সম্পাদকীয় : যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বশাসন, গণতান্ত্রিক পরিসর অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে
democratic-space-should-be-maintained

রাজ্যের প্রথম সারির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যাদবপুর এখন উত্তাল। প্রথম বর্ষের নবাগত এক ছাত্র এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করার মাত্র চারদিনের মাথায় প্রাতিষ্ঠানিক হত্যার শিকার হলেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র‍্যাগিং’এর রূপ ধরে যে ক্ষমতাতন্ত্র বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গভীরে শেকড় গেঁড়েছে, তার পরিণাম আজ দেখা যাচ্ছে মারাত্মক রূপে। শারীরিক মানসিক নানা অত্যাচার শুধু নবাগতদের উপরই নয়, সমাজের প্রান্তসীমা থেকে উঠে আসা ছাত্রছাত্রীরা এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানে দিনের পর দিন কল্পনাতীত অত্যাচারের শিকার হন তার অনেক খবর আজ প্রকাশিত।

কেন্দ্রীয় সরকারের রিপোর্ট ও সংসদে এ’নিয়ে পেশ করা তথ্য থেকেই প্রমাণ মেলে যে দেশের উৎকর্ষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইআইটি-আইআইএমএস থেকে ২০১৮-২৩ পর্যন্ত ১৯,০০০ শিক্ষার্থী ড্রপআউট হয়েছে যারা ওবিসি-তফশিলি জাতি-তফশিলি উপজাতি থেকে আগত। আরেকটি তথ্য হল, আইআইটি’তে গত পাঁচ বছরে ৩৩ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। ২০১৪-২১ এই পর্বের মধ্যে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ১২২ জন ছাত্র আত্মহত্যা করেছে, যাদের মধ্যে ২৮ জন তফশিলি উপজাতি এবং ৪১ জন ওবিসি। আইআইটি, ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট, আইআইএমে ২০১৮ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত মোট ৬১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। আরও উদ্বেগের বিষয় হল, যতজন আত্মহত্যা করেছে, তার থেকেও অনেক বেশি শিক্ষার্থী প্রতিনিয়ত আত্মহত্যার কথা ভাবে, এমনকি চেষ্টাও করে তা কেন্দ্রীয় সরকারের রিপোর্ট বলছে।

দিনের পর দিন চোরাস্রোতের মতো এই মারণ প্রবণতা মাথা চাড়া দিয়ে এমনকি উৎকর্ষ শিক্ষা ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানেও বিস্তারলাভ করেছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় তার ব্যতিক্রম নয়। মোদীর শাসনকালে প্রান্তসীমায় নিক্ষিপ্ত ওবিসি-তফশিলি জাতি-উপজাতিদের অস্তিত্ব কি আতঙ্কজনক মাত্রায় বিপন্ন, অপরায়নের বুলডোজার যে প্রবল বেগে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে শুরু করে অনেকের জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিচ্ছে তার ভূরি ভূরি উদাহরণ রয়েছে। সেই ২০০৭ সালে, ইউপিএ’র আমলে এইমসে প্রান্তিক ছাত্রদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের নালিশ আসার পর কেন্দ্রীয় সরকার এক কমিটি গঠন করে। সেই কমিটি পরবর্তীতে এক রিপোর্ট প্রকাশ করে, ‘রিপোর্ট অফ দ্য কমিটি টু ইনকোয়ার ইন্টু দ্য অ্যালিগেশন অফ ডিফারেনশিয়াল ট্রিটমেন্ট অফ এসসি/এসটি স্টুডেন্টস ইন এইমস্’। সেই রিপোর্ট জানিয়েছে যে শুধু ছাত্ররাই নন, বরং সমাজের প্রান্তিক স্তর থেকে উঠে আসা আবাসিক ডাক্তার এমনকি এইমসের ফ্যাকাল্টি সদস্যরা পর্যন্ত হরেক রকমের বৈষম্যের শিকার। যা তাঁদের মানসিক জগতকেও প্রতিনিয়ত আলোড়িত করে।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সমাজের রয়েছে এক চমৎকার গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল, ধর্মনিরপেক্ষতার ঐতিহ্য, যা বাম মতাদর্শে বিশেষ ভাবেই প্রভাবিত। এমনকি অধ্যাপকদের মধ্যেও রয়েছে এই প্রগতিশীলতার প্রভাব। এক মর্মান্তিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে তৃণমূল ও বিজেপি — এই উভয় দলই বাম মনোভাবাপন্ন ছাত্র রাজনীতিকে আক্রমণ করার ফন্দি এঁটেছে। মুখ্যমন্ত্রী আজ ইচ্ছাকৃতভাবে ভুলে গেছেন, আসানসোলে দাঙ্গা বাধানোর পেছনে যে বাবুল সুপ্রিয় মূল পাণ্ডা হিসাবে কুখ্যাতি কুড়িয়েছিল, সেই দাঙ্গাবাজকে ক্যাম্পাসে ঢুকতে ঠেকিয়েছিল এই ছাত্রসমাজ। আর, তিনিই আজ তারই মন্ত্রীসভায় সেই দাঙ্গাবাজকে মন্ত্রী করেছেন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবাজদের রুখে যারা গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছিলেন, তাঁদেরকেই আজ মুখ্যমন্ত্রী শাপ শাপন্ত করে বুঝিয়ে দিলেন বিজেপি বিরোধী তাঁর অবস্থান কত ভঙ্গুর ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে।

রাজ্যের গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকে চরম নৈরাজ্যে ঠেলে, দীর্ঘদিন একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয়কে উপাচার্যহীন রেখে এক অরাজক পরিস্থিতি খোদ মুখ্যমন্ত্রী তৈরি করে রেখেছেন। আর, কেন্দ্রীয় সরকারের অনুচর রাজ্যপাল যেকোনো সুযোগকেই কাজে লাগিয়ে কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ বিরাটভাবেই বাড়িয়ে তুলছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই জটিল পরিস্থিতিকে সুষ্ঠভাবে সমাধান করে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গণতান্ত্রিক পরিসরকে আরও প্রসারিত করা, র‍্যাগিং-বিরোধী কমিটিতে নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধি রাখা, নবাগত ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য আলাদা সুরক্ষিত হস্টেলের ব্যবস্থা করা, প্রাক্তনীদের হস্টেল দখল রাখা থেকে মুক্ত করা, প্রভৃতি একগুচ্ছ পদক্ষেপ কর্তৃপক্ষকে নিতে হবে। সিসিটিভি লাগালেই যে হস্টেলের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হয়না তার উদাহরণ হল জেএনইউ হস্টেলে নাজিব ঘটনা। সমস্ত ‘ব্যবস্থা’ থাকা সত্ত্বেও নাজিব বেমালুম ‘নিখোঁজ’ হয়ে গেল। আজ পর্যন্ত সেই গভীর ‘রহস্যের’ কিনারা হল না।

রাজ্যপাল এমন কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছেন, যা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বশাসনকেই বিপন্ন করে তুলছে। হস্টেলগুলোর নিরাপত্তার দায়িত্ব প্রাক্তন সেনাদের হাতে তুলে দেওয়ার যে প্রস্তাব রেজিস্ট্রার নিতে চলেছেন, তা পরিস্থিতিকে আরও ঘোরালো করে তুলবে। এদিকে, টিএমসি’র বহিরাগতরা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ঢুকে, আন্দোলনরত ছাত্রদের উপর হামলা, মিথ্যা এফআইআর করে ক্যাম্পাস দখলের লক্ষ্যে এক অরাজক অবস্থা তৈরি করছে। মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্বজ্ঞান উক্তির পরই দেখা গেল ওই কান্ড ঘটল।

এখনও প্রকৃত দোষী ধরা পড়েনি। ক্যাম্পাসে একটা চাপা প্রচার রয়েছে, কোনো প্রভাবশালী নেতার সুরক্ষা বলয়ে নাকি তারা নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ এখনও এমন কোনো পদক্ষেপ নেননি যা আস্থা সৃষ্টি করতে পারে। এই ঘটনা অনেকগুলো সমস্যাকে সামনে নিয়ে এল, যা এতদিন ছিল আড়ালে। দ্রুত উপাচার্য নিয়োগ, সমগ্র ছাত্রসমাজের আস্থা ফিরিয়ে আনা, প্রকৃত দোষীদের শাস্তি ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানিক পদক্ষেপ নিয়েই আজকের এই অচলাবস্থার অবসান ঘটাতে হবে।

খণ্ড-30
সংখ্যা-28