দীর্ঘদিন ধরে চলা ধর্মঘটের মধ্যে দিয়ে বিহারের উজ্জীবিত আশাকর্মীরা অর্জন করলেন প্রেরণা সঞ্চারী বিজয়
amid-prolonged-strike

বিহারের ধর্মঘটী আশা কর্মীদের কাছে ২০২৩’র ১২ আগস্ট এক ঐতিহাসিক বিজয়ের দিন হিসাবেই চিহ্নিত হল। প্রতি মাসে তাঁদের যে মাসোহারা দেওয়া হত, সরকার সেদিন সেই অর্থের ১৫০০ টাকা বৃদ্ধি ঘোষণা করল এবং প্রদেয় ঐ অর্থকে যে ‘পারিতোষিক’ বলে অভিহিত করা হত সেই অভিধা পাল্টে তার নামকরণ করা হল ‘অনারারিয়াম’ বা ‘সম্মানদক্ষিণা’। এক লক্ষ আশাকর্মী এবং আশা সহায়কদের অনির্দিষ্টকালের যে ধর্মঘট শুরু হয় ১২ আগস্ট এবং যা চলে ৩১ দিন তা সংগঠিত হয় আশা সংযুক্ত সংঘর্ষ মঞ্চর পতাকাতলে। এই ধর্মঘট আন্দোলনের পুরোভাগে ছিল বিহার রাজ্য আশা কার্যকর্তা সংঘ (গোপ গোষ্ঠী, এআইসিসিটিইউ) এবং আশা ও আশা সহায়ক ইউনিয়ন। বিহার রাজ্য আশা কার্যকর্তা, গোপ গোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদিকা শশী যাদব বলেন, আশাকর্মীদের ধর্মঘটই ছিল বিহারের সাম্প্রতিক ইতিহাসে নারীদের সর্ববৃহত আন্দোলন যাতে হাজার হাজার আশাকর্মী ঐক্যবদ্ধ হন।

বিহারের সব জেলার প্রায় সমস্ত প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, সামাজিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও রেফারেল হাসপাতালগুলোতে ৩১ দিন ধরে ধর্মঘট অব্যাহত থাকে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোই আশাকর্মী এবং আশা সহায়কদের সমাবেশ কেন্দ্র হয়ে ওঠে। ধর্মঘট চলার সময় আশাকর্মীরা এটা সুনিশ্চিত করেন যে জরুরি কাজগুলো এবং শিশু জন্মের বিষয়গুলো যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। শশী যাদব বলেন, “এই আন্দোলনের সবচেয়ে বড় বিজয়টি হল এই যে, সরকার আশাকর্মীদের ‘পারিতোষিক’এর বদলে ‘সম্মানদক্ষিণা’ দিতে সম্মত হয়েছে। তাঁদের কাজের জন্য প্রদত্ত অর্থকে ‘পারিতোষিক’ বলাটা ছিল মর্যাদাহানিকর এবং তা আশাকর্মীদের শ্রমকে হীন প্রতিপন্ন করে; প্রদেয় অর্থকে ‘সম্মানদক্ষিণা’ বলাটা আশাদের কর্মী হিসাবে স্বীকৃতি দেয়।”

স্বাস্থ্য পরিষেবার পুরোভাগে থাকা আশারা হলেন দেশের গ্রামীণ স্বাস্থ্য এবং বিশাল আকারের সংক্রমণ প্রতিরোধ কর্মসূচির প্রধান ভরসাস্থল এবং জনগণের স্বাস্থ্য পরিষেবা লাভে ও কোভিড-১৯ অতিমারীর প্রতিরোধে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। কিন্তু বিহারে এবং সারা দেশেই নামমাত্র অর্থেই তাঁদের কাজ করতে হয়; এমন নজিরও রয়েছে যে লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য আশাদের গ্রামের কয়েক কিলোমিটার খানাখন্দ ভরা রাস্তা পায়ে হেঁটে পেরোতেও হয়। শশী যাদব আরও বলেন, “আমরা যা দাবি করেছিলাম ১৫০০ টাকার এই বৃদ্ধি তার চেয়ে কম হলেও আমরা এটাকে আশা কর্মীদের অধিকারের জন্য সংগ্রামের প্রথম বিজয় বলে গণ্য করি।” আশারা এবং আশা সহায়করা এখন থেকে সরকারের কাছ থেকে মাসে পাবেন সুনির্দিষ্ট পরিমাণের ২৫০০ টাকা এবং কেন্দ্রীয় অবদান বাবদ ২০০০ টাকা, এরসাথে বিভিন্ন কাজ ভিত্তিক উৎসাহ ভাতাও থাকবে।

সরকারের সাথে আলোচনার সময় এই বোঝাপড়াতেও পৌঁছানো হয় যে, এই প্রকল্পে উৎসাহ ভাতার হারের বৃদ্ধির যে দাবি জানানো হয়েছে তার ভিত্তিতে একটি সুপারিশ বিহার রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পাঠাবে। এই প্রকল্পে বিভিন্ন ধরনের কাজের জন্য আশাদের যে উৎসাহ ভাতা দেওয়া হয় তা কয়েক দশক ধরে একই পরিমাণে দাঁড়িয়ে রয়েছে, এবং আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধির কথা বিবেচনা করে সেই হারকে জরুরি ভিত্তিতে সংশোধন করে তার কমপক্ষে ৩০০ শতাংশ বৃদ্ধি ঘটাতে হবে। অতিমারীর পর থেকে যে পর্যায়ের পাওনা এখনও বাকি আছে সরকার তা মিটিয়ে দেবে। ন’দফা দাবি সনদের অন্যান্য যে বিষয়গুলো রয়েছে সরকারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় সেগুলোর সমাধান করা হবে। এছাড়া, এই ধর্মঘটের পর্যায়ে আশা কর্মীদের বিরুদ্ধে যে সমস্ত অভিযোগ দায়ের হয়েছে সেগুলো তুলে নেওয়া হবে।

সিটু এবং আশা সহায়কদের নেতা বিশ্বনাথ সিং আশাদের প্রাপ্য অর্থের বৃদ্ধিকে এক বিজয় হিসাবে ঘোষণা করেও বলেছেন যে, সরকার যেহেতু দাবি অনুযায়ী সম্মানদক্ষিণা ১০,০০০ টাকা দিতে অস্বীকার করেছে, এই আন্দোলন তাই চলতে থাকবে। আশা নেত্রী সুধা সুমন বলেন, “পেনশন ও অবসর গ্ৰহণের পর প্রাপ্য আর্থিক সুবিধার দাবিও সরকারের বিবেচনায় রয়েছে”। কর্মচারী ফেডারেশন ‘গোপ’এর সাম্মানিক সভাপতি রাম বলি প্রসাদ এবং এআইসিসিটিইউ রাজ্য সম্পাদক রণবিজয় কুমার উল্লেখ করেন, আশা কর্মীরা যে দাবিগুলো তুলে ধরেছেন সেগুলো ২০২০’র বিধানসভা নির্বাচনের সময় মহাগাঠবন্ধনের ইস্তাহারেরই অংশ ছিল।

asha-workers-achieve-inspiring-victory
আঘাতের চরম মুহূর্ত — ৩ আগস্টের জনসমাবেশ

ধর্মঘট চতুর্থ সপ্তাহে প্রবেশ করার পর ৩ আগস্ট হাজার হাজার আশাকর্মী এবং আশা সহায়করা তাঁদের দাবিগুলো নিয়ে সমবেত হলেন পাটনার গরদানিবাগে। এই বিপুল সমাবেশে গারদানিবাগের রাস্তাগুলো আশাদের পোশাকের রং গোলাপিতে রঞ্জিত হয়ে উঠল এবং মর্যাদা, সম্মান ও অধিকারের দাবি প্রতিধ্বনিত হতে থাকল। সরকারের সঙ্গে দু’দফা আলোচনা নিষ্ফলা হয়েছিল, বিপরীতে তাদের ছাঁটাইয়ের হুমকির মুখে পড়তে হয়েছিল এবং ধর্মঘটে নেতৃত্বদায়ী কর্মীদের বিরুদ্ধে অপরাধের মামলাও দায়ের হয়েছিল। স্বাস্থ্য দপ্তরের দায়িত্বে ছিলেন উপ-মুখ্যমন্ত্রী তেজস্বী যাদব, এবং তিনি মাসে প্রদেয় অর্থকে পারিতোষিক থেকে সম্মানদক্ষিণায় পরিবর্তিত করতে সম্মত হয়েছিলেন। কিন্তু বারবার তাগাদা ও স্মারকলিপি দেওয়া সত্ত্বেও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হয়নি। এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ছিল যে, সংগ্রাম দীর্ঘদিন ধরে চলা এবং আশাকর্মীদের স্বাস্থ্যের অবনতি হতে থাকলেও রাজ্য সরকার দাবির সমাধানে কোনো সক্রিয়তাই দেখায়নি। প্রতিবাদে অংশ নেওয়ার সময় সিওয়ানের এক আশাকর্মী সরস্বতী দেবী মারা যান।

সিপিআই(এমএল)-এর বিহার রাজ্য সম্পাদক কমরেড কুনাল বললেন, “আশাকর্মীদের প্রতিবাদী জমায়েত এই আন্দলনের চরম আঘাতের মুহূর্ত হয়ে উঠেছিল।” আশাকর্মীদের ক্রমবর্ধমান প্রতিরোধের মুখে পড়ে এবং গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিষেবা থেমে যাওয়ায় সরকার অবশেষে আশাকর্মীদের সঙ্গে এক বোঝাপড়ায় উপনীত হয়। ইউনিয়নগুলো রাজ্য সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করে, কেননা, সরকার দাবিগুলোকে অবজ্ঞা করার সাথে সাথে কূটকৌশল অবলম্বনের হুমকিও দিয়েছিল; ইউনিয়নগুলো বলল — সরকার ২০১৯’র জানুয়ারি মাসে আশাকর্মীদের সঙ্গে যে চুক্তি করেছিল তা তাদের মানতে হবে, বাজেট অধিবেশনের সময় বিহার বিধানসভায় দেওয়া তাদের নিজেদের দেওয়া প্রতিশ্রুতিকে রক্ষা করতে হবে এবং আশাকর্মীদের মূল দাবিগুলো নিয়ে অবিলম্বে তাদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে হবে। বিভিন্ন বাম নেতৃবৃন্দ এবং নাগরিক সমাজের ব্যক্তিত্ব আশাকর্মীদের সমাবেশে সংহতি জানান; এআইপিডব্লিউএ’র সাধারণ সম্পাদিকা মীনা তেওয়ারি, সরোজ চৌবের সঙ্গে সমাবেশে বক্তব্য রাখেন সিপিআই(এমএল)-এর মেহবুব আলম, সত্যদেব রাম, গোপাল রবিদাস, রাম বলি সিং যাদব, অমরজিৎ কুশওয়া এবং সিপিআই(এম)-এর অজয় কুমার ও সত্যেন্দ্র যাদব।

দেশব্যাপী আন্দোলনের দিকে এগিয়ে যাওয়া

শশী যাদব বললেন, “এই বিজয় অর্জন আশাকর্মীদের অধিকার, সম্মান ও মর্যাদার জন্য আমাদের সংগ্রামকে আরও জোরালো করে তুলবে। এই আন্দোলনকে আমরা এখন নিয়ে যাব দিল্লীর দরবারে, এক জাতীয় লড়াইয়ের অভিমুখে। আগামী ৯ ও ১০ সেপ্টেম্বর পাটনায় সারা ভারত প্রকল্প কর্মী ফেডারেশন আয়োজিত যে সারা ভারত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে তাতে এটাও একটা আলোচনার বিষয় হবে। ঐ সম্মেলনে ন্যূনতম মজুরি এবং সমস্ত প্রকল্প কর্মীদের ‘শ্রমিক’এর স্বীকৃতি প্রদানের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হবে। তিনি এই বিষয়েরও উল্লেখ করেন যে, আশা, অঙ্গনওয়াড়ি, মিড-ডে-মিল কর্মীদের অত্যন্ত নিকৃষ্ট পরিস্থিতিতে কাজ করতে হয় এবং তাঁরা পারিশ্রমিকও পান যৎসামান্য, আর সামাজিক নিরাপত্তা থেকেও সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত।”

গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিষেবার প্রতি দায়বদ্ধতা এবং অতিমারীর সময় তাঁদের কাজের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, পাটনা হাইকোর্ট এবং অন্যান্য নানান প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন আশাকর্মীদের প্রশংসা করেছেন। এ’সত্ত্বেও তাঁরা কিন্তু মোদী নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে অবহেলাই পেয়েছেন। কমরেড কুনাল বলেছেন, “পাটনায় সারা ভারত প্রকল্প কর্মী ফেডারেশনের যে সম্মেলন হবে তা প্রকল্প কর্মীদের দীর্ঘদিনের দাবিগুলির সমাধানের লক্ষ্যে সারা ভারতে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের পথ প্রশস্ত করবে।”

শ্রমিক শ্রেণীর অধিকার ও মর্যাদা অর্জনের জন্য আশাকর্মীদের আন্দোলন দেড় দশক ধরে চলছে। জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের অধীনে তাঁদের প্রকল্প চালু হওয়ার পর থেকেই আশারা তাঁদের শ্রমের জন্য শ্রমিকের মর্যাদা এবং তফশিল অনুসারে মজুরির দাবি জানিয়ে আসছেন।

দাবি সনদ
   • আশাকর্মী ও আশা সহায়কদের যে পারিশ্রমিক দেওয়া হচ্ছে তাকে ‘পারিতোষিক’এর পরিবর্তে ‘সম্মানদক্ষিণা’র স্বীকৃতি দিতে হবে এবং প্রদেয় অর্থের পরিমাণ মাসে ১০০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০,০০০ টাকা করতে হবে।
   • ২০১৯’র এপ্রিল থেকে ২০২০’র নভেম্বর পর্যন্ত এই বিষয়ে যে বকেয়া রয়েছে তা অবিলম্বে সম্পূর্ণরূপে মিটিয়ে দিতে হবে।
   • অনলাইন পোর্টাল চালু হওয়ার আগের যে পর্যায়ের বকেয়া রয়েছে তা পুরোপুরি মিটিয়ে দিতে হবে।
   • বকেয়া অর্থ প্রদান করতে হবে স্বচ্ছ ও অভিন্ন প্রক্রিয়ায়।
   • আশাদের অর্থ প্রদানের সময় দুর্নীতি ও উৎকোচ আদায়ের অভ্যাসকে বন্ধ করতে হবে।
   • কোভিড-১৯’র সময় কাজ করার জন্য আশাকর্মী ও আশা সহায়কদের ১০,০০০ টাকা অতিমারী ভাতা দিতে হবে।
   • শাড়ির সঙ্গে ব্লাউজ, শায়া, সোয়েটার সহ পুরো পোশাক আশাদের দিতে হবে।
   • আশা সহায়কদের সরকারি খরচে ইউনিফর্ম দিতে হবে।
   • আশা সহায়কদের দিনপ্রতি ৫০০ টাকা হারে মসের সমস্ত দিনের জন্য পরিবহণ ভাতা দিতে হবে।
   • বিভিন্ন কাজের জন্য যে পারিতোষিক/সম্মানদক্ষিণা দেওয়া হয় তা দীর্ঘদিন বাড়েনি। এগুলির হার বাড়ানোর প্রস্তাব রাজ্য সরকারকে পাঠাতে হবে।
   • আশাকর্মী এবং আশা সহায়কদের সরকারি কর্মীর স্বীকৃতি দিতে হবে।

কোভিড অতিমারির সময় যে আশাকর্মী এবং আশা সহায়করা মারা গেছেন (যেগুলির খবর হয়েছে এবং যেগুলি নিয়ে কোনো খবর হয়নি উভয় ক্ষেত্রেই) তাদের পরিবারকে রাজ্য সরকার ঘোষিত ৪ লক্ষ এবং কেন্দ্রীয় বিমা প্রকল্প অনুসারে ৫০ লক্ষ টাকা দিতে হবে।

আশাকর্মী এবং আশা সহায়কদের সামাজিক নিরাপত্তা এবং পেনশনের সুবিধা দিতে হবে, এবং এই দাবি যতদিন না মানা হচ্ছে ততদিন অবসর গ্ৰহণের পর এককালীন ১০ লক্ষ টাকা অবসর ভাতা দিতে হবে।

২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে আশাকর্মী এবং আশা সহায়কদের সঙ্গে যে চুক্তি করা হয়েছিল তার পূর্ণাঙ্গ রূপায়ন ঘটাতে হবে এবং আশাকর্মী ও আশা সহায়কদের বিরুদ্ধে যে সমস্ত মামলা দায়ের হয়েছে সেগুলি তুলে নিতে হবে।

খণ্ড-30
সংখ্যা-29