অর্থহীন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে সমস্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান
meaninglessly-irrelevant

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

সংবাদপত্রের স্বাধীনতার উপর নেমে এল বিরাট হামলা

গত সপ্তাহে সংসদে পাস হওয়া প্রেস অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন অফ পিরিয়ডিক বিলস্ ২০২৩, সংবাদমাধ্যম, বিশেষ করে প্রিন্ট মিডিয়ার উপর নামিয়ে আনা বিরাট এক হামলা। এই বিলটি আগেকার প্রেস অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন অফ বুকস্ ১৮৬৭’র ঔপনিবেশিক আইনকে বাতিল করল, যা ১৮৫৭ সালের ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ, সিপাহী বিদ্রোহের পর লাগু হয়েছিল। সেই সময় হাতে গোনা কয়েকটি সংবাদপত্রকে বশে রাখতেই ওই আইন আনা হয়।

ঔপনিবেশিক আইনকে বদলানোর অবশ্যই প্রয়োজন রয়েছে, কারণ আধুনিক গণতান্ত্রিক স্বাধীন দেশে ওই আইন কোনমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু নতুন মোড়কে যেটি আনা হচ্ছে তা পুরাতনের থেকেও আরও বিপজ্জনক।

বিজ্ঞানভিত্তিক ও বিদ্যাচর্চার জার্নালগুলোকে এই আইনের আওতায় বাইরে রাখা হয়েছে, রেজিস্ট্রেশনের প্রক্রিয়াকেও সহজসরল করার সুপারিশ রয়েছে। ভুলবশত কোনো তথ্য দিলে আগের আইন যাকে অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত করেছিল, এই আইন সেটাকে ছাড় দিয়েছে। কিন্তু, আগের আইনের তুলনায় এই বিলটিতে যে ভয়ংকরতম বিধি নিয়ে আসা হচ্ছে, যা এই বিলটিকে চরম দমনমূলক করে তুলবে তা হল রেজিস্ট্রার জেনারেলের হাতে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা তুলে দেওয়া।

এই রেজিস্ট্রার জেনারেল (আরজি) হবেন নিয়ন্ত্রক। তিনি সরকার কর্তৃক মনোনীত। তিনি অপরিসীম ক্ষমতার অধিকারী। ‘সন্ত্রাসবাদী বা বেআইনি’ কার্যকলাপের সাথে অথবা এমন কোনো কাজে লিপ্ত যা রাষ্ট্রের নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক এমন অভিযোগে দুষ্ট কোনো প্রকাশনার মালিক বা প্রকাশকের ছাপানো বই, বা সংবাদপত্রের রেজিস্ট্রেশন বাতিল হয়ে যাবে বা তা প্রকাশ করার উপর আরোপ করা হবে নিষেধাজ্ঞা — আরজি’র নির্দেশে।

আরজি যদি মনে করেন কোনো এক প্রকাশনা ভারতের সার্বভৌমত্ব ও সংহতির বিরুদ্ধে গেছে তবে সেই প্রকাশনার রেজিস্ট্রেশন বাতিল হবে, তার মালিক, বা প্রকাশক বা তার সহযোগীদের আটক করা হবে, তাদের জেল হবে, তাদের জামিন পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাও থাকবে না। এই আইনে সরকার বিরোধী যেকোনো সাংবাদিক বা প্রকাশককে যেকোনো সময়ে ফাঁসানোর অবাধ সুযোগ থাকছে।

নতুন এই আইন আরজি’কে এই ক্ষমতা দিয়েছে যার মাধ্যমে তিনি রেজিস্ট্রেশন যাচাই করতে যেকোনো সময়ে ওই পত্রিকা বা প্রকাশনার দোরে অবাধ প্রবেশ করতে পারবেন, এমনকি একজন আধিকারিককে নিয়োগ করতে পারবেন যিনি প্রকাশনার গোটা প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করবে। এই আধিকারিক একজন গেজেটেড অফিসার হলেই চলবে। তিনি পুলিশ বিভাগের বা ওই ধরনের কোনো বিভাগের আধিকারিকও হতে পারেন। এই বিল সরকারকে সংবাদ প্রকাশনার স্বার্থে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা দিয়েছে। এই আইন বলে সরকার যেকোনো অনলাইন সংবাদকেও তার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারবে।

ইতিমধ্যেই এডিটার গিল্ড এবং অন্যান্য মিডিয়া এ সম্পর্কে তাদের আপত্তির কথা জানিয়েছে। তারা মনে করছেন এই বিল আইনের রূপ নিলে তা হবে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাক স্বাধীনতার উপর বড় ধরনের হামলা। যা সংবাদের উপর সেন্সারশিপ চালু করবে।

এই প্রস্তাবিত আইনে অপরাধকে হুবহু প্রিভেনশন অফ মানি ল্যন্ডারিং অ্যাক্ট ‘পিএমএলএ’এর দানবীয় আইনের আদলে তৈরি করা হয়েছে।

নতুন বন সংরক্ষণ আইন ডেকে আনছে বিরাট সর্বনাশ

মণিপুরের ধারাবাহিক হিংসা, নারী নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতির দাবিতে সংসদ যখন উত্তাল, এরকমই এক আবহে, বাদল অধিবেশনের পঞ্চম দিনে বিতর্কিত বন সংরক্ষণ (সংশোধনী) বিল মোদী সরকার লোকসভায় পাশ করিয়ে নিল।

বিজেপি ঘনিষ্ঠ শিল্পপতিদের হাজার হাজার বর্গ কিলোমিটার অরণ্যভূমি তুলে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই নজিরবিহীন দ্রুততায় নয়া বন সংরক্ষণ আইন কার্যকর করতে সক্রিয় হয়েছে কেন্দ্র। নয়া বিলটি জানিয়েছে যে এটা সংশোধন আজ পরিস্থিতির দাবি। কারণ, “বন সংরক্ষণ আইনের সামনে জীববৈচিত্র, সামাজিক ও পরিবেশগত বিকাশের চ্যালেঞ্জ রয়েছে” আর সেই জন্য বিপুল পরিমাণে অরণ্যভূমিকে সংরক্ষণের আওতা থেকে মুক্ত করে তার রূপান্তর ঘটিয়ে অরণ্য বহির্ভূত ব্যবহারে যাতে কাজে লাগানো যায়, ব্যক্তি মালিকানাধীন কর্পোরেশনের স্বার্থে রূপান্তরিত করা যায় তার সুযোগ নতুন সংশোধনীতে রাখা হয়েছে।

নয়া বিলে সীমান্ত থেকে ১০০ কিলোমিটার এলাকা পর্যন্ত বনভূমি ধ্বংসের বন্দোবস্ত রাখা হয়েছে। তাতে ইউপিএ আমলে চালু করা ‘অরণ্য অধিকার আইন’ লঙ্ঘিত হবে। অবাধে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের খনি ও প্রাকৃতিক সম্পদে ভাগ বসানোর পাশাপাশি চিড়িয়াখানা, সাফারি পার্ক এবং ইকো ট্যুরিজমের অছিলায় কর্পোরেটগুলোকে সহজেই সরকারি ব্যবস্থাপনার কাজে লাগিয়ে অরণ্যবাসী জনজাতিদের উৎখাত করতে পারবে। কিন্তু, ১৯৮০’র বন সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী অরণ্য এলাকায় কোনও অন্য ধরনের কাজ করা যাবে না। এবার, আইনে সংশোধন এনে ‘জাতীয় স্তরে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত প্রকল্প ও নিরাপত্তা বিষয়ক প্রকল্পে’র ক্ষেত্রে এই বিধিনিষেধ তুলে দেওয়া হচ্ছে। এরফলে অরণ্যের অধিকার আইন নির্বিচারে লঙ্ঘনের পথ তৈরি হবে। এতদিন জঙ্গলে যাঁদের অধিকার আইনত প্রতিষ্ঠিত ছিল, সেই আদিবাসীদের গৃহচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে গেল।

এই হল মোদীর ফ্যাসিবাদী হামলা যা দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রচন্ড দ্রুততায় অপ্রাসঙ্গিক ও অর্থহীন করে নিছক এক প্রসাধনী মোড়কে তার কঙ্কালসার কাঠামোকে সাজিয়েই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বজায় রাখার ঢাক পেটাচ্ছে।
স্বাধীনোত্তর ভারত এযাবত এত বড় হামলা দেখেনি।

(সমাপ্ত)

- অতনু চক্রবর্তী

খণ্ড-30
সংখ্যা-29