জাতীয় সঙ্গীতের সময় উঠে না দাঁড়ানো কি অপরাধ?
national-anthem

এই প্রশ্নটি মাঝে মধ্যেই ঘুরে ফিরে আসছে। এবার আবার এই বিতর্কটা সামনে এল কাশ্মীরের একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে।

ইতিহাসবিদ্ অধ্যাপক সুগত বসু-র একটি লেখা থেকে জানা যায়, স্বয়ং মহাত্মা গান্ধী জাতীয় সঙ্গীতের সময় কখনই উঠে দাঁড়াতেন না, কারণ তিনি মনে করতেন এটা এক ঔপনিবেশিক সময়ের রেওয়াজ। কিন্তু, এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিতর্ক থেকেই গেছে।

২৫ জুন শ্রীনগরে একটি অনুষ্ঠানে জম্মু কাশ্মীরের উপ রাজ্যপাল মনোজ সিংহ-র উপস্থিতিতে একটি সরকারি অনুষ্ঠানে ১১ জন কাশ্মীরী জাতীয় সঙ্গীত চলাকালীন উঠে না দাঁড়ানোয় শ্রীনগরের পুলিশ তাঁদের নিজেদের হেফাজতে নেয়। পরে, শ্রীনগরের একজিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট তাঁদের সাত দিনের জন্য জেলে পাঠিয়ে ফৌজদারি আইনের ১০৭/১৫১ ধারায় মামলা চালাবার জন্য নির্দেশ দেন। নির্দেশ দেওয়ার সময় এই মন্তব্য করা হয় যে “শান্তি শৃঙ্গলা ভঙ্গের খুবই সম্ভাবনা ছিল তাঁদের ওই কার্যকলাপের মধ্যে”।

জাতীয় সঙ্গীতকে অসম্মান করা সংক্রান্ত একটি মামলা হয়, যার উপর সুপ্রিম কোর্ট ১৯৮৬-তে একটি রায় দেয়। বিজৈ এম্যানুয়াল ও অন্যান্য বনাম কেরল রাজ্য ও অন্যান্যর যে মামলা চলে, তার উপর শীর্ষ আদালত এক রায় দেয়। বিজৈ এম্যানুয়াল, বিনু এবং বিন্দু — এই তিনজন যথাক্রমে ক্লাস ১০, ক্লাস ৯ এবং ক্লাস ৫ এর এক হিন্দু সংগঠন নায়ের সার্ভিস সোসাইটির পড়ুয়া ছিলেন। স্কুলে জাতীয় সঙ্গীত যখন শুরু হয়, তখন ওই তিনজন তাতে অংশ নেয়নি। এই ‘অপরাধে’ ওই তিনজন পড়ুয়াকে স্কুল কর্তৃপক্ষ বহিষ্কার করেন। তাঁদের অভিভাবক হাইকোর্টে আবেদন করেন যে তাঁরা মিলেরিয়ান ক্রিশ্চান ধর্মের এক অত্যন্ত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় জিহোভা উইটনেস ভুক্ত। তাঁদের ধর্মমতে তাঁরা একমাত্র জিহোভাকেই (ঈশ্বরের হেব্রু নামকরণ) আরাধনা করতে পারেন। যেহেতু জাতীয় সঙ্গীত আরাধনার পর্যায়ে পড়ে, তাঁদের সন্তান সেই সঙ্গীতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে উঠে দাঁড়ায়, কিন্তু গলা মেলায়নি। কিন্তু কেরল হাইকোর্ট অভিভাবকদের আবেদন খারিজ করে স্কুল কর্তৃপক্ষের বহিষ্কারের সিদ্ধান্তকেই শিলমোহর দেয়। এর বিরুদ্ধে তাঁরা সুপ্রিম কোর্টে যান।

সুপ্রিম কোর্ট কেরল হাইকোর্টের রায়কে খারিজ করে পড়ুয়াদের পাশে দাঁড়ায়। ১১ আগস্ট, ১৯৮৬-র ওই আদেশে শীর্ষ আদালত জানায়, সংবিধানের ২৫নং ধারায় নিজ নিজ ধর্মমতকে অনুসরণ, তার প্রচার করার মৌলিক অধিকার বিধৃত রয়েছে। কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায় যতই প্রান্তিক, অপাঙতেয় ও ক্ষুদ্র হোক না কেন, নিজ নিজ ধর্মীয় পরিচিতি ও স্বাতন্ত্র্যকে বজায় রাখার অধিকার সংবিধান তাঁদের দিয়েছে। যেহেতু জাতীয় সঙ্গীতের সময় পড়ুয়ারা শ্রদ্ধার সাথে উঠে দাঁড়ায় কিন্তু গলা মেলাননি, তাই এটা সাব্যস্থ হচ্ছে যে কোনো গোলমাল বা অশান্তি সৃষ্টি করা তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল না। তাঁরা কাউকে তাঁদের মতো অনুসরনে বাধাদান করেনি। উল্টে, নিজেদের ধর্মবিশ্বাসকে, নিজ নিজ ধর্মাচরণকে পালন করার জন্য তাঁদের যেভাবে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হল, তা ধর্মীয় স্বাধীনতা অনুসরনের বিরুদ্ধে, মৌলিক অধিকারের বিরুদ্ধেই গেছে।

জাতীয় সঙ্গীত সংক্রান্ত আরেকটা মামলা হয় ৩০ নভেম্বর, ২০১৬ সালে। শ্যাম নারায়ণ চোকস্কি বনাম কেন্দ্রীয় সরকার মামলায় সুপ্রিম কোর্ট এক অন্তর্বর্তী আদেশে বলে, “ভারতের সমস্ত সিনেমা হলগুলো চিত্র প্রদর্শনী শুরু করার আগে জাতীয় সঙ্গীত বাজাবে এবং উপস্থিত সমস্ত দর্শকদের উঠে দাঁড়িয়ে জাতীয় সঙ্গীতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে হবে।” আদালত আরও বলে, “জাতীয় সঙ্গীত বাজানোর সময় হলের সমস্ত প্রবেশ ও নিষ্ক্রমণপথ বন্ধ রাখতে হবে, আর জাতীয় সঙ্গীতের সাথে জাতীয় পতাকাকেও পর্দায় দেখাতে হবে”। কিন্তু, ৯ জানুয়ারি, ২০১৮-তে শীর্ষ আদালত তার আগেকার অন্তর্বর্তী আদেশের কিছু পরিমার্জন করে।

পরিমার্জিত আদেশে সুপ্রিম কোর্ট বলে, “চিত্র প্রদর্শনীর আগে জাতীয় সঙ্গীত বাজানো সিনেমা হলগুলোর কাছে ঐচ্ছিক, তা বাধ্যতামূলক নয়।”

২০১৬-র আদালতের অন্তর্বতীকালীন রায়কে পরিমার্জিত করার পেছনে ছিল সরকারি এক সিদ্ধান্তের ঘোষণা। তাতে জানানো হয়, সরকার এক ১২ সদস্য বিশিষ্ঠ আন্তঃমন্ত্রক কমিটি গঠন করেছে, যার কাজ হল, বিভিন্ন হল ঘরে বা অনুষ্ঠানগুলোতে জাতীয় সঙ্গীত বাজানো বা গাওয়ার সময় কি গাইডলাইন অনুসরণ করা হবে, তা সূত্রবদ্ধ করা।

(সূত্র : ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ৮ জুলাই)

খণ্ড-30
সংখ্যা-23