুনতেই পান না। তিনি কেন মহিলাদের অধিকার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন?

আবার বলা হচ্ছে এই আইনটি অত্যন্ত জরুরি কারণ এটা সংবিধানের রাষ্ট্রীয় নীতির নির্দেশমূলক নীতির (Directive Principles of State Policy)  ৪৪ নম্বর ধারায় লিপিবদ্ধ আছে।

আমরা জানি, সংবিধানে ৩৬ থেকে ৫১ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় নীতির নির্দেশমূলক নীতির (Directive Principles of State Policy) ধারা আছে। এর মধ্যে কয়েকটি ধারা উল্লেখ করছি যে ধারাগুলির জন্য আইন প্রবর্তন মোদীজির কাছে গুরুত্বই পেল না। যেমন — ৩৯-এর (খ) এবং (গ) ধারায় বলা আছে — রাষ্ট্র এমনভাবে তার নীতি পরিচালনা করবে যাতে সর্বসাধারণের হিতার্থে দেশের পার্থিব সম্পদের মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ বণ্টিত হয় এবং ধনসম্পদ ও উৎপাদনের উপকরণসমূহ কিছু লোকের হাতে কেন্দ্রীভূত না হয়।

৩৯(ক) ধারায় — স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে ভারতে প্রত্যেক নাগরিকের উপযুক্ত জীবিকা অর্জনের অধিকার।

৩৯(চ)(ছ) ধারায় বলা আছে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার।

৪১ ধারায় কর্মের অধিকার। বেকার অবস্থায়, বার্ধক্যে, অসুস্থতায় ও অভাবে সরকারি সাহায্য পাওয়ার অধিকার।

৪৭ ধারায় বলা আছে — রাষ্ট্র পুষ্টি ও জীবনযাত্রার মানের স্তর উন্নীত করার এবং জনস্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটানোর চেষ্টা করবে।

৪৩ ধারায় — গ্রামাঞ্চলে ব্যক্তিগত বা সমবায়ের মাধ্যমে কুঠির শিল্পের উন্নতি করা। কর্মীদের জীবনযাপনের জন্য উপযুক্ত মজুরি এবং উন্নত জীবনযাত্রার মান যাতে সুনিশ্চিত হয় এমন কাজের অধিকার।

৪৩(ক) ধারায় — শিল্প পরিচালনায় কর্মীদের অংশগ্রহণের অধিকার।

এরকম বহু আদর্শ, নির্দেশ, অধিকারের কথা রাষ্ট্র পরিচালনার নির্দেশ মূলক নীতিতে (Directive principles of State Policy) থাকলেও এই সকল বিষয়ে আদালতে যাওয়া যাবে না। সরকার এই বিষয়গুলির উপর আইন প্রণয়ন করলে সংবিধানের মৌলিক অধিকারের অনুচ্ছেদে যুক্ত হবে। এরপর তা আদালত গ্রাহ্য হবে। এত ধারার মধ্যে ৪৪ নম্বর ধারার বিষয়টিকে এই মুহূর্তে মোদীজির আইনে রূপ দেওয়া অত্যন্ত জরুরি হয়ে পরেছে। এটাই আজ চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে। প্রশ্ন উঠছে তাহলে কী ভারতবর্ষে আগামীদিনে সকল ধর্মের মানুষের, জনজাতি, আদিবাসীদের [পার্সোনাল] ল, সংস্কৃতি, অভ্যাস ও প্রথাগুলির বিলোপ ঘটবে? এছাড়াও সব ধর্মের ব্যক্তিগত আইনের মধ্যেও আছে ভিন্নতা। আদিবাসী সমাজ চলে ঐতিহ্য ও প্রথার ভিত্তিতে। ছোটনাগপুর প্রজাস্বত্ব আইন, সাঁওতাল পরগনা প্রজাস্বত্ব আইন, SPT আইন, PESA আইন যা আদিবাসীদের জমির প্রশ্নে বিশেষ অধিকার দিয়েছে। এ সবের কী হবে?

আসলে ২০২৪-এর নির্বাচনের আগে বিজেপি-আরএসএস-এর পক্ষ থেকে সুকৌশলে নতুন একটা এজেন্ডা দেশবাসীর চর্চায় আনতে চাইছে। দেশের জনগণকে সম্প্রদায়গত বিভাজন করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চাইছে। অযোধ্যায় রাম মন্দির হয়ে গেছে, সংবিধানের ৩৭০ ধারা অকার্যকর করা হয়ে গেছে, আসামে এনআরসি চালু করতে গিয়ে মুসলিমদের থেকে হিন্দুরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাই আপাতত এনআরসি স্থগিত। চাই নতুন এজেন্ডা। সংখ্যালঘুদের নাম না করে বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদ, সম্পত্তির উত্তরাধিকার এবং মহিলাদের সমানাধিকারের জন্যই নাকি এই অভিন্ন দেওয়ানি বিধি আজ জরুরি হয়ে পড়েছে।

বহু ধর্ম, সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের মিলন ক্ষেত্র আমাদের ভারতবর্ষ। নিজেদের ব্যক্তিগত আইন, সংস্কৃতি, অভ্যাস, আচার বিচার, প্রথা ইত্যাদি ক্ষেত্রে যতই ভিন্নতা থাকুক না কেন তাঁরা ভারতবর্ষের সংবিধানের মুল প্রস্তাবনার সার্বভৌমত্ব, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র ধারণার সাথে নিজেদের একাত্ম করতে অভিন্ন থেকেছেন। এই সংবিধানের মাধ্যমেই দেশের জনগণ যাতে ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা, সমতা, ভাতৃত্ববোধ অর্জন করতে পারেন তারজন্য অভিন্ন ঐতিহাসিক আন্দোলনের জন্ম দিচ্ছেন প্রতিদিন। সেখানে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বিল যদি সংসদে সংখ্যা গরিষ্ঠের জোরে পাশ করানো হয় তাহলে তার পরিণতি বিগত দিনের কৃষক আইন, শ্রম কোডের মতো হবে। যা প্রত্যাহার করতে বা স্থগিত রাখতে বাধ্য করেছেন ভারতের অভিন্ন জনগণ।

- দিবাকর ভট্টাচার্য

খণ্ড-30
সংখ্যা-23