সুখ নাহি... জয়, জয় চেয়েছিনু আমি
i-want-to-win-win

ধৃতরাষ্ট্রের প্রশ্নের উত্তরে দুর্যোধন বলেছিলেন, “সুখ চাহি নাহি মহারাজ। জয়, জয় চেয়েছিনু আমি”।

আজ তিনি জয়ী। জয় তিনি চেয়েছিলেন, একছত্র নিরঙ্কুশ জয়। নীতি, নৈতিকতাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে, পঞ্চায়েত নির্বাচনের সোপানতলে তরতাজা সহনাগরিকদের হত্যা করে গ্রামীণ ক্ষমতাপাটে আসীন হয়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বুঝি দুর্যোধনের কথাগুলোকেই প্রতিধ্বনিত করলেন! তিনি চেয়েছিলেন জয়। নিরঙ্কুশ জয় ও বিরোধী পরিসরকে সংকুচিত করার দাপট ছিল তাঁর অভিষ্ঠ লক্ষ্য। সাথে ক্ষমতা প্রদর্শনের কুৎসিত উচ্ছাস। কত প্রাণের বিনিময়ে, কত রক্তস্রোতে, কত স্বজনহারার আর্ত কান্নার পথ ধরে সেই জয় আসবে, তার জন্য বিন্দুমাত্র চিন্তিত নন রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান।

নিহত মানুষদের পরিবারকে দু’লক্ষ টাকার ‘ক্ষতিপূরণ’, হোমগার্ডে ‘চাকরি’র মতো কিছু খুঁদকুড়ো ছড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী পাপস্খলন করার জন্য কিছু সরকারি ঘোষণা করলেন মাত্র।

মৃতের সংখ্যা নিয়ে তরজা শুরু হয়েছে। অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছরে খুনোখুনি কম না বেশি তা নিয়ে চলছে নির্লজ্জ বাছবিচার। আর এর মধ্যেই নির্বাচনী চূড়ান্ত ফলাফল নিয়ে মামলা ও কলকাতা হাইকোর্টের হস্তক্ষেপে গোটা বিষয়টাই চলে গেল পরবর্তী রায় ঘোষণার উপর — এককথায় যা নজীরবিহীন!

আগামী বছরে লোকসভা নির্বাচনের আগে গ্রাম বাংলায় কার রাজনৈতিক আধিপত্য বজায় থাকবে — এই শক্ত চ্যালেঞ্জ ছিল শাসক দলের কাছে। দুর্নীতির নানা অভিযোগে বিদ্ধ রাজ্যের শাসক দলের ডাকাবুকো নেতা, শিক্ষা জগতের একের পর এক অধিকর্তা যখন জেলে, অত্যন্ত সক্রিয় কেন্দ্রীয় এজেন্সি শকুনের চোখ দিয়ে নজরদারি ও হস্তক্ষেপ যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে গেছে, অতি তৎপর আদালতের একের পর রায় যখন রাজ্য সরকার পর্যুদস্ত, ১০০ দিনের প্রকল্পে বিরাট মজুরি বকেয়া — আর, নানান ঘটনায় রাজ্যে শাসকের ভাবমূর্তি যখন তলানিতে, এই রাজনৈতিক আবহে পঞ্চায়েত নির্বাচন এক বিরাট গুরুত্ব নিয়ে এ রাজ্যে হাজির হয়। আজ্ঞাবহ এক নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে তড়িঘড়ি নির্বাচনী নির্ঘণ্ট প্রকাশ করে বিরোধী দলগুলোকে বেকায়দায় ফেলা থেকে শুরু করে প্রথম থেকেই রাজ্য সরকারের নানা পদক্ষেপ উত্তেজনার পারদ বাড়াতে যথেষ্ট রসদ জুগিয়েছিল। যত দিন গেছে, ততই উলঙ্গ হতে শুরু করে নির্বাচন কমিশনের তথাকথিত নিরপেক্ষ ভূমিকার শেষ কৌপিনটুকুও।

সদ্য সমাপ্ত পঞ্চায়েত নির্বাচনের অনুপুঙ্খ বিচার বিশ্লেষণ এখনও অনেক বাকি। কিন্তু যে বার্তাটি বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠল তা হল, রাজ্যের তৃণমূল-বিজেপি-র তৈরি করা দিত্ব বা বাইনারির ভাষ্যের বাইরেও আরেকটি পরিসর গড়ে উঠছে। বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ সহ তৃতীয় এক শিবির, তৃণমূলের বিরুদ্ধে যারা অনেক জায়গায় গড়ে তুলেছেন শক্ত প্রতিরোধ। নিহত সহনাগরিকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে তরুণ সংখ্যালঘু যুবক, যা বুঝিয়ে দিচ্ছে সংখ্যালঘুদের মধ্যে থেকেই কিছু প্রতিরোধ শুরু হয়েছে রাজ্যের শাসকের বিরুদ্ধে — যে সামাজিক অংশটি এতদিন ছিল তৃণমূলের শক্ত পোক্ত ভিত্তি। তৃণমূলের দু’জন সংখ্যালঘু বিধায়ক এবার প্রথম থেকেই দলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন। জনজাতি, মতুয়া, রাজবংশীদের মধ্যে বিজেপি-র ফাটল ধরা শুরু হয়েছে। ২০১৮-তে একতরফা যে বিপুল মাত্রায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তৃণমূল জিতেছিল, এবার সেখানে রাশ টানা গেছে।

রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে বিপুল সংখ্যক কৃষকের জমি হারানো ও তারই হাত ধরে দ্রুত গতিতে কৃষকদের সর্বহারাকরণ, কৃষিকাজে আগ্রহ হারানো তরুণ গ্রামীণ যুবকের এক বিরাট অংশ রুটি রুজির সন্ধানে পরিযায়ী হওয়া, কৃষি অর্থনীতির প্রধান স্থান দখল করে নেওয়া অ-কৃষিকাজ, মুখ থুবড়ে পড়া একশ দিনের কাজ, এই সমস্ত প্রবণতার পাশাপাশি খুঁজতে হবে কোন রাজনৈতিক শ্রেণিটি গ্রামবাংলায় আজ পঞ্চায়েতকে কুক্ষিগত করেছে, আর ঠিক কোন আর্থিক রাজনৈতিক স্বার্থকে ধরে রাখতে এত মরিয়া, বেপরোয়া হয়ে উঠেছে তারা। তাদের বিরুদ্ধেই বা লড়াই হবে কিভাবে।

ভিন্ন সামাজিক রাজনৈতিক মেরুকরণকে বামপন্থার ইতিবাচক লক্ষে পরিচালিত করাই এখন সামনের দিনের দাবি।

খণ্ড-30
সংখ্যা-23