হীরক দ্যুতির উল্টো পিঠে দুর্দশার পাঁচালি
the-panchali-of-misery

কৃত্রিম হীরা! সিন্থেটিক হীরা!
 
সারা দেশের মানুষ পরিচিত হলেন ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা কৃত্রিম হীরার সঙ্গে, যখন ফলাও করে খবরে প্রকাশ পেল দেশের প্রধানমন্ত্রী তাঁর আমেরিকার রাষ্ট্রীয় সফরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির স্ত্রী জিল বাইডেনকে উপহার দিচ্ছেন ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা অভিনভ সবুজ রং’এর ৭.৫ ক্যারাটের এক হীরা। আর, এই বিশেষ উপহার দেওয়ার মধ্য দিয়ে তিনিই হয়ে উঠলেন ওই হীরার প্রথম ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর।

কিন্তু, এই কৃত্রিম হীরার উল্টো পিঠে যে হাহাকার, কান্না, আত্মঘাতী হওয়ার করুণ কাহিনী নীরবে লেখা হচ্ছে লোকচক্ষুর অন্তরালে, তা আজ ক্রমশ ভারী হয়ে আকাশে বাতাসে অনুরণিত হয়ে চলেছে।

গুজরাতের সুরাটে রয়েছে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ হীরা শিল্প। ভারত থেকে ৯০ শতাংশ হীরা রপ্তানি হয় এখান থেকে, আর ৮০ শতাংশ পালিশ করা হীরা সারা বিশ্বে যায়। এই শিল্পটি পুরোপুরি রপ্তানি নির্ভর, কারণ এর আভ্যন্তরীণ বাজার নেই বললেই চলে। রপ্তানি নির্ভরতার কারণে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির উপরই এই শিল্পের ভাগ্য জড়িয়ে রয়েছে। সম্প্রতি, এই হীরা শিল্প বড় ধরনের এক সংকটের শিকার। কর্মচ্যুত কর্মীদের আত্মঘাতী হওয়া, বেঁচে বর্তে থাকতে বাধ্যতামূলকভাবে বেতন সংকোচন মেনে নেওয়া, বিনা বেতনে ‘ছুটি’তে চলে যাওয়ার পাশাপাশি ব্যাপক হারে এই শিল্পে চলছে কর্মী সংকোচন। বর্তমানে, অজানা অচেনা নতুন এক প্রতিদ্বন্দ্বীর পাল্লায় পড়ে ভারতের সবচেয়ে পুরাতন হীরা শহরটিতে খেলার নিয়ম কানুনই আজ বদলে যাচ্ছে দ্রুত গতিতে। আর, নতুন এই প্রতিদ্বন্দ্বী হল সিন্থেটিক হীরা, বা ল্যাবরেটরিতে প্রস্তুত হীরা। এই নতুন ‘জাতের’ হীরাকে কেটে ডিজাইন করতে শ্রম সময় ও শ্রমিক সংখ্যা একই লাগলেও বাজারে এর মূল্য আসল হীরার থেকে অনেক অনেক কম। আর এইজন্য, গোটা শিল্পটাই এখন নতুন ও পুরাতনে বিভাজিত হয়ে যাচ্ছে। জিল বাইডেনকে মোদীর কৃত্রিম হীরা উপহার স্বরূপ দেওয়ার পরপরই এই রত্নালঙ্কারের চাহিদা বাড়তে শুরু করেছে। ইতিমধ্যেই এই হীরার বৃহত্তম আন্তর্জাতিক বাজার হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউনাইটেড আরব এমিরেটস (ইউএই) ও চীন। ২০১৮ থেকেই এই কৃত্রিম হীরার বাজার চনমনে হতে শুরু করে। তারপর এর বাজার সাত গুণ বৃদ্ধি পায়। অতিমারির সময়ে রপ্তানিতে ধাক্কা নামলেও তার প্রকোপ কেটে গেলে ভারত ২০২১-২২এ ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা হীরা রপ্তানি করে ১.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যে, যা ২০২০-২১’র সাপেক্ষে ১০৬.৪৬ শতাংশ বৃদ্ধি। কিন্তু ভারতীয় বাজারে এর চাহিদা নেই বললেই চলে। সুরাটের গ্রিন ল্যাব ডায়মন্ড’এর কর্ণধার সঙ্কেত পাটেল, মনে করেন, “আজকাল মানুষ বুঝে শুনে খরচ করে, আর এই কৃত্রিম হীরা হল তাঁদের কাছে এক বিকল্প। যেহেতু কৃত্রিম হীরা আর আসল হীরা দেখতে অবিকল এক, তাই কেউ এখন আর এটা নিয়ে মাথা ঘামায় না, যে কোনটা আসল আর কোনটা ল্যাবে তৈরি করা।”

মস্কো থেকে নিউ ইয়র্ক, বেলজিয়াম থেকে বেজিং — হীরা আর সুরাট একই নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হোত। কিন্তু, সাত লক্ষের আশপাশে কর্মরত হীরা শ্রমিক, যারা বিশ্বের ৮০ শতাংশ হীরা কেটে পালিশ করেন, তাঁদের জীবনে, দিনযাপনে নেমে এসেছে ঘোর অন্ধকার। গত তিন মাসের মধ্যে আটজন হীরা শ্রমিক আত্মঘাতী হয়েছেন, ১৫,০০০ শ্রমিক কাজ খুইয়েছেন, আর বিগত পাঁচ বছরে এই শিল্পটি বছরে ১৫-২০ শতাংশ লোকসানের মুখোমুখি হয়েছে। ২০১৮ থেকেই সংকটের কালো মেঘ ঘনিয়ে ওঠে, কিন্তু ক্রমবর্ধমান ল্যাবরেটারিতে তৈরি কৃত্রিম হীরা, রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ, বাণিজ্যিক টানাপোড়েন, পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোতে আকাশছোঁয়া মূল্যস্ফীতি প্রভৃতি কারণগুলো এই শিল্প জুড়েই বড় ধরনের সংকট ডেকে এনেছে। এ’বছর এপ্রিল থেকে জুনের মাঝামাঝি পর্যন্ত অন্ততপক্ষে ৮ জন শ্রমিক আত্মঘাতী হয়েছেন তীব্র অভাবের সাথে যুঝতে না পেরে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত সরকারী ভাবে জানা যাচ্ছে না ঠিক কতজন শ্রমিক আত্মঘাতী হয়েছেন, কতজনই বা পড়েছেন ছাঁটাইয়ের কবলে। সম্প্রতি, জি-৭’র বৈঠকগুলোতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় সংকট আরও ঘনীভূত হল। কারণ এই দেশটি ভারতের হীরার এক বেশ বড় খরিদ্দার। বেশ কিছু কারখানায় শ্রমিকরা দৈনিক মজুর হিসাবে কাজ করেন, যাদের মজুরি ঘণ্টা পিছু।

শিল্পের চলমান সংকটের জন্য মালিকরা কাজের সময় কমিয়ে দেওয়ায় তাঁদের মজুরিও সংকুচিত হচ্ছে। কিছু কিছু কারখানার মালিকরাই স্বীকার করেছেন যে এরফলে যারা আগে ২৫,০০০ টাকা রোজগার করত, তাঁদের মজুরি হ্রাসপ্রাপ্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে ১৪,০০০ থেকে ১৫,০০০ টাকায়। এই হ্রাসপ্রাপ্ত মজুরির ফলে শ্রমিকরা তাঁদের সন্তানদের স্কুলের মাইনে দিতে পারছেন না, বকেয়া হয়ে যাচ্ছে বিদ্যুতের বিল, রোজকার দু’বেলা খাওয়া দাওয়ায় টান পড়ে যাচ্ছে। অভাবের তাড়নায় মহাজনদের কাছ থেকে উচ্চহারে সুদ সহ ঋণ নেওয়া, পরিশোধ করতে না পেরে আত্মঘাতী হওয়া — এই পাপচক্রেই তাঁদের জীবন আবর্তিত হচ্ছে। বেশ কিছু কারখানায় মালিক পক্ষ ছাঁটাই না করে শ্রমিকদের বিনা বেতনে মাসের পর মাস ‘ছুটিতে’ পাঠিয়ে দিচ্ছেন। এই সংখ্যাটা প্রায় ৩ লক্ষ। নিম্ন আয় সম্পন্ন ও বড় সংখ্যক পরিযায়ী শ্রমিকদের আধিক্য রয়েছে এই শিল্পে। গুজরাট শ্রম দপ্তরের পক্ষ থেকে হাজারে হাজারে আক্রান্ত শ্রমিকদের স্বার্থে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বিপুল মুনাফা অর্জনকারী এই শিল্পের শ্রমিকদের বড় একটা অংশই সামাজিক সুরক্ষার রক্ষাকবচ থেকে বঞ্চিত।

যে রপ্তানিমুখী শিল্পগুলোকে দেশের আর্থিক সমৃদ্ধির অন্যতম এক ইঞ্জিন হিসাবে মনে করে কর ছাড় থেকে শুরু করে শ্রম আইনের আওতার বাইরে নিয়ে আসা হয়, তারই অন্যতম এই হীরা শিল্পে নেমে আসা ঘোর দুর্দশায় সম্পদ সৃষ্টিকারী শ্রমিকরাই আজ নেইরাজ্যের বাসিন্দায় নিক্ষিপ্ত। মোদী-অমিত শাহ’র হীরক তৈরির রাজ্যে শ্রমিকরা কবে যে দড়ি ধরে মারবে টান, তার অপেক্ষায় থাকুক ভারতবাসী।

- অতনু চক্রবর্তী
(কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ দ্য প্রিন্ট.ইন, ২৫ জুন ২০২৩)

খণ্ড-30
সংখ্যা-22