খবরা-খবর
ধনেখালি ব্লকের পঞ্চায়েত নির্বাচন ও ভোট গণনার কাহিনী
counting-of-votes

অতীতের অভিজ্ঞতা অত্যন্ত তিক্ত। তবুও ১১ জুলাই, মঙ্গলবার সাতসকালেই ধনেখালিতে টিম সিপিআই(এমএল) সদস্য প্রত্যেকে হাজির গণনা কেন্দ্রে। আমরা তিনটি ঘরে ছড়িয়ে পরলাম। ৮টায় গণনা শুরু করার নির্দেশ ছিল। প্রায় সাড়ে ৯টাতেও এই কাজ শুরু হল না; তখনও ব্যালট বাক্স আসেনি; অধিকাংশ প্রিসাইডিং-এর দেখা নেই! ব্যাপার কি! বোঝা গেল একটু পরেই।

হঠাৎ শুরু হল সমস্বরে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান। এসেছিস কেন, বেড়িয়ে যা, মার, বের করে দে — নানা কোণ থেকে গলা ফাটানো হুমকি ভেসে আসতে থাকল!

এখানে আসার সময় গণনাকেন্দ্রের প্রবেশপথে দেখেছি নিরাপত্তা বাহিনীর বিরাট প্রদর্শন! কঠোর নিরাপত্তা! একবার রাজ্য পুলিশ আর একবার কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানের তল্লাশিতে পাস করলে তবেই সম্ভব ভিতরে প্রবেশ করা। মূল গণনাকেন্দ্রে শোভাবর্ধন করছে সিসি টিভি, গেটের সামনে জনাকয়েক বন্দুকধারী শান্তিরক্ষক, কয়েকশো কাউন্টিং অফিসার্স, টেবিলে-টেবিলে প্রতীক্ষারত বিভিন্ন দলের প্রার্থী সহ কাউন্টিং এজেন্টরা।

পৌনে দশটা নাগাদ টিএমসির গুণ্ডাবাহিনী খেলা শুরু করল। আগের দিন বিডিওতে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত বসেও যে কার্ড ‘দরকার নেই’ বলে বিরোধী দলের কাউকেই দেওয়া হয়নি, এখন সেই কার্ডের খোঁজ করতে এল শাসকদলের দুষ্কৃতিরা। আমরা সহ সমস্ত বিরোধীরা তখন কাউন্টিং টেবিলে। শুরু হল একের পর এক বিরোধী প্রার্থী/এজেন্টদের টেবিল থেকে, হল থেকে বের করে দেওয়া। সিপিএম ও বিজেপির সকলে বিনা প্রতিবাদে বেড়িয়ে গেল। আমাদের পালা আসতে ঐ ঘরে উপস্থিত আমাদের জয়দেব বাগ, রুমা আহিরী ও নন্দলাল মাহেলীরা দৃঢ়তার সাথে স্পষ্ট জানিয়ে দেন, তাঁরা হল ছেড়ে যাবেন না। এরপরও হুমকি দিতে থাকে ওরা। খবর পেয়ে পাশের ঘর থেকে আমরা পৌঁছালাম। ওদের সাথে তীব্র বাদানুবাদ হল। বাদানুবাদ চলতে থাকলে ঐ ঘরে বাধ্য হয়ে মুখ দেখালেন ওসি ইলেকশন। তাঁকে চেপে ধরা হলে তিনি আমতা আমতা স্বরে বললেন, প্রার্থীর আলাদা কার্ড লাগবে না। প্রার্থী ঐ কার্ডেই থাকতে পারবেন!

কিন্তু এই লুম্পেনসি, এই সংগঠিত ক্রাইম কে ঠেকাবে এই ঘেরাটোপের মধ্যে!

ততক্ষণে এ ঘরে কেবল আমাদের কয়েকজন ছাড়া বিরোধীরা সব ফাঁকা! হলের পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণে ‘জয় বাংলা’র দুষ্কৃতীরা!

ওদের অপারেশন এরপর শুরু হল পাশের হলে। একইভাবে জোরজুলুম, টানাহেঁচড়া চলল। আমরা আবার বাধা দিলাম। বিডিও আসুক, কেন এমন হবে — চিৎকার করতে লাগলাম। ওরা মরিয়া।

‘একে আগে বার কর’ — এই কথা বলে এখন ওরা ধাক্কা দিতে দিতে আমাকে হল থেকে বার করতে চেষ্টা চালাল। সাথে একজন উপদেশ দিতে থাকল, “চলে যান! এই টানাহেঁচড়া! এতে কি আপনার সম্মান বাড়ছে? এতোগুলো মেয়ে, বয়স্ক মানুষ নিয়ে এখানে এসেছেন কোন আক্কেলে?”

কয়েক মিনিট পর দেখা গেল, এখানেও হল ফাঁকা! কেবল বেলমুড়ির কাউন্টিং-এ উপস্থিত আমরা কয়েকজন। বোঝা গেল, এতে কোন লাভ হবে না।

আমরা বেড়িয়ে এলাম হলের বাইরে। সেখানে তখন সমস্ত বিরোধীরা অসহায় দাঁড়িয়ে আছে। সকলকে এক করার চেষ্টা চলল। শুরু হল আমাদের শ্লোগান ‘এই জোরজুলুম অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে’, ‘বিডিওকে অবিলম্বে বিরোধী দলের লোকজনদের কাউন্টিং এ ফিরিয়ে নিতে হবে’! ‘জুলুমবাজি বন্ধ কর’। দেখলাম, শ্লোগান তুলছেন কমরেড সজল দে, শ্রাবণী মালিকও। সিপিএমের একাংশ সহ বিরোধীরা অনেকেই গলা মেলাতে লাগল। কিন্তু বোঝা গেল, সিপিএম নেতারা আত্মসমর্পণ করে বসে আছে।

কমরেড বিকাশ মুদি জানালেন, বিজেপির নেতারা বলাবলি করছে, ‘সিপিআই(এমএল) উত্তেজিত করার চেষ্টা করছে। এখান থেকে চলে যেতে হবে’।

বিজেপি এরপরে সেখান থেকে বের হয়ে গেল। জানা গেল, ওদের উপরের নেত্রী লকেট চ্যাটার্জি বাইরে এসেছে। সেখানে ওরা চলে গেল। পরে জানা গেল, আধাঘন্টা পথ অবরোধ করে, এজেন্টদের যে যার এলাকায় ফিরিয়ে দিয়েছে ওদের নেতৃত্ব।

কিছু পরে সিপিএমও চলে গেল। শুনলাম, সিপিএম বের হওয়ার সময় ভালোই মারধোর খেয়েছে।
আমরা ভিতরে। কেবলমাত্র আমরা!!

কী করা যায়? স্হির করলাম, সকলে মিলে হলে না ঢুকে আমরা কয়েকজন (কমরেড সজল, শ্রাবণী, শ্যামদা এবং আমি) ঢুকি। কিন্তু পরিস্থিতি সম্পূর্ণ প্রতিকূল। কোনো কিছুই দেখে নেওয়া সম্ভব নয়। তবুও প্রহসনের সাক্ষী থাকতে হল আমাদের।

ওদিকে হল ৫-এ আছেন জয়দেব, রুমাদি, নন্দলাল। পরে রুমাদির মুখে শুনলাম, সেখানে কমরেড জয়দেবকে সরাতে ওরা ৫/৬ জন ব্যাপক মারধোর, টানাহেঁচড়া করেছে। কমরেড তবুও ঘরের জাল আঁকড়ে দাঁড়িয়ে আছেন। জালের ওপারে কাউণ্টিং টেবিলে অন্যদের সাথে ছিলেন এক মহিলা অফিসার। জয়দেবের হেনস্থা দেখে ঐ মহিলার চোখে জল এসে গেছে! কিন্তু কিছু বলার নেই।

এই অবস্থায় কেমন হবে কাউণ্টিং!! কে দেখবে সিল! কে দেখবে ব্যালট স্বাক্ষর! কে মেলাবে সবটা! কে দেখবে অব্যবহৃত ব্যালট!

কোথায় রিটার্নিং অফিসার? কোথায় অবজারভার!?

ভিতরে কারো কাছে ফোন নেই। নিয়ে আসতে দেয়নি ওরা, নিরাপত্তা রক্ষকরা! ভোট চুরি যাতে রেকর্ডভুক্ত না হয়, তার জন্য এই নিপুণ ব্যবস্থাপণা ওদের!

৮নং হল থেকে বের হয়ে কমরেড জয়দেবের কাছে গেলাম। ওখানে পাশাপাশি তখনও ছিলেন কমরেড রুমাদি। বললেন, জয়দেবের উপর নেমে আসা জুলুমের কথা। কমরেড রুমাদিকে বের করে দিয়ে যখন একটু পরে জয়দেবের নিয়ে বাইরে আসছি, সেসময় বোসো বুথে জয়দেবের বিরোধী প্রার্থী টিএমসির বিদ্যুৎ মালিক আবার ঝাঁপিয়ে পড়ল জয়দেবের উপর। আমার গায়ে হাত দিল। জয়দেবকে আবারও মারধোর করল বিদ্যুৎ মালিক।

হেনস্থা, হেনস্থা আর হেনস্থা!

মূল গেটের সামনে সেন্ট্রাল ফোর্স, পিছনে কাউন্টিং হলের সামনে সেন্ট্রাল ফোর্স!

কেউ দেখার নেই!! পরে ওদের যখন বলা হল, ওরা জানালেন, গেটটুকু দেখাটাই ওদের উপর নির্দেশ… অন্য কোনো দিকে ওঁরা নজর দিতে পারবেন না!

এভাবে ভোট করতে হয় কেন? ধনেখালি জুড়ে মানুষের সঙ্গত প্রশ্ন।

এমন অভিজ্ঞতায় স্বৈরাচারের পতন চাওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়তেই থাকবে।

মানুষ, কেবলমাত্র মানুষই শেষ কথা বলে।

জবাব চাইবার মানুষের সংখ্যা বাড়তেই থাকবে।

খণ্ড-30
সংখ্যা-23