সদ্য সমাপ্ত পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলাফল — একটি সংক্ষিপ্ত পর্যবেক্ষণ
elections-a-brief-observation

শাসক দলের বেলাগাম সন্ত্রাস, নির্বাচন কমিশনের নির্লজ্জ নিষ্ক্রিয়তা ও রাজ্য সরকার পরিচালিত পুলিশ বাহিনীর পুরোপুরি শাসকের আজ্ঞাবহ সন্ত্রাসের সহচরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে দশম পঞ্চায়েত নির্বাচন। চরম অরাজকতা ও বহমান সন্ত্রাসের অনুষঙ্গে ভোট গণনাপর্বও সাঙ্গ হয়েছে। অদ্যাবধি প্রাপ্ত হিসেব অনুযায়ী শাসক তৃণমূল কংগ্রেস মোট ভোটের ৫২.২২%, বিজেপি ২২.৬৯%, সিপিএম ১২.৫৪%, কংগ্রেস ১৩.৯৩% ও নির্দল প্রার্থীরা ৪.৭১% সংগ্রহ করেছেন। এই ভোটপ্রাপ্তির শতাংশের হিসেব চূড়ান্ত না হলেও এই তুলনামূলক সাফল্যের খতিয়ানের অদলবদল ঘটার সম্ভাবনা নেই। ভোট গণনার দিন দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার ভাঙড়ে পুলিশ, তৃণমূলের গুন্ডাবাহিনীর তাণ্ডবে আইএসএফের দু’জন (অসমর্থিত হিসাবে ৩ জন) কর্মীর মৃত্যু ঘটেছে। নির্বাচন কমিশন বহু কেন্দ্রে পক্ষপাতদুষ্ট ফলাফল প্রকাশ করেছে, এই অভিযোগে কলকাতা হাইকোর্টে রীট পিটিশনের সূত্রে আদালত জয়ী প্রার্থীদের বৈধতা খতিয়ে দেখার কথা বলে আগামী ২০ জুলাই অবধি নির্বাচনী ফলাফলের ওপর স্থগিতাদেশ জারি করায় রাজ্য রাজনীতির পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। বিধানসভায় প্রধান বিরোধী দল বিজেপি আদালতের সাহায্য নিয়ে ঘোলা জলে মাছ ধরতে উদ্যোগী।

ভোটের ফলাফলে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে যে তা অনস্বীকার্য। এতৎসত্ত্বেও নির্বাচনের সামগ্রিক ফলাফল প্রমাণ করেছে যে গ্রামবাংলায় শ্রেণিশক্তির ভারসাম্য এখনও শাসক তৃণমূলের পক্ষে দাঁড়িয়ে আছে। নির্বাচনী পরিসরে প্রধান বিরোধী দল হিসাবে বিজেপির ভোট প্রায় ১৫% হ্রাস পেয়েছে। রাজ্যে বিগত বিধানসভা নির্বাচনে সাফল্যের সূচকে ‘বিজেপির গড়’ হিসাবে বিজ্ঞাপিত উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গের জঙ্গলমহলে বিজেপির মোক্ষম শক্তিক্ষয় ঘটেছে। রাজবংশী জনজাতি ও আদিবাসীদের ভোট বিজেপির থেকে সরে গিয়ে তৃণমূলের বাক্সে জমা হয়েছে। ব্যাপক সন্ত্রাস, ভোট লুট, নির্বাচনী হিংসা ও হত্যার মহাভারত রচনা করলেও, মূলত তৃণমূল সরকার পরিচালিত স্বাস্থ্যসাথী, লক্ষ্মীর ভান্ডার, দুয়ারে সরকার, দুয়ারে রেশন প্রভৃতি জনতোষিনী সামাজিক প্রকল্পগুলি নির্বাচনী সাফল্যের অন্যতম ধারক হিসাবে মান্যতা পেয়েছে। অন্যদিকে রাজ্যের কয়েকটি প্রান্তে কংগ্রেস-আইএসএফ জোট বাধায় ভোটপ্রাপ্তির শতাংশ কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। বামফ্রন্টের প্রধান শরিক সিপিএম সহ অন্যান্য বাম গণতান্ত্রিক দলগুলি শাসকের তুমুল সন্ত্রাস ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে কেন্দ্রগুলিতে সাহসী প্রতিরোধ গড়তে সমর্থ হয়েছে, সেখানে বামেরা জনগণের সমর্থনে জয়ী হতে পেরেছে। লক্ষণীয় পরিবর্তন এই যে গ্রাম পঞ্চায়েতস্তরে শাসক তৃণমূলকে হারাতে বাম ও রামের অলিখিত জোটের যে অনৈতিক নজির আমরা পূর্ববর্তী নির্বাচনগুলিতে দেখেছি, এবারে এই অপকৌশল থেকে সিপিএমের গ্রামীণ নেতৃত্ব সরে আসতে বাধ্য হয়েছে। মুর্শিদাবাদ বা মালদা জেলায় বেগ পেতে হলেও সংখ্যালঘু ভোটের অধিকাংশ নিজেদের পক্ষে টানতে তৃণমূল সফল হয়েছে। মহিলা ও আদিবাসীদের বৃহদাংশ তৃণমূলের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। নির্বাচনী ফলাফলের অন্যতম ইতিবাচক প্রাপ্তি হল বিচ্ছিন্নভাবে হলেও বামেদের প্রতিরোধী প্রত্যয়ের মধ্যে দিয়ে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে উঠে আসার শর্ত তৈরি হয়েছে। বামেদের পক্ষে কিছুটা রাজনৈতিক পরিসর তৈরি হয়েছে। পক্ষান্তরে বিজেপির পায়ের নীচের মাটি অনেকটা আলগা হতে শুরু করেছে। রাজ্য জুড়ে একক ও যৌথ প্রচার ও নিরবচ্ছিন্ন গণআন্দোলনের অঙ্গনে কেবলমাত্র শাসকের দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের বিরোধীতাই নয়; গুরুত্বের সঙ্গে কৃষির সঙ্কট, প্রসারমান কর্মহীনতা, খাদ্য ও অপরিহার্য পণ্যের ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধি ও গণতান্ত্রিক অধিকাচ্যূতির মানচিত্রে জনতার জীবন, জীবিকা ও গণতান্ত্রিক অধিকারের পুন:প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বুনিয়াদি বামপন্থার সদর্প আত্মঘোষনার মাধ্যমে পালাবদলের লক্ষ্যে আমাদের কর্মীবাহিনীকে উদ্দীপিত ও উজ্জীবিত করার চ্যালেঞ্জ আমাদের নিতে হবে। আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগে স্বৈরাচারী তৃণমূল ও সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী বিজেপি-আরএসএসের বিরুদ্ধে ব্যাপকতম প্রতিরোধ গড়ে তুলতে রাস্তার লড়াইকে তীব্রতা দিতে হবে। আর এই লক্ষ্যে উপনীত হতে পার্টি সংগঠনকে জড়তা কাটিয়ে শক্তিশালী করার কঠিন কাজে আমাদের নেমে পড়াই এখন একমাত্র কর্তব্য।

- অভিজিত মজুমদার

খণ্ড-30
সংখ্যা-23