অস্বচ্ছ পথে ধারাভি বস্তি পুনর্গঠন প্রকল্পের বরাত আদানি সংস্থাকে
dharavi-slum-redevelopment-project-on-opaque-ways

নরেন্দ্র মোদী জমানায় অর্থনীতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে ওঠা ক্রোনি ক্যাপিটালিজম বা সাঙাতি পুঁজিবাদ বস্তুত মোদী ও বিজেপি ঘনিষ্ঠ গুটিকয়েক পুঁজিপতি তোষণেরই নামান্তর। সরকারি ক্ষমতার প্রয়োগে এই পুঁজিপতিদের বিশেষ সুবিধা ও বরাত পাইয়ে দেওয়াটাই রীতি হয়ে উঠেছে এবং বেসরকারি হাতে সরকারি পরিকাঠামোর হস্তান্তরে সম্পদ এদের হাতে কেন্দ্রীভূত হওয়ায় তারা ফুলেফেঁপে উঠছে। আর মোদীও বিজেপি ঘনিষ্ঠ এই সাঙাতদের তালিকার এক নম্বরে যে গৌতম আদানি রয়েছেন তা এক সর্বজনবিদিত তথ্য। কেন্দ্রীয় ও বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলির প্রশাসনিক অলিন্দে আদানি-প্রীতি এতটাই পরিব্যাপ্ত যে আদানি তোষণের কোনো সুযোগকেই শাসক বিজেপি নেতারা হাতছাড়া হতে দেন না। অতি সম্প্রতি তেমনটাই প্রতিপন্ন হল মুম্বাইয়ের ধারাভি বস্তির পুনর্গঠন প্রকল্পের বরাত আদানি প্রপার্টিজ’এর হতে তুলে দেওয়ার ঘটনায়। মহারাষ্ট্রের উপমুখ্যমন্ত্রি দেবেন্দ্র ফড়ণবীস আবাসন দপ্তর ছেড়ে দেওয়ার ঠিক একদিন আগে ১৩ জুলাই ২০২৩ আদানির সংস্থাকে নিয়োগ করলেন ধারাভি বস্তির পুনর্গঠনের যৌথ উদ্যোগের প্রধান অংশীদার হিসেবে। ধারাভি বস্তির পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার একটা পর্যায় শুরু হয়েছিল ২০১৮ সালে, এবং সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত টেন্ডার বা দরপত্র ডাকা এবং তার নিষ্পত্তির দিকে দৃষ্টিপাত করলে এই ধারণা পোষণ অস্বাভাবিক হবেনা যে, আদানি ছাড়া অন্য কোনো গোষ্ঠী যেন বস্তি পুনর্গঠনের বরাত না পায় সেই লক্ষ্যেই কোমর বেঁধেছিল বিজেপি ও শিবসেনা নেতৃত্বাধীন মহারাষ্ট্রের সরকার।

ধারাভি বস্তি পুনর্গঠন প্রকল্পের জন্য ২০১৮ সালে যে দরপত্র ডাকা হয় তাতে কয়েকটি সংস্থা অংশ নিয়েছিল — আদানি যেমন দরপত্র দিয়েছিল, তারসাথেই দরপত্র দিয়েছিল দুবাইয়ের সেকলিঙ্ক টেকনোলজি কর্পোরেশন। দরপত্রে তারা জমির দাম দেয় ৭২০০ কোটি টাকা, এবং ঐ দর আদানিদের দেওয়া ৪৫৩৯ কোটি টাকার দরের থেকে যথেষ্ট বেশি ছিল। দরপত্রে সবচেয়ে বেশি দাম দেওয়ায় সেকলিঙ্ক গোষ্ঠীই ২০১৯’র ফেব্রুয়ারিতে প্রকল্পের বরাত জয়ী বলে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু এরপরই একটা বিতর্ককে খুঁচিয়ে তোলা হল। প্রকল্পের জন্য রাজ্য সরকার রেলের কাছ থেকে ৮০০ কোটি টাকায় ৪৬ একর জমি কেনে। জমি কেনার জন্য ৮০০ কোটি টাকা ব্যয় হওয়ায় রাজ্য সরকার অ্যাডভোকেট জেনারেলের কাছ থেকে পরামর্শ চায় (এটা কি আদৌ জরুরি ছিল?) এবং তিনি আগের দরপত্র বাতিল করে নতুন দরপত্র ডাকার পরামর্শ দেন। উদ্ধব ঠাকরের নেতৃত্বাধীন মহারাষ্ট্র বিকাশ আগাদি সরকার ২০২০’র অক্টোবরে আগের ডাকা দরপত্র বাতিল করে দেয়। এবং উদ্ধব ঠাকরে সরকারের পতনের পর শিবসেনা-বিজেপি সরকার ২০২২’র ১ অক্টোবর নতুন দরপত্র ডাকে। সেই দরপত্রে অংশ নেয় তিনটে সংস্থা — আদানি প্রপার্টিজ, ডিএলএফ ও নমন ডেভেলেপার্স। আদানিরা ৫০৬৯ কোটি টাকা দরে দিয়ে সর্বোচ্চ দামের প্রস্তাবক হয়ে বস্তি পুনর্গঠন প্রকল্পের বরাত লাভ করে। উল্লেখ্য যে, আদানিদের দেওয়া এই দর সেকলিঙ্ক গোষ্ঠীর দেওয়া দরের থেকে ২১৩২ কোটি টাকা কম হওয়ায় শিন্ডে-বিজেপি সরকারের কোনও স্তরেই কোনও উচ্চবাচ্য হয়নি। আদানিদের সুবিধার জন্য সরকারি তহবিলের এই ক্ষতি বোধ হয় সরকারের পরিচালকদের কাছে বিবেচনার কোনও বিষয়ই নয়!

তবে, আদানিদের হাতে প্রকল্পের ভার তুলে দেওয়ার লক্ষ্যে দরপত্রের নিষ্পত্তির এই বিলম্বই এই প্রকল্পে বরাত প্রক্রিয়ার একমাত্র মৌলিক বৈশিষ্ট্য নয়। সেকলিঙ্ক গোষ্ঠী যাতে দরপত্রে আর অংশ নিতে না পারে তারজন্য একটা চাতুরির আশ্রয়ও নেওয়া হয়। দরপত্রে অংশ নেওয়া সংস্থার সম্পদের ন্যূনতম পরিমাণ আগে নির্ধারিত হয়েছিল ১০,০০০ কোটি টাকা, সেটাকে বাড়িয়ে করা হল ২০,০০০ কোটি টাকা যাতে আদানিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যেতে পারে। এই প্রসঙ্গে আমাদের বিমানবন্দর বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়ার কথা মনে না পড়ে পারে না। ২০১৮ সালে ছটা বিমানবন্দর বেসরকারিকরণ করতে গিয়ে মোদী সরকার সিদ্ধান্ত নিল — বিমানবন্দর পরিচালনায় কোনও পুর্ব অভিজ্ঞতা যাদের নেই তারাও দরপত্রে অংশ নিতে পারবে। বিমানবন্দর পরিচালনায় কোনও পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও আদানিরা টেন্ডারে অংশ নিয়েছিল, এবং ছটা বিমানবন্দরের পরিচালনভারই তাদের হস্তগত হয়েছিল। শুধু এই নয়, হিন্ডেনবার্গ সংস্থার পেশ করা অভিযোগের পর আদানিদের কোম্পানিগুলোর শেয়ারে ধ্বস নামে এবং তারা কিছুটা আর্থিক প্রতিকূলতার মধ্যে পড়ে। তাদের আর্থিক সুবিধা করে দিতে দরপত্রে উল্লিখিত অর্থ একসাথে না দিয়ে কিস্তিতে শোধ করার সুবিধা প্রদানও করা হয়। যে জমিতে বস্তি পুনর্গঠন হওয়ার কথা তা মুম্বইয়ের সরেস অঞ্চলের জমি। সেই জমির মূল্যায়ন না করেই ন্যায্য মূল্যের অনেক কমে প্রকল্পের স্বত্বের অধিকার আদানিদের দেওয়ার অভিযোগও উঠেছে।

ধারাভি এশিয়ার বৃহত্তম বস্তি। প্রায় ৬০০ একর জমিতে পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় তৈরি হবে আবাসন, বাণিজ্যিক পরিসর, অফিস, মল ইত্যাদি। অতএব, হকদার আবাসিকদের বাসস্থান বণ্টনের পরও জমি-বাড়ি বিক্রির সুযোগ তাদের থাকবে, আর তাই এই প্রকল্পে লাভের সম্ভাবনা ২০-২৫ হাজার কোটি পর্যন্ত হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের অনুমান। তবে, এই প্রকল্পের বাস্তবায়নকে কেন্দ্র করে একটা প্রশ্নও কিন্তু মাথাচাড়া দিচ্ছে। প্রকল্প রূপায়ণের আনুমানিক ব্যয় ২৭,০০০ কোটি টাকা। আর্থিক প্রতিকূলতার মুখে পড়া আদানিদের পক্ষে বাজার থেকে এই পরিমাণ অর্থ জোগাড় করা কি সম্ভব হবে? আর তাতে তারা ব্যর্থ হলে আবাসনের দাবিদার অন্তত ৯,০০,০০০ জনগণ এবং বহু ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সংস্থা বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। তখন কি সরকারই আদানিদের রক্ষাকর্তা হয়ে দেখা দেবে? হালে যেমন দেখা গেছে, এলআইসি’র মতো রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের আর্থিক সংস্থাকে তাদের উদ্ধারে লাগানো হবে? আর একটা বিষয়ের উল্লেখও জরুরি। দরপত্রে সর্বোচ্চ দাম দেখানো সত্ত্বেও ধারাভি বস্তি পুনর্গঠন প্রকল্পের বরাত থেকে তাদের বঞ্চিত করায় সেকলিঙ্ক গোষ্ঠী বোম্বে হাইকোর্টে বস্তি পুনর্গঠন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। সেই মামলার রায়ের দিকেও নজর রাখতে হবে। তবে, বিভিন্ন আদালতে শাসকের স্বরের যে প্রতিধ্বনি এখন শোনা যাচ্ছে তাতে শাসকের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে ন্যায়ের বিহিত কতটা হবে তা অবশ্যই সংশয়ের।

আদানির মতো কর্পোরেট সাঙাতদের ঐশ্বর্যশালী করে তোলাটা দান-প্রতিদানের এক সম্পর্কে আবদ্ধ। এই কর্পোরেটদের ভাঁড়ার ভরলে তার কিছু অংশ পৃষ্ঠপোষকদের ভাঁড়ারেও ঢোকে। মোদী জমানায় রাজনৈতিক দল, বিশেষভাবে বিজেপির ভাঁড়ারে কর্পোরেটদের কালো অর্থ জমা হওয়ার একটি মাধ্যম হয়ে উঠেছে মোদীর চালু করা ইলক্টোরাল বন্ড প্রকল্প, এমনই আশঙ্কা প্রকাশ করে থাকেন ভাষ্যকারগণ। নরেন্দ্র মোদী ২০১৪ সালে কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় বসার পরপরই বলেছিলেন তাঁর জেহাদ হবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে, নিজেরা খাবেন না, কাউকে খেতেও দেবেন না। কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর ন’বছরের শাসন এর বিপরীতের সাক্ষ্যই বহন করছে — দুর্নীতি আড়ে-বহরে বেড়েছে, বিজেপি হয়ে উঠেছে দুর্নীতিতে অভিযুক্তদের আশ্রয়স্থল, দুর্নীতির ওয়াশিং মেশিন রূপে অভিহিত হচ্ছে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহদের বিজেপি। কংগ্রেসি মুখপাত্র পবন খেরা যখন প্রধানমন্ত্রীকে ‘নরেন্দ্র গৌতমদাস মোদী’ বলে অভিহিত করেন, তারমধ্যে প্রকটিত হচ্ছে এক অমোঘ সত্য — মোদী আদানিদের মতো ভ্রষ্টাচারী কর্পোরেটদের মহা মদদদাতা এবং তাঁর দুর্নীতি-বিরোধী জেহাদ এক মেকি আস্ফালন!

খণ্ড-30
সংখ্যা-25