রাহুল গান্ধীর সংসদে ফিরে আসা-মোদী সরকারের জন্য এক আংশিক ধাক্কা; একে বিজেপি’র ‘চূড়ান্ত পরাজয়’ করে তুলুন!
on-the-ground

মোদী পদবীর মানহানি মামলায় রাহুল গান্ধীর দণ্ডাজ্ঞায় সুপ্রিম কোর্টের স্থগিতাদেশ, ভারতের ক্রম প্রকাশমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁক হয়ে দেখা দিয়েছে। মোদী সরকার চমৎকারভাবে একটা জিনিস আয়ত্ত করে নিয়েছে। সেটা হল সংবিধানের ওপর তার নিরন্তর হামলা আর গণতন্ত্রের গলা টিপে ধরার প্রতিটি পদক্ষেপকে সংসদ ও বিভিন্ন সাংবিধানিক সংস্থাকে কাজে লাগিয়ে ‘বৈধ’ বলে দাবি করা ও বিচারবিভাগীয় অনুমোদনের শীলমোহর আদায় করে নেওয়া! তথাকথিত মোদী পদবীর মানহানি মামলার চিত্রনাট্যও, সুপ্রিম কোর্টে পৌঁছানোর আগে পর্যন্ত সেই একই অশুভ পথ ধরেই এগোচ্ছিল। ২০১৯-এ কর্ণাটকে এক নির্বাচনী সমাবশে দেওয়া ভাষণের জন্য গুজরাটে দায়ের হওয়া এক মানহানি মামলায়, ২৩ মার্চ ২০২৩ রাহুলকে সম্ভবপর সর্বোচ্চ সাজার ঘোষণা শোনানো হয় এবং গত ৪ আগস্ট সুপ্রিম কোর্ট শেষ পর্যন্ত স্থগিতাদেশ দেওয়ার আগে পর্যন্ত, গুজরাটে বিচার বিভাগের সর্বস্তরে ঐ রায়ই বহাল থাকে।

শীর্ষ আদালত সবচেয়ে মৌলিক প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করেছে যেটি গুজরাট হাইকোর্ট এবং নিম্ন আদালতগুলির জিজ্ঞাসা করা উচিত ছিল। দু’বছরের কারাদণ্ড হল একটা ফৌজদারি মানহানির মামলায় সম্ভবপর সর্বোচ্চ সাজা। এ’ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সাজা ঘোষণার কী যুক্তি আছে? প্রশ্নটি আরও প্রাসঙ্গিক এই কারণে যে কারাদণ্ডের মেয়াদ যদি মাত্র একটা দিনও কম হত তাহলে সাংসদ হিসেবে রাহুল গান্ধীর ‘অযোগ্যতা’র প্রশ্নই উঠতো না। দণ্ডাদেশের এই মৌলিক দিকটি বিচার করা দূরস্থান, গুজরাটের আদালতগুলি, বিশেষ করে হাইকোর্ট, রাহুল গান্ধীকে ‘নিয়মিত অপরাধে অভ্যস্ত সাধারণ অপরাধী’ এবং মানহানির অভিযোগকে ‘নৈতিক চরিত্রহীনতা’ হিসেবে দেখানোর জন্য আইনগতভাবে অসমর্থনীয় কিছু যুক্তির আশ্রয় নিয়েছিল। ঠিক তার আগেই সুপ্রিম কোর্ট গুজরাট হাইকোর্টের অ্যাক্টিভিস্ট তিস্তা শেতলবাদের জামিন না মঞ্জুরের রায়কে খারিজ করেছিল। সুপ্রিম কোর্টের চোখে, গুজরাট হাইকোর্টের রায়ের যথেষ্ট অসঙ্গতি ও স্ববিরোধিতাগুলো ধরা পড়েছিল। মানহানির মামলায় রাহুল গান্ধীর দণ্ডাদেশে স্থগিতাদেশ দিতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্ট গুজরাট হাইকোর্টের ইদানীং কালের সন্দেহজনক রায়গুলোর স্পষ্ট উল্লেখ করে বলে, গুজরাট হাইকোর্টের সাম্প্রতিক রায়গুলোর পর্যবেক্ষণ বেশ ‘কৌতূহলোদ্দীপক’!

মানহানি আইনটি অতি ধনী ও ক্ষমতাশালীদের নিজেদের ক্ষমতা ও বিশেষ সুযোগ সুবিধাগুলো সুরক্ষিত রাখা এবং সমালোচক ও বিরোধীদের নিশানা করার জন্য এক চমৎকার হাতিয়ার। মোদী জমানায় এটা বিরোধীদের নিশানা করার জন্য সরকারের একটা রাজনৈতিক হাতিয়ারও হয়ে উঠেছে। মোদী পদবীর মানহানি মামলায়, কেসটি ফাইল করা হয়েছিল সেই ২০১৯ সালে। একটা পর্যায়ে আবেদনকারী নিজেই, তার কাছে পর্যাপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণ নেই বলে, শুনানিপর্বে স্থগিতাদেশ চেয়েছিলেন ও পেয়েও ছিলেন! আদানি গোষ্ঠীর কর্পোরেট জালিয়াতি নিয়ে হিন্ডেলবার্গ নিবন্ধ প্রকাশের পর এবং সংসদে মোদী-আদানি আঁতাতের প্রশ্ন তুলে রাহুল গান্ধীর ভাষণের পর পরই কেসটিকে খুঁচিয়ে তুলে ঝটিতি সুরাট সিজেএম আদালতের হাতে সঁপে দেওয়া হল! আর লোকসভার সচিবালয় অভূতপূর্ব উদ্দীপনায় রাহুলকে ‘অযোগ্য’ ঘোষণার পদক্ষেপ নিতে একদিনও সময় নেয়নি এবং তাঁর সরকারি বাসভবন থেকে তাঁকে উৎখাত করতে একমাসও সময় নেয়নি। মোদী সরকার রাহুল গান্ধীর দণ্ডাদেশের ওপর সুপ্রিম কোর্টের স্থগিতাদেশের তাৎপর্যকে যতই গুরুত্বহীন হিসেবে দেখাতে চাক, জনপরিসরে কিন্তু এটাকে ঐ সরকারের কুৎসিত এবং অশুভ ষড়যন্ত্রের এক ‘ধাক্কা’ বলেই মনে করা হচ্ছে।

ওয়েনাডের সাংসদ হিসাবে রাহুল গান্ধীর পুনর্বহাল হওয়ায় অবশ্য বিজেপির গণতন্ত্রের সংসদীয় ব্যবস্থার ওপর নিরন্তর হামলার এবং তার প্রতিষ্ঠানগুলি ও সাংবিধানিক আইনের শাসনের নীতিগুলির অপব্যবহারের তীব্রতা এতটুকু কমেনি। এমনকি, চারমাস ‘অনুপযুক্ত’ থাকার পর, রাহুল গান্ধী সংসদে ফেরা মাত্র, লোকসভার সচিবালয় উত্তরপ্রদেশের এটাওয়ার অভিযুক্ত বিজেপি সাংসদকে তড়িঘড়ি সেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময় অনুমোদন করল যাতে তিনি দণ্ডাদেশের ওপর স্থগিতাদেশ নিয়ে কোনো ছেদ ছাড়াই তার সাংসদ পদে বহাল থাকতে পারেন। কী অদ্ভুত পরিহাস, রাহুল গান্ধী যেদিন সংসদে ফিরলেন, ঠিক সেদিনই মোদী সরকার দিল্লীর নির্বাচিত সরকারের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া সেই দানবীয় বিলটিকে রাজ্যসভায় পাস করিয়ে নিল। রাজ্যসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকা সত্ত্বেও, মোদী সরকার বিজেডি, ওয়াইএসআরসিপি এবং টিডিপি’র মতো আঞ্চলিক দলগুলিকে কখনও স্তোক বাক্যে ভুলিয়ে, কখনও হুমকি দিয়ে সন্দেহাতীতভাবে গণতন্ত্র বিরোধী, সংবিধান বিরোধী এই বিলকে সমর্থন করতে বাধ্য করে প্রয়োজনীয় সংখ্যা আদায় করে নিয়েছে। এই আম আদমি পার্টি, যেটি মোদী সরকারের জম্মু এবং কাশ্মীরের সাংবিধানিক অধিকার এবং এমনকি রাজ্যের মর্যাদা কেড়ে নেওয়ার দানবীয় পদক্ষেপকে সমর্থন করতে ছুটে গিয়েছিল, আজ বড় কঠিনভাবে বুঝতে পারছে, কাশ্মীরের ওপর আক্রমণ বস্তুত ছিল দিল্লীকে আঘাত হানার আগাম ইঙ্গিত। আক্ষেপ হয়, এখনও যেসব আঞ্চলিক দল মোদী রাজকে সমর্থন করে যাচ্ছে, তারা অচিরেই বুঝতে পারবে যে তারা দেশের সাংবিধানিক গণতান্ত্রের অংশীদারিত্ব ও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর কত বড় ক্ষতি করে চলেছে। প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি এবং বর্তমানে রাজ্যসভার সাংসদ রঞ্জন গগৈ বিলটিকে সমর্থন করতে গিয়ে এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠলেন যে সংবিধানের ‘মৌলিক কাঠামো’টিকেই ‘বিতর্কসাপেক্ষ’ বলে দিলেন! এখানেই এক অশুভ পূর্বসূচনার আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

গণতন্ত্র, তার সাংবিধানিক ভিত্তি এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপর আক্রমণ শুধুমাত্র রাষ্ট্র দ্বারা বা প্রাতিষ্ঠানিক অপব্যবহার বা আইনি ও রাজনৈতিক কৌশলের দ্বারা সংঘটিত হয় না। গোটা ভারতবর্ষ জুড়েই আমরা দেখতে পাচ্ছি প্রতিটি সামাজিক ক্ষেত্রেই একযোগে নিরন্তর হিংসা-তাণ্ডব চলেছে। তিনমাসের ওপর মণিপুর জ্বলছে, প্রধানমন্ত্রী এমনকি সংসদেও এ’ব্যাপারে মুখ খুলতে নারাজ। দিল্লীতে ২০২০তে এবং তারও আগে ২০১৩তে মুজফ্ফরনগরে মুসলিম-বিরোধী হিংসার পুনরাবৃত্তিতে, আমরা দেখতে পাচ্ছি হরিয়ানার মেওয়াত অঞ্চলের ঘটনাটিকে বিজেপি সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ও মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর ধারাবাহিক আক্রমণ চালিয়ে যাওয়ার আরেকটি পরীক্ষাগারে পরিণত করার চেষ্টা করছে। হিন্দুত্ববাদী জনতা সুপরিকল্পিতভাবে একযোগে যে ‘দাঙ্গা’ শুরু করেছিল তাকে এখনও জারি রেখেছে সরকারি ‘বুলডোজার’ চলছে সবকিছু গুঁড়িয়ে দেওয়ার অভিযান। পাঞ্জাব ও হরিয়ানা আদালত সেই অভিযান থামানোর নির্দেশ দিয়েছে, কিন্তু তার আগেই, খাট্টার সরকার ‘জবরদখল উচ্ছেদ’এর নামে নুহ’তে মুসলিমদের কয়েক ডজন ঘরবাড়ি, দোকানপাট গুঁড়িয়ে দিয়েছে। নিরাপত্তাহীনতা ক্রমশ বাড়তে থাকায় বিহার ও পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম পরিযায়ী শ্রমিকরা ইতিমধ্যেই বাধ্য হয়েছেন হরিয়ানা ছেড়ে নিজেদের রাজ্যে ফিরে আসতে।

নুহ তাণ্ডবে, গুরুগ্রামের মসজিদ আক্রমণ, তরুণ ইমাম মৌলানা সাদের বর্বরোচিত হত্যা, বুলডোজার-চালিত ধ্বংস পর্ব এবং নিগ্রহ অভিযানের লক্ষ্য — অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরবর্তী পর্যায়ের নির্বাচনগুলির ঠিক আগে, সন্ত্রাসের রাজত্বকে তীব্রতর করা এবং সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে তীক্ষ্ণতর করা। বিজেপি নেতা কৈলাস বিজয়বর্গীয় মধ্যপ্রদেশে এক প্রচার ভাষণে সেটা খুব স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন। বিজয়বর্গীয়র হুঁশিয়ারি, ‘ভারত মাতা’র বিরুদ্ধে যারা কিছু বলবে, তাদের হত্যা করতে বিজেপি বিন্দুমাত্র ইতস্তত করবে না! এটা, সংঘ বাহিনী যাদের ‘দেশদ্রোহী’ বলে দাগিয়ে দেবে, তাদের বিরুদ্ধে পরিষ্কার এক গণনিধনের হুঁশিয়ারি! নয় বছর ক্ষমতায় থাকার পর, সংঘ-বিজেপি প্রতিষ্ঠান এখন বিপজ্জনক মাত্রায় উদ্ধত ও আগ্রাসী হয়ে উঠেছে। এটা আরও বেড়ে গেছে ক্ষমতা হারানোর ভয়ে এবং গণতন্ত্র ও জনগণের বিরুদ্ধে তার স্বভাব ঘৃণায়।

রাজ্যসভায় দিল্লী-বিল পাশ করানোর উদ্দেশ্য, সম্ভবত শুধুই মোদীরাজের ক্ষমতার দম্ভকে বাড়িয়ে তোলা। ঐক্যবদ্ধ বিরোধীশক্তিকেই একে সমূলে পরাস্ত করতে হবে। আর সেজন্য এই শক্তিকে উৎপীড়িত ও নিগৃহীত মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে এবং আগামী নির্বাচনগুলিতে উদ্ধত সংঘ-বিজেপি বাহিনীর বিরুদ্ধে যোগ্য প্রত্যাঘাত হানতে মানুষকে সমাবেশিত করতে হবে।

- এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ১৪ আগস্ট ২০২৩

খণ্ড-30
সংখ্যা-28