খবরা-খবর
বর্ধমান জেলার কিছু অঞ্চলের অভিজ্ঞতা
some-regions-of-burdwan-district

পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার সময় থেকে আমরা দেখেছি বিরোধী প্রার্থীদের ওপর হুমকি অত‍্যাচার। একটা ভয়ের পরিবেশ। এর থেকে রেহাই পায়নি মহিলা পার্থীরাও। তাই মহিলা পার্থীদের প্রচার করতে যাওয়ার সময় প্রথমে একটু দ্বিধাতেই ছিলাম যে মহিলা প্রার্থীরা শেষ পর্যন্ত প্রচার করতে বেরোতে পারবে কিনা। ইতিমধ্যে খবর আসতে থাকে যে কিছু কিছু জেলায় পার্টির মহিলা প্রার্থীরা শাসক দলের ও পরিবারের চাপে নমিনেশন দিতে ভয় পাচ্ছে।

কালনা ২নং ব্লকে দুটি গ্রামে আমাদের মহিলা প্রার্থী দাঁড়ায়। আগ্রাদহ জিকরা গ্রাম পঞ্চায়েতে রানি মুর্মু ও বাজিতপুর তেহট্টতে উর্মিলা মুর্মু। অকালপৌষ পঞ্চায়েত সমিতিতে সুমি মজুমদার, এবং জেলা পরিষদে চিন্তামণি মুর্মু। এই অঞ্চলে বেশিরভাগ প্রার্থীই আদিবাসী, এই বিষয়টা উল্লেখ করলাম এই জন্য যে সিটগুলো কিন্তু সব এসটি রিজার্ভড নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমরা দেখি যে কেবল সংরক্ষিত আসনেই এসটি আদিবাসী প্রার্থীরা দাঁড়ান। এই অঞ্চলে প্রচার করতে গিয়ে দেখতে পাই যে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ আর আদিবাসী মানুষ পাশাপাশি ঘনিষ্ঠভাবে বসবাস করেন, চায়ের দোকানে একই সঙ্গে মিলেমিশে আড্ডা মারেন।

রানি মুর্মু আগেও এই গ্রামে জিতেছিলেন। তাই মানুষ তাঁকে চেনে। এবং তিনি যখন সদস্য ছিলেন তখন রাস্তার উন্নতি করেছেন, মানুষের পাশ থেকেছেন। গ্রামের মানুষ তা জানে। তাই তিনি সাবলীলভাবে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সাঁওতালি ভাষায় গ্রামের মানুষদের বোঝাতে পেরেছেন যে তিনি গরিব মানুষের হয়ে লড়বেন। তিনি নিজেও তো আসলে গরীব খেটে খাওয়া মানুষ।

ঊর্মিলা মুর্মু শিক্ষিত, পেশায় একটি সরকারী প্রতিষ্ঠানে নার্স, ছুটি নিয়ে প্রচার করছেন। বাড়ি বাড়ি প্রচারে গিয়ে নিজের ভাষায় বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন কেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনকে ভোট দেবে আদিবাসী মানুষ। আমরা দেখি অনেক সময় মেয়েরা রাজনীতির আঙ্গিনায় আসতে চায় না। স্বামীরা রাজনীতি করেন তাই মহিলা সিট হলে তাদের স্ত্রীদের দাঁড় করান। কিন্তু এই ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। ঊর্মিলা পার্টির সঙ্গে যুক্ত এবং প্রচারে মাঝে মাঝে তাঁর স্বামী ও শ্বশুরও উপস্থিত হন। যদিও একই পাড়াতে শাসক দলের হয়ে দাঁড়িয়েছে তারই শ্বশুরবাড়ির এক আত্মীয়। সেই প্রতিকুলতাকে কাটিয়ে প্রতিদিন প্রচারে বেরোনো মোটেই সহজ বিষয় নয়।

সুমি মজুমদার সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির এবং বর্ধমান জেলার পার্টির নেত্রী। পঞ্চায়েত সমিতিতে দাঁড়িয়েছেন। প্রতিদিন বাড়ির কাজকর্ম সামলে, মেয়েকে কোলে নিয়ে প্রচারে যেতেন। অক্লান্ত পরিশ্রম করেন পার্টির প্রচার গড়ে তোলার জন্য। রাজনীতিতে মেয়েদের ভুমিকা রাখার বিষয়টা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা বোঝা যায় রাজনেতিক এই ধরনের প্রচারে গেলে। রাজনীতির আঙ্গিনায় যত মেয়েরা প্রবেশ করে ততই মেয়েরা আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে, ক্ষমতায়ন হয়।

বর্ধমানের ১নং অঞ্চলের বন্দুল বাজারে কামারপিতা গ্রামে একই পরিবারের স্বামী ও স্ত্রী দাঁড়িয়েছেন। পার্টির সংগঠনও সেখানে দুর্বল। আমাদের প্রচার শুরু হওয়ার আগের দিনই সেখানে অন‍্য বিরোধী দলের প্রার্থীকে শাসকদল মারধোর করেছে বলে খবর ছিল। ভয়ের পরিবেশ ছিল। অনেকে ভয়ে প্রচারে আসেনি এবং নমিনেশনও দেয়নি। কিন্তু এই সবকে অতিক্রম করেই আমাদের কমরেড যুগল নমিনেশন জমা করেন। প্রথম প্রথম চাঁপা হাজরা প্রচারে নামতে খানিক লজ্জা পাচ্ছিলেন। তেমন সঙ্গীসাথি নেই তাঁর গ্রামে। এভাবে বেরোনোর অভ্যাসও ছিল না বোঝা যায়। কিন্তু একবার বেরিয়ে পড়ার পর তিনি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই সহজ ভাবে মহিলাদের কাছে গিয়ে প্রচার শুরু করেন। বাড়ির লাগোয়া দোকানে বসেও প্রচার জারি রাখেন।

বর্ধমানের ভাতার থানার অন্তর্গত আমারুন গ্রামে ছিলেন সীমা দাস। সিপিআই(এমএল)-এর আন্দোলনের পুরোনো জায়গা। আদিবাসীদের জমি রক্ষার আন্দোলন, চাষের জলের আন্দোলন, আরো অনেক আন্দোলনের সাক্ষী এই অঞ্চল। তাই মানুষ আমাদের কথা ঘিরে ধরে শুনছিলেন যখন আমরা সেখানে প্রচারে যাই।

পঞ্চায়েতে মহিলাদের ৫০ শতাংশ সংরক্ষণ অনেক লড়াই করেই পেয়েছে। তাই যখন দেখি যে শাসকদলের শত হুমকি সত্বেও এই পার্টির, যাদের ক্যাম্পেইনের পয়সা নেই, যাদের লড়াইটা ক্ষমতাশীল নিপীড়ক শ্রেণীর বিরুদ্ধে, বাহুবলীদের বিরুদ্ধে, সেই পার্টির হয়ে মেয়েরা লড়ে যাচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের শৃঙ্খলকে তুচ্ছ করে, তখন আমাদের ভরসা জাগে।

- চন্দ্রাস্মিতা

খণ্ড-30
সংখ্যা-23