ডাকঘর থেকে গঙ্গাজলের ব্যবসা!
business-from-the-post-office

মোদী সরকার এবার ডাকঘরের পচিমবঙ্গ সার্কলে গঙ্গাজল বিক্রির কাউন্টার খুলল! বলা-কওয়া নেই, কবে কখন সরকার বাহাদুর এই পলিসি নিয়েছে। নাগরিক জনতা হয় ভালো করে নজর করেনি, নয় নজর করেছে, গুরুত্ব দেয়নি। যাই হোক, কপাল ভালো যে সুকুমার রায় বেঁচে নেই, থাকলে এসব দেখে মোদী জমানার গঙ্গাযাত্রা নিশ্চিত করতে নিশ্চয়ই আস্ত একটা ছড়া লিখে ফেলতেন। দেশকে যারা ভালোবাসেন তারা কেন্দ্রের সরকারকে দেখছেন একের পর এক রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের ইউনিটগুলি গুটিয়ে ফেলতে, বেচে দিতে। কারণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে বছরের পর বছর লোকসানে চলা সরকারি শাখাপ্রশাখা আর টানা যাচ্ছে না। তাই বিলগ্নীকরণ, বেসরকারীকরণ অনিবার্য ভবিতব্য। কোন কোন ক্ষেত্রে গল্প জুড়ে দেওয়া হয় ‘অত্যাধুনিক পুনর্গঠনের’। আর সময়ের সাথে সাথে সেই গল্প যে প্রতিশ্রুতির প্রতারণার সেটা ধরা পড়ে।

কিন্তু ডাকঘর থেকে গঙ্গাজল বেচা শুরু করার যুক্তি জাহির করতে অন্যান্য সমস্ত পরিষেবা দেওয়ার বিনিময়ে তো কোনও ‘লোকসানের গল্প’ নেই। জিপিও’র মাথার ওপরকার খোদ পশ্চিমবঙ্গ সার্কল কর্তৃপক্ষের মুখের খবর অন্তত সেটাই বলছে।

ই সার্কলের পিএমজি’ (পোস্টাল মেইল অ্যান্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট) ও পিএমজি (কলকাতা)-র বক্তব্য হল, গত আর্থিক বছরে (২০২১-২২) ডাকঘরের সমস্ত পরিষেবা দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সার্কলের আয় হয় প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। ২০২০-২১ সালে আয় ছিল ১৫৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে আয়ের পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ। এর মধ্যে (৩০০ কোটি টাকা) রয়েছে আধার, পাসপোর্ট তৈরি, গঙ্গাজল ও বিভিন্ন জৈব পণ্য তৈরি ও বিক্রি বাবদ আয়ের ৩১ কোটি টাকা। অবশিষ্ট ২৬৭ কোটি টাকা আয় হয়েছে পোস্টাল বিভিন্ন আইটেম থেকে। এই ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ তো একবারও বলেননি, ডাকঘরের পশ্চিমবঙ্গ সার্কেল ইউনিট লোকসানে চলছে। ডাকঘর কর্মচারিদের বেতন ও প্রাতিষ্ঠানিক বিভিন্ন খরচ বাবদ মোট ব্যয় যেমন উল্লেখ করা হয়নি, তেমনি (অন্যান্য বিষয়গত প্রসঙ্গ থাক) গঙ্গাজল বেচায় নামতে হল কেন তার কারণ দর্শানোর জন্য কোনও লোকসানের চাপ সামলানোর গল্প শোনানো হয়নি। অথচ এইতালে গঙ্গাজল বিকিকিনির কাউন্টার খুলে বসা হল কেন? প্রশ্নের মুখ বন্ধ করতে কর্তৃপক্ষ ডাকঘরের এই নতুন জানালা খোলার লাভজনক দিকটি উল্লেখ করতে ভোলেননি। গত আর্থিক বছরে (২০২১-২২) গঙ্গোত্রী, হরিদ্বার ও ঋষিকেশের প্রায় ৪ লক্ষেরও বেশি গঙ্গাজলের বোতল ডাকঘর থেকে বিক্রি করে সার্কল আয় করেছিল আনুমানিক ১৭ লক্ষ টাকা। এবার কলকাতার জিপিও’তে এর কাউন্টার প্রথমে খোলা হল। এরপর ক্রমশ রাজ্যের ৪৮টি প্রধান ডাকঘরে তা চালু করা হবে, চূড়ান্ত লক্ষ্যমাত্রায় থাকবে ১১০০টি ছোট ডাকঘর।

তবে কলকাতার জিপিও সহ সমস্ত শাখায় এবং রাজ্যের যেখানেই হোক নাগরিক-নজরদারিতে বড়-ছোট ডাকঘর ব্যবস্থার মূল সমস্যা হল — যে কোন পরিষেবা পেতে নাজেহাল হতে হয়, হয়রানির শেষ থাকে না। রেজিস্ট্রি, স্পিড পোস্ট, পার্সেল, বিভিন্ন সঞ্চয় প্রকল্প, আধার কার্ড তৈরি ইত্যাদি যে কোনো দরকারে ঢোকা হোক, ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেগে যায়। কাউন্টারের বাইরে লাইনে যত ভীড়, ভিতরে তত স্টাফ কম। একজন স্টাফকে দিয়ে একাধিক রকমের কাজ করানো হয়। কোনো আইটেমের কাজ টিফিন টাইমের পরে আর হয় না। কোথাও বা সঞ্চয় প্রকল্পের আপ-ডেট কেবল সপ্তাহের শেষ দিনে হয়। কর্মচারি পদ তুলে দেওয়ার পলিসিই প্রধানত চলছে, অবসরগ্রহণের পর সেইসব পদে নতুন নিয়োগ হয় নামেমাত্র। তার মধ্যে আবার বেশিরভাগই চুক্তিভিত্তিক বেতনে বা দৈনিক মজুরিতে। এভাবে পরিষেবা দেওয়ার আগ্রহ কত আর থাকে। কত আর দক্ষতা অর্জন করার ইচ্ছা জাগে। এই সবকিছুর যোগফলে ইচ্ছানিরপেক্ষভাবে ডাক পরিষেবা প্রদানের মান আদৌ সন্তোষজনক নয়। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এসব কিছুই স্বীকার করেন না, তারা কাজের মানের মূল্যায়ন করেন নিজেদের মতো করে, নাগরিকের চোখ দিয়ে নয়।

আসা যাক আলোচনার শেষ ও মূল পয়েন্টে। এতকিছু থাকতে গঙ্গাজল ব্যবসা চালু করা হল কেন? প্রশ্নটা সরাসরি মোদী সরকারকে তাক করে। সাফ কথা হল, এক্ষেত্রে সংখ্যাগুরু হিন্দু সম্প্রদায়কে সামাজিকভাবে তুষ্ট করার ইচ্ছাই ধরা পড়ছে। কারণটা সবার জানা। জাত-বর্ণ নির্বিশেষে হিন্দু সম্প্রদায়ের যে কোনও পূজা পাঠ, গৃহপ্রবেশ থেকে শুরু করে শেষকৃত্যে এবং নানা শুদ্ধি-পবিত্রতা উপলক্ষে ছেঁটাতে গঙ্গাজল লাগে। আর, পরোক্ষে এই ভাবের আবেগে হিন্দুত্বের সুড়সুড়ি দিতেই ‘গঙ্গোত্রী’-‘ঋষিকেশ’-‘হরিদ্বার’ নানা ব্র্যান্ডের বোতলে পোরা গঙ্গাজল বিক্রির ফন্দি আঁটা। গঙ্গাভাঙনে, গঙ্গাদূষণে, গঙ্গার অবরুদ্ধতায় যে মোদী সরকারের সহসা ঘুম ছোটে না, সেসবের প্রতিকার ব্যবস্থা নেওয়ার নামে কেন্দ্রীয় বাজেটে যেখানে বরাদ্দ হয় ছিটেফোঁটা মাত্র, যা নিয়ে বেশিরভাগই লুটপাট ভাগ বাটোয়ারার দুর্নীতি চলে মন্ত্রী-আমলা-ঠিকেদারদের যোগসাজশে, তারাই তৎপর হয়েছে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে ডাকঘর ব্যবস্থার মাধ্যমে গঙ্গাজল বোতলে পুরে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেদের কাছে বেচতে। এতে আখেরে প্রত্যক্ষভাবে রাজকোষে কিছু অর্থ আসার সাথে সাথে পরোক্ষে সমাজের সংখ্যাগুরু অংশকে হিন্দুত্বের রাজনীতির জালে টেনে নেওয়া সম্ভব হলেও হতে পারে। এটাই সবচেয়ে সম্ভাব্য বিশেষ লক্ষ্য ও পরিকল্পনা। এখনই নিশ্চিত বোঝা সম্ভব নয় এরও আবার বেদখল বেসরকারি হাতে যাবে কিনা! এটাও দেখতে হবে কিনা ‘কাচ্চি ঘানি সর্ষের তেলে’র মতো ‘পাক্কি শুদ্ধ্ গঙ্গা পানি’র প্যাক করা বোতলের কর্পোরেট হাতছানি!

(সমাপ্ত)

খণ্ড-30
সংখ্যা-23