প্রশাসনেরই প্রসারিত বাহু যখন বিচারবিভাগ
extended-arm-of-the-administration

কিছুদিন আগে সুপ্রিম কোর্ট ভীমা কোরেগাঁও মামলায় অভিযুক্ত ভেরনন গঞ্জালভেস ও অরুণ ফেরেরাকে জামিন দিল। তাঁরা গত পাঁচ বছর ধরে কারারুদ্ধ ছিলেন। শীর্ষ আদালত বলেছে, নিছক হিংসাত্মক কার্যকলাপের প্রচারসামগ্রি সঙ্গে রাখা বা কোনো সেমিনারে অংশ নেওয়া দমনমূলক ইউএপিএ আইনে ‘সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের’ আওতায় পড়ে না। তার ৫৪ পাতার রায়ে সুপ্রিম কোর্ট আরও বলেছে, কোনো সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের সাথে যোগাযোগ বজায় রাখাটাও সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ চালানো বা সেই সংগঠনের সদস্যপদ গ্রহণের সমার্থক ধরে তাকে অপরাধ বলে গণ্য করা যাবে না। ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি ‘এনআইএ’কে এটা প্রাথমিক ভাবে প্রমাণ করতে হবে যে অভিযুক্ত ব্যক্তি সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ চালিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে এক সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন। একমাত্র তখনই এটা প্রমাণিত হবে যে ওই অভিযুক্ত ব্যক্তি সেই উদ্দেশ্য সাধনেই এক সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের সদস্যতা গ্রহণ করেছিলেন। বিচারপতি দীপঙ্কর বোস তাঁর রায়দানের সময় এই পর্যবেক্ষণ করেছেন।

কিছুদিন আগে সুধা ভরদ্বাজ জামিন পেলেন। এখনও কারারুদ্ধ হয়ে আছেন বেশ কয়েকজন প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবী, অধ্যাপক। মোদী জমানার কোনো ধরনের সমালোচনা, বিরুদ্ধ মত যে সহ্য করা হবে না তা নিশ্চিত করতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে ঢালাও ক্ষমতা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। কুস্তিগিরদের করা গুরুতর অভিযোগ সত্ত্বেও ব্রিজভূষণকে গ্রেপ্তার করল না দিল্লী পুলিশ। কিন্তু, উমর খলিদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েক লক্ষ পাতার এফআইআর করতে তারা বিন্দুমাত্র কুন্ঠিত হয় না।

মোদী তো খোলাখুলি বলেছিলেন, শহুরে নকশালদের কলম ও মস্তিষ্কই নাকি দেশের পক্ষে বিপজ্জনক। গুজরাট দাঙ্গায় মুখ্যমন্ত্রী মোদীর ঘৃণ্য ভূমিকা উদ্ঘাটিত করার জন্য বিবিসি’কে হেনস্থা করা, ভারতে মুষ্টিমেয় ধনকুবেরদের কব্জায় দেশের বিপুল সম্পদ কুক্ষিগত করে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ক্রমেই গভীর দুর্দশায় নিক্ষিপ্ত হওয়ায় যে সামাজিক অসাম্য মোদীর আমলে ক্রমেই চওড়া হচ্ছে, অক্সফাম তার রিপোর্ট প্রকাশ করায় নানান হয়রানির মুখে পড়ে। বিচারব্যবস্থার ভূমিকাও খুবই সন্দেহজনক। যে শীর্ষ আদালতই রায় দিয়ে বলেছিল, জামিন দেওয়াটাই নিয়ম, বছরের পর বছর কারারুদ্ধ করে রাখাটা ব্যতিক্রম, সেই আদালতই আজ অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র হয়ে বসে রয়েছে। অত্যন্ত আগ্রাসী প্রশাসনের সামনে বিচারব্যবস্থা আজ বারবার আত্মসমর্পণ করেছে। কাজ করেছে প্রশাসনেরই এক প্রসারিত বাহু হিসাবে। কিভাবে সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রীয় সরকারের চোখ রাঙানির সামনে নতজানু আত্মসমর্পণ করে তার সাম্প্রতিক একটা উদাহরণ দেওয়া যাক।

ইডি’র কর্ণধার এস কে মিশ্রের অবসরগ্রহণের সময়সীমাকে মোদী সরকার বারবার বাড়িয়ে দেয়। এতে শীর্ষ আদালত ক্ষুব্ধ হয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে তির্যক মন্তব্য করে জানতে চায় কোন অপরিহার্যতা থেকে বারবার তার চাকরির মেয়াদ বৃদ্ধি করা হচ্ছে। এমনও মন্তব্য করেন বিচারপতি, “আপনারা কি অন্য কোনো যোগ্য কর্ণধারকে খুঁজে পাচ্ছেন না, নাকি তার পেছনে রয়েছে অন্য কারণ, যা আদালতকে জানানো হচ্ছে না?” সুপ্রিম কোর্ট বলে যে ২০২১ ও ২০২২-এ এস কে মিশ্রের মেয়াদ বৃদ্ধি বেআইনি। আর, কেন্দ্রীয় সরকারকে সতর্ক করে বলে যে শেষ বারের মতো আদালত তাঁর মেয়াদ ২০২৩’র ৩১ জুলাই পর্যন্ত বাড়াচ্ছে। এরপর কেন্দ্রীয় সরকার ফের তাঁর মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন জানায়। মজার ব্যাপার হল, যে সুপ্রিম কোর্ট এত হুঙ্কার দিয়ে ওই সমস্ত মেয়াদ বৃদ্ধিকে বে-আইনি বলে, সেই সুপ্রিম কোর্টই এবার ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে “বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থের কথা মাথায় রেখে” ইডি কর্ণধারের মেয়াদ বাড়িয়ে দিল ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত!

দিন কয়েক আগে মণিপুর নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট কড়া মন্তব্য করে জানায় যে ওই রাজ্যে সাংবিধানিক শাসন পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। কিন্তু বেশ কিছুদিন আগে মণিপুরের ধারাবাহিক জাতিদাঙ্গাকে থামাতে ব্যর্থ কেন্দ্রীয় সরকারের উপর ভরসা না রেখে আইনজীবী কলিন গঞ্জালভেস যখন সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপের দাবি জানান, তখন সুপ্রিম কোর্টের ভারপ্রাপ্ত বিচারপতি তা খারিজ করে বলেন, “আপনাকে বুঝে নিতে হবে যে আমাদের বেশ কিছু সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করতে হয়”।

গণতন্ত্রের সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজের তাঁবে এনে মোদী ফ্যাসিবাদ আজ দেশে কায়েম করেছে নিরঙ্কুশ দানবীয় শাসন — যা ভারতবর্ষে আগে কখনও দেখা যায়নি। এর বিরুদ্ধে সমগ্র দেশবাসীকে রুখে দাঁড়াতে হবে। উৎখাত করতে হবে এই শ্বাসরোধকারী দেশবিরোধী জমানাকে।

খণ্ড-30
সংখ্যা-26