কিভাবে লুঠ করছে আদানি-আম্বানি-টাটারা
adania-ambani-tatar-are-looting

ভারতের ৫টি অতিকায় কর্পোরেটের সমষ্টিকে ভেঙে ফেলার ডাক এসেছে। না, কোনো নৈরাজ্যবাদী সংগঠনের তরফ থেকে নয়, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন ডেপুটি গভর্নর বিরল আচার্য এই আলোড়নকারী প্রস্তাব দিয়েছেন।

কয়েকমাস আগে, একটি পেপারে তিনি লেখেন, দেশের ৫টি অতিকায় কর্পোরেটের হাতে বিপুল ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। ওই ৫টি কর্পোরেট হল রিলায়েন্স গ্রুপ, আদানি, টাটা, আদিত্য বিড়লা গ্রুপ ও সুনীল মিত্তালের ভারতী টেলিকম গ্রুপ। তিনি লিখেছেন, বেছে বেছে ওই ৫টি কর্পোরেটের হাতে দেশের গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক কর্মকান্ডের ক্ষেত্রগুলোকে তুলে দেওয়া হচ্ছে অতি মুনাফা কামানোর লক্ষ্যে। ক্ষেত্রগুলো হল — সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, মেটাল ও নন-মেটাল খনিজ পদার্থ, কেমিক্যাল, পেট্রোলিয়াম, কাঠের উৎপাদিত পণ্য, খুচরো বাজার, টেলিকম। এই প্রথম, তথ্যভিত্তিক একগুচ্ছ পরিসংখ্যান তিনি দিয়েছেন যা দেখিয়ে দেয় ভারতবর্ষে ক্রোনি পুঁজিবাদ মোদীর স্নেহছায়ায় কিভাবে পল্লবিত হয়ে বিরাট এক মহিরূহে পরিণত হয়েছে।

দেখা যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় মোদী ২০১৫-১৬-তে আসার পর থেকেই ক্ষমতার ভারসাম্যে এই বদল শুরু হয়। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ও নির্মাণ ক্ষেত্রে ওই ৫টি অতিবৃহৎ কর্পোরেটের বাজারে মোট অংশীদারিত্ব ২০১৬-তে যা ছিল ৩১ শতাংশ, তা ২০২১-এ লাফ দিয়ে বেড়ে ৪২ শতাংশ হয়েছে। ওই একই সময়কালে টেলিকমিউনিকেশনে ৬৫ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৮৪ শতাংশ আর খুচরো ব্যবসায় ৪৪ শতাংশ থেকে ৬৫ শতাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিশোধিত পেট্রোলিয়াম ও কোকের উৎপাদিত ক্ষেত্র থেকে এই ৫টি অতিবৃহৎ কর্পোরেটের সম্মিলিত সম্পদের পরিমাণ লাফ দিয়ে বেড়েছে ৯০ শতাংশ, আর মৌলিক ধাতুর ক্ষেত্রে ৬৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

শুধুমাত্র উল্লিখিত ক্ষেত্রগুলোতেই নয়, এই ৫টি কর্পোরেট এবার ৪০টি অর্থনৈতিক বহির্ভূত ক্ষেত্রেও (নন ফাইনান্সিয়াল) পা রেখেছে। গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামোর ক্ষেত্রেও হাত বাড়িয়েছে, যেমন, বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর, বিদ্যুৎ সংবহন, শহরের গ্যাস বণ্টন, পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তি এমনকি ট্রেনের টিকিট কাটা। অর্থনীতির মূল ধমনী, সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোকে নিজেদের মুঠোয় এনে এই কর্পোরেটগুলো প্রতিযোগিতাকে গিলে খেয়ে নিজেদের শর্তে দামকে নিয়ন্ত্রণ করছে, যা অর্থনৈতিক জগতে জঘন্য এক বাণিজ্যিক কৌশল। ফলে, উপভোক্তাদের ওই পাঁচটি কর্পোরেটের দয়ার উপর নির্ভর করে থাকতে হচ্ছে। নিজেদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে প্রতিযোগী ও প্রতিদ্বন্দ্বী বিমান সংস্থাগুলো পরিষেবার ক্ষেত্রে মাশুল অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রতিযোগিতার অভাবে এবং ৫জি পরিষেবা প্রবর্তনের পর টেলিকমের মাশুলও বেড়ে চলেছে অস্বাভাবিক হারে।

মোদীর শাসনকালে এই ৫টি কর্পোরেটকে কেন্দ্র করে দেশের এই চূড়ান্ত শিল্পীয় কেন্দ্রীভবন প্রতিযোগিতাকে অবলুপ্ত করেছে, যা পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মবিরুদ্ধ। এই গুটিকয় সংস্থাগুলো সমগ্র শিল্পক্ষেত্রের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করছে। সেগুলোর সমস্ত উৎপাদিত পণ্য পরিষেবার দাম নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার অগাধ ক্ষমতা এরা ভোগ করে থাকে। এরাই নিজেদের ইচ্ছেমতো দাম নির্ধারণ করে যা উপভোক্তারা দিতে বাধ্য হন। প্রাক্তন ডেপুটি গভর্নর বিরল আচার্য দেখিয়েছেন, দেশে লাগামছাড়া কোর ইনফ্লেশনের জন্য এই ৫টি সংস্থাই দায়ী। অর্থনৈতিক পরিভাষায় কোর ইনফ্লেশন হল সেই মুল্যস্ফীতি যা উপভোক্তা মূল্যসূচকের (কনজিউমার প্রাইস ইন্ডেক্স) উপর ভিত্তিশীল। খাদ্যদ্রব্য ও জ্বালানির অত্যন্ত গতিশীল দাম এরমধ্যে ধরা হয় না। এই ইনফ্লেশনের মধ্যে চলে আসে সমস্ত ধরনের পণ্য ও পরিষেবার দাম বা মূল্য।

বিগত কয়েক বছর যাবত, কোভিড-উত্তরকাল, ইউক্রেন যুদ্ধ প্রভৃতির কারণে বিশ্ব জোগান শৃঙ্খল রীতিমতো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আবহে আমাদের দেশেও মূল্যস্ফীতি মাথা তুলেছে। পরিসংখ্যানই বলছে, ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬.৪ শতাংশ, যা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ৪ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা থেকে অনেকটাই বেশি, আরবিআই’এর ৬ শতাংশ সহনসীমাকেও ছাড়িয়ে যায়। প্রাক্তন ডেপুটি গভর্নরের মতে, “সচেতন ভাবে কেন্দ্রীয় সরকার তার শিল্পনীতির এমন এক অভিমুখ তৈরি করেছে, যার লক্ষ্যই হল জাতীয়ক্ষেত্রে এদের ‘চ্যাম্পিয়ান’ বানানো, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে স্যামসঙ’এর মতো দৈতাকৃতি সংস্থার সমকক্ষ করা” আর এর ফলাফলও আর্থিক দিক থেকে ভয়াবহ হচ্ছে। বেশ কিছু পণ্যের আমদানির উপর কেন্দ্রীয় সরকার বিপুল মাশুল ধার্য করে অনেক বিদেশি সংস্থাকে ভারতের বাজারে ঢোকার পথে বাধা তৈরি করেছে যাতে ওই ৫টি সংস্থাই জাতীয় ক্ষেত্রে চ্যাম্পিয়ান হয়ে ওঠে। আর এই সুযোগে তারাও সেই সমস্ত পণ্য পরিষেবার দাম ও মাশুল ক্রমাগত বাড়িয়ে চলেছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বা দেশীয় বাজারে বেশ কিছু পণ্য পরিষেবার ইনপুট খরচ কমা সত্ত্বেও দেশের উপভোক্তারা তার কোনো সুফল পান না। গতবছর আন্তর্জাতিক জোগান শৃঙ্খল অনেকটা স্বাভাবিক হলেও ভারতীয় উপভোক্তাদের অনেক বেশি দামে তা ওই ৫টি কর্পোরেটদের কাছ থেকে কিনতে হয়েছে। আর এরই হাত ধরে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে কোর ইনফ্লেশন। একটানা প্রায় ১৭ মাস ধরে তা বেড়েছে। এই অতিবৃহৎ ৫টি সংস্থার সার্থে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক ঢালাও ঋণ দিচ্ছে পরিশোধের আশা ছেড়ে, বন্ড মার্কেট তার নিয়মনীতিকে শিথিল করছে, বিভিন্ন সরকারি বরাত পাইয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে খিড়কি দরজা দিয়ে অনেক সুযোগ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, আমদানি-রপ্তানি নীতি এই কর্পোরেটদের স্বার্থেই তৈরি হচ্ছে। ফলস্বরূপ ব্যাঙ্কগুলোর অনাদায়ী পুঁজির পাহাড় ক্রমেই পুঞ্জিভূত হচ্ছে। খোদ রিজার্ভ ব্যাঙ্কই দিন কয়েক আগে জানিয়েছে, গত দশ বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলো ১৫.৩১ লক্ষ কোটি টাকার বকেয়া বা অনাদায়ী পুঁজি মুছে ফেলেছে। শুধুমাত্র ২০২২-২৩-এ ব্যাঙ্কগুলো মুছে দিয়েছে কর্পোরেট জগতের কাছ থেকে তাদের প্রাপ্যের ২.০৯ লক্ষ কোটি টাকা। পারিবারিক সদস্যকে সংস্থার শীর্ষপদে বসিয়ে রাখায় এদের আর্থিক-ব্যবসায়িক স্বচ্ছতা থাকে না। পরিচালন পদ্ধতিও খুবই জটিল। এই সমস্ত কারণেই বিরল আচার্য ৫টি কর্পোরেট সংস্থাকে নিয়ে গড়ে তোলা শিল্পীয় কেন্দ্রীভবনকে ভেঙে ফেলার প্রয়োজন বলে জোরালো সওয়াল করেছেন।

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ নৌরিয়েল রৌবিনি, যিনি নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টার্ণ স্কুল অফ বিজনেস’এর এমেরিটাস অধ্যাপক, সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেই বসেছেন যে ভারত এক বিপজ্জক বাঁকের মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তিনিও ওই ৫টি কর্পোরেট সংস্থার দিকে আঙুল তুলে বলেছেন যে এরাই নীতি প্রণয়নকে প্রভাবিত করছে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে। তারাই ভারতের শিল্পক্ষেত্রে যেকোনো নতুন উদ্ভাবনকে গলা টিপে মারছে, একদম প্রথমাবস্থায় স্টার্টআপগুলোকে হত্যা করছে, তাদের এক্তিয়ারভুক্ত গুরুত্বপূর্ণ শিল্পক্ষেত্রে নতুন কোনো দেশীয় শিল্পের অনুপ্রবেশকে আটকে দিচ্ছে, কেন্দ্রীয় সরকারের ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ কর্মসূচীকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করছে, রক্ষণশীল ও নিজেদের স্বার্থে সুরক্ষা কবচমূলক নীতি প্রণয়নে পরিচালিত করছে।

অধ্যাপক ১৯৮০-১৯৯০-এ এশিয় শার্দুলদের অভিজ্ঞতা সামনে এনে বলেছেন, সেই সময়ে উৎপাদিত পণ্যের রপ্তানির উপর মূল জোর দেওয়ার মডেল অনুসরণ করে ওই দেশগুলোর বিরাট আর্থিক শ্রীবৃদ্ধি হয়। কিন্তু পরবর্তীতে মুখ থুবড়ে পড়া ওই মডেল এই শিক্ষা দিল যে ক্রোনি পুঁজিবাদ যদি অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণ করতে শুরু করে তবে সুস্থ প্রতিযোগিতার অভাবে দেশীয় অর্থনীতির উৎপাদনশীল বিকাশ রুদ্ধ হবে, বৈষম্য ক্রমেই চওড়া হবে, সংকটের আবর্তে ঘুরপাক খাবে দেশের অর্থনীতি।

মোদীর শাসনকালে সাঙাতি পুঁজিবাদ বা ক্রোনি পুঁজিবাদকে রাষ্ট্রীয় মদতে চরম সীমায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। শিল্প অর্থনীতির এই চূড়ান্ত আর্থিক কেন্দ্রীভবনের উপর ভিত্তি করেই উত্থান হয়েছে ভারতীয় ফ্যাসিবাদ — মোদী সরকার যার ইউনিক প্রতিনিধি।

- অতনু চক্রবর্তী

খণ্ড-30
সংখ্যা-25