ক্যাগ রিপোর্টে উন্মোচিত মোদী সরকারের দুর্নীতি
corruption-in-modi-government

নরেন্দ্র মোদীর ‘দুর্নীতি বিরোধী জেহাদ’ ক্রমেই বেশি করে চালিত হতে থেকেছে বিরোধী নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে এবং দুর্নীতিকে কেন্দ্র করে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিবর্গের ৯৫ শতাংশই বিভিন্ন বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দ। বিরোধীদের বিরুদ্ধে সিবিআই-ইডি’কে লেলিয়ে দেওয়ার একটা উদ্দেশ্য যদি হয়ে থাকে বিরোধী পক্ষকে মাথা তুলতে না দেওয়া, অন্য মতলবটা তবে অনস্বীকার্যভাবেই হল বিজেপিকে দুর্নীতি মুক্ত রূপে জাহির করা। কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর যাবতীয় কসরত সত্ত্বেও বিজেপির চালানো দুর্নীতিকে চেপে রাখা সম্ভব হয়নি এবং বারেবারেই সেগুলোর উন্মোচন ঘটতে থেকেছে। অতি সম্প্রতি প্রকাশ পেল কম্পট্রোলার এন্ড অডিটর জেনারেল’এর (ক্যাগ) রিপোর্ট যাতে নরেন্দ্র মোদী সরকারের কাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রই দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে। সেই রিপোর্টৈ উল্লেখিত দুর্নীতিগুলোর দিকে তাকানো যাক।

ক্যাগ রিপোর্টে বড় ধরনের দুর্নীতির সংকেত রয়েছে সড়ক পরিবহণ মন্ত্রক গৃহীত সড়ক নির্মাণ প্রকল্পে। রিপোর্টে জানানো হয়েছে, ‘ভারতমালা পরিযোজনা’ প্রকল্পে ৩৪,৮০০ কিমি সড়ক তৈরিতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা বরাদ্দ করেছিল ৫,৩৫,০০০ কোটি টাকা। কিন্তু কেন্দ্রীয় পরিবহণ মন্ত্রক ২৬,০০০ কিমি সড়ক নির্মাণের জন্য বরাত দেয় ৮,৪৬,৫৮৮ কোটি টাকার। অর্থাৎ, বরাদ্দ করা অর্থের চেয়ে বরাত দেওয়া বা ব্যয় হওয়া অর্থের পরিমাণ অনেক বেশি। বরাদ্দ করা অর্থ যেখানে ছিল কিমি প্রতি ১৫.৩৭ কোটি টাকা, সেখানে প্রতি কিমি রাস্তা নির্মাণের জন্য বরাত দেওয়া হয়েছে ৩২.৫৬ কোটি টাকার, যা বরাদ্দের দ্বিগুণেরও বেশি। এই প্রকল্পেরই অধীন দ্বারকা এক্সপ্রেসওয়ের জন্য ব্যয় হওয়া অর্থ গিয়ে দাঁড়িয়েছে বরাদ্দ করা অর্থের একেবারে ১৪ গুণ! দ্বারকা এক্সপ্রেসওয়ে ২৯ কিমি দীর্ঘ ১৪ লেনের এক রাস্তা যা দিল্লী থেকে শুরু হয়ে শেষ হচ্ছে গুরুগ্রামে। সড়কের দিল্লীর দিকের দৈর্ঘ্য ১০.১ কিমি, এবং গুরুগ্রামের দিকের দৈর্ঘ্য ১৮.৯ কিমি। বরাদ্দ করা অর্থের পরিমাণ যেখানে ছিল কিমি পিছু ১৮.২ কোটি টাকা, প্রকৃত খরচ সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছে কিমি পিছু ২৫১ কোটি টাকায়! হরিয়ানার দিকের রাস্তাকে ‘এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে’ বা উড়াল পথ রূপে নির্মাণের জন্যই প্রকৃত খরচ বরাদ্দ অর্থের ১৪ গুণে দাঁড়িয়েছে বলে কেন্দ্রীয় পরিবহণ মন্ত্রকের অভিমত। উড়াল পথ নির্মাণের যৌক্তিকতাকে খণ্ডন করে ক্যাগ আবার এই অভিমত প্রকাশ করেছে যে, উড়াল রাস্তা তৈরির কোনো প্রয়োজন আদৌ ছিল না। মাটির ওপর দিয়ে ১৪ লেনের রাস্তা তৈরির জন্য যথেষ্ট জমি পাওয়া যেত। হরিয়ানার দিকের রাস্তাকে উড়াল রাস্তায় পরিণত করার সিদ্ধান্ত অতএব প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়। এবং এই প্রশ্নও খুব স্বাভাবিকভাবেই উঠবে যে, সড়ক নির্মাণের প্রকৃত ব্যয়ের যে বিপুল বৃদ্ধি ঘটল, সেই অতিরিক্ত অর্থ কি শুধু ঠিকাদাররাই পেয়েছিল, নাকি, তার লাভ উড়াল রাস্তার পরিকল্পনাকারীদের পকেটেও গিয়েছিল? 

ভারতমালা প্রকল্পে বরাত দানের প্রক্রিয়াতেই যথেষ্ট বেনিয়মের সন্ধান ক্যাগ পেয়েছে। এরই ভিত্তিতে এই অভিযোগ সামনে এসেছে যে, যাদের বরাত দেওয়া হয়েছে তারা নিলামের শর্ত ঠিকঠাক পূরণ করেনি, নকল নথির ভিত্তিতে এবং এমনকি প্রকল্প বিশদ রূপে পেশ না হওয়া সত্ত্বেও সড়ক নির্মাণের বরাত প্রদান করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, মোদী ঘনিষ্ঠ শিল্পপতি গৌতম আদানি কেরল, ছত্তিসগড়, তেলেঙ্গানা, পশ্চিমবাংলা, গুজরাট ও অন্যান্য রাজ্যে ভারতমালা প্রকল্পের অধীনে রাস্তা নির্মাণের বরাত পেয়ে থাকেন এবং রাস্তা নির্মাণও করেন। নিয়ম না মানা প্রক্রিয়ায় প্রদত্ত বরাত থেকে আদানিরাই ‘সবচেয়ে বেশি লাভবান’ বলে কেউ কেউ মত প্রকাশ করেছেন। কেন্দ্র পরিচালিত স্বাস্থ্য পরিষেবা ক্ষেত্রও দুর্নীতি জর্জরিত। প্রধানমন্ত্রী জন আরোগ্য যোজনার একটা অংশ হল আয়ুষ্মান ভারত। ক্যাগ’এর রিপোর্ট জানিয়েছে, এই প্রকল্পে দুর্নীতির বহর কম নয়। এই প্রকল্পে সুবিধাপ্রাপকরা মোবাইল ফোনের একটা নম্বরে যুক্ত থাকেন। ক্যাগ রিপোর্টকে উল্লেখ করে কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ জানিয়েছেন, “মাত্র ১৮৬৮৫৮টা মোবাইল নম্বরে ১.২৪ কোটি ডুয়ো সুবিধাপ্রাপককে যুক্ত করা হয়েছিল।” ক্যাগ রিপোর্ট আরও জানিয়েছে, ‘৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯’ এবং ‘৮৮৮৮৮৮৮৮৮৮’ এই দুটো নম্বরে নথিভুক্ত করা হয়েছিল যথাক্রমে ৭.৫ লক্ষ ও ১.৪ লক্ষ সুবিধাপ্রাপককে। একই মোবাইল নম্বরে বহু ব্যক্তিকে সংযুক্ত করার অর্থ তাদের জন্য চিকিৎসা ব্যয় দেখিয়ে সেই অর্থকে আত্মসাৎ করা। এছাড়া, মৃত ব্যক্তিদের জন্যও বহু চিকিৎসা ব্যয় দেখানো হয়েছে। ‘দ্য ওয়্যার ওয়েব’ পত্রিকার ১০ আগস্টের এক নিবন্ধে ক্যাগ রিপোর্টকে উল্লেখ করে জানানো হয়েছে, ৮৮,৭৬০ জন রোগী চিকিৎসা চলাকালীন মারা যান। এ’সত্ত্বেও এই সমস্ত মৃত ব্যক্তিদের ‘পুনরায় চিকিৎসার’ জন্য ২১,৪৯২৩টি ক্ষেত্রে দাবি করা অর্থ মেটানো হয়েছে! এমনকি ২.২৫ লক্ষ ব্যক্তির এমন দিনে শল্য চিকিৎসা হয়েছে বলে দেখানো হয়েছে যে দিনগুলো হাসপাতাল থেকে রোগী ছেড়ে দেওয়ার পরের! এমন সমস্ত হাসপাতালের জন্য অর্থ বরাদ্দ হয়েছে বলে দেখানো হয়েছে যে হাসপাতালগুলোর অস্তিত্ব নেই।

কেন্দ্রীয় সরকারের একটা প্রকল্প রয়েছে যেটার নাম ‘স্বদেশ দর্শন তীর্থযাত্রা’। এই প্রকল্পের অধীনে উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যা উন্নয়ন প্রকল্পে ঠিকাদারদের ২০ কোটি টাকার অন্যায্য সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার নজির রয়েছে বলে ক্যাগ রিপোর্টে উল্লেখিত হয়েছে। প্রবীণদের জন্য নির্ধারিত পেনশনের অর্থ মোদী সরকারের প্রচারে ব্যয়িত হয়েছে বলেও ক্যাগ রিপোর্ট জানিয়েছে।

ক্যাগ’এর এই রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে স্বাধীনতা দিবসের আগেই। স্বাধীনতা দিবসে তাঁর বক্তৃতায় নরেন্দ্র মোদী ফের দুর্নীতির প্রসঙ্গ তুলে বিরোধীদের বিরুদ্ধে তোপ দেখেছেন। কিন্তু ক্যাগ রিপোর্ট নিয়ে নীরবই থেকেছেন। ক্যাগ রিপোর্টে উঠে আসা দুর্নীতির বিষয়গুলো নিয়ে ইডি বা সিবিআই কি তদন্ত চালাবে? এর উত্তর সবারই জানা এবং তার উল্লেখ নিষ্প্রোয়জন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রকৃত ও বিশ্বাসযোগ্য অভিযান চালাতে গেলে তার নিশানা যে বিরোধী রাজনীতিবিদদের বদলে কর্পোরেট চালিত কালো অর্থনীতিকেই হতে হবে তা নিয়ে প্রশ্নের কোনো অবকাশ থাকতে পারে না। অথচ, বড় বড় কর্পোরেট সংস্থাগুলোর সঙ্গে নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপি নেতাদের সম্পর্ক অতীব ঘনিষ্ঠ এবং তারা মোদী সরকারের কাছ থেকে যথেষ্ট মদতই পায়। হিন্ডেনবার্গ’এর রিপোর্ট প্রকাশ পাওয়ার পর নরেন্দ্র মোদী আদানির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে মুখ খোলেননি এবং ঐ রিপোর্টে তুলে ধরা আদানির চালানো কারচুপি ও জালিয়াতির অভিযোগগুলো নিয়ে তদন্তে কোনো আগ্রহও দেখাননি। মোদী যত বলেছেন যে কোনও দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিবিদকেই তিনি রেহাই দেবেন না, ততই আরও বেশি সংখ্যক ইডি-সিবিআই’এর নজরে থাকা রাজনীতিবিদ বিজেপিতে ভিড়েছেন। হিমন্ত বিশ্বশর্মা, শুভেন্দু অধিকারীদের মতো বহু নিদর্শন আগেই ছিল। কিছুদিন আগে বিজেপির ‘ওয়াশিং মেশিন’ আরও যাদের পরিশুদ্ধ করে বিজেপিতে ভেড়ালো তাঁরা হলেন শারদ পাওয়ারের ভাইপো অজিত পাওয়ার, ছগন ভুজবাল ও সম্প্রদায়। ক্যাগ রিপোর্ট আরও একবার প্রমাণ করল যে বিজেপি আগাপাশতলা দুর্নীতিতে লিপ্ত এবং কর্পোরেট অর্থের বখরাতেই তাদের অর্থের ভাঁড়ার উপছে পড়ে। ক্যাগ’এর রিপোর্ট নরেন্দ্র মোদীর দুর্নীতি বিরোধী জেহাদের কপটতাকে আরও একবার প্রকট করল এবং প্রত্যয়িত হল নরেন্দ্র মোদীর নিয়োগ করা জম্মু ও কাশ্মীরের শেষ রাজ্যপাল সত্যপাল মালিকের অভিমত — দুর্নীতি নরেন্দ্র মোদীর তেমন অপছন্দের বিষয় নয়!

- পর্যবেক্ষক

খণ্ড-30
সংখ্যা-29