সমীক্ষা বিষয়ে লেখালিখি : পর্ব-১ -- সমীক্ষা বিষয়ে কিছু গোড়ার কথা
about-surveys

নতুন পথচলার প্রয়োজন যখন দেখা দেয়, অথচ কোন পথে এগোতে হবে তাই নিয়ে কিছু আভাস ইঙ্গিৎ থাকলেও স্পষ্ট কোনও দিশা থাকে না, উপযুক্ত তথ্য থাকে না, তখন সমীক্ষা খুব জরুরি হয়ে ওঠে। সমীক্ষা নানা ধরনের সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানকেই চালাতে হয়। বহুজাতিক কর্পোরেটরা তাদের পণ্যের বাজার বোঝার জন্য যেমন সমীক্ষা করেন, তেমনি বিপ্লবী রাজনৈতিক শক্তি কীভাবে একচেটিয়া পুঁজির বিরুদ্ধে লড়বেন তা বুঝতেও সমীক্ষা চালান। এই দুই সমীক্ষার আদর্শ উদ্দেশ্য একেবারে বিপরীত, কিন্তু নিজস্ব লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে নির্মোহ, বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান উভয়েরই প্রয়োজন। বিপ্লবী রাজনীতি সমাজের বদল ঘটাতে চেয়ে যেমন সমীক্ষা করে তাদের কাজের রীতি পদ্ধতি ঠিক করেন, তেমনি আবার শাসক দল তাদের শাসন ক্ষমতা নিরঙ্কুশ রাখার প্রয়োজনে কোন ধরনের সংস্কার আনতে হবে তা বুঝতে সমীক্ষা চালান। দল নিরপেক্ষভাবেই রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নানা ধরনের সমীক্ষা নিয়মিত চালানো হয়। ভারতের ন্যাশানাল স্যাম্পেল সার্ভে স্বাধীনতার পর থেকে যে সমীক্ষা চালিয়ে আসছে ধারাবাহিকভাবে, সেগুলো ভারতের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি বুঝতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নানা ধরনের সমীক্ষা চালাতে হয় গবেষকদের, নীতি নির্মাতাদের, সমাজ কল্যাণে নিবেদিত সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও।

বাংলার বুকে নানা ধরনের সমীক্ষা চালানোর ইতিহাস অনেক পুরনো। গত একশো বছরে করা কয়েকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সমীক্ষা নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করে আমরা এগুলির গুরুত্ব বোঝার চেষ্টা করতে পারি।

১৯৩৭’র নির্বাচনের পর যখন ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন কৃষক প্রজা পার্টির সরকার ক্ষমতায় এল, তখন নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি মেনে ভূমি সংস্কারের উদ্দেশ্যে স্যার ফ্রান্সিস ফ্লাউডের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠিত হয়। কমিশনের বিচার্য ছিল ভূমি রাজস্ব প্রশাসন সংক্রান্ত সমস্যাবলির সমাধান বিশেষত জমিদারি প্রথা বাতিল সংক্রান্ত বিষয় বিবেচনা করা। ব্যাপক সমীক্ষা, মতামতগ্রহণ ও অনুসন্ধানের পর ফ্লাউড কমিশন তাদের রিপোর্ট পেশ করে। ১৯৪০ সালের ২ মার্চ কমিশনের সুপারিশমালা পেশ করা হয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থা বাতিল এবং ভূমি নিয়ন্ত্রণে সকল মধ্যবর্তী স্বত্ব বিলোপ সাধন উক্ত সুপারিশমালার অন্তর্ভুক্ত ছিল। লক্ষ করা যায় যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের সময় থেকে ভূমি নিয়ন্ত্রণে যে পরিবর্তন ঘটে নতুন পরিস্থিতিতে তা অনুপযোগী ও ক্ষতিকর ব্যবস্থায় পরিণত হয়। এ সুপারিশগুলি ১৯৪৪ সালের প্রশাসনিক তদন্ত কমিটির জোরালো সমর্থন লাভ করে। কিন্তু ফ্লাউড কমিশনের সুপারিশমালা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকার খুব বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেনি। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, ১৯৪৩ সালের মহাদুর্ভিক্ষ, সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা এবং ভারত বিভাগের রাজনীতি প্রভৃতি ছিল এর প্রধান অন্তরায়। এসব সীমাবদ্ধতার কারণে ফজলুল হক, খাজা নাজিমউদ্দীন ও সোহরাওয়ার্দী সরকারের আমলে ফ্লাউড কমিশন রিপোর্টের বাস্তবায়ন স্থগিত থাকে, যদিও সবকটি সরকারই জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহী ছিল।

প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মাঝের সময়টায় বাংলার কল কারখানা ও কারখানা শ্রমিকদের বিষয়েও কিছু উল্লেখযোগ্য অনুসন্ধান চালানো হয়। ১৯২৯ সালে রয়াল কমিশন অব লেবার তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনের পক্ষ থেকে কলকাতার শ্রমিক মহল্লাগুলিতে একটি ব্যাপক সমীক্ষা চালিয়েছিল। এই সমীক্ষায় শ্রমিকদের অপুষ্টি, থাকার জায়গার সমস্যা ও জীবনযাত্রার সার্বিক খারাপ মানের কথা উঠে আসে। কমিশন কিছু বিজ্ঞানসম্মত সমীক্ষার প্রস্তাব দেয়, যেই সমীক্ষাগুলি সুনির্দিষ্ট কিছু সমস্যাকে চিহ্নিত করে সমাধানের সুপারিশ করতে পারবে। ফ্লাউড কমিশনের সমীক্ষার পর্বেই ১৯৪১ সালে প্রশান্তচন্দ্র মহালানবীশ কলকাতার শ্রমিকদের নিয়ে এক সমীক্ষা চালান। সেই সময় চটকলগুলিই ছিল প্রধান শিল্প কারখানা, সবচেয়ে বেশি শ্রমিক এগুলিতেই নিযুক্ত ছিলেন। জগদ্দল, বজবজ ও আসানসোলের একটি করে জুটমিল বেছে নিয়ে এই সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে প্রশান্তচন্দ্র মহালানবীশের সহযোগিতা ও পরামর্শে ১৯৪৮-৪৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃতত্ত্ব বিভাগের তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান কে পি চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে বাংলার জুট শ্রমিকদের নিয়ে একটি বিস্তারিত সমীক্ষা চালান।

এবার একুশ শতকের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সমীক্ষার কথায় আসা যাক। প্রথমেই বলা যাক বন্ধ কলকারখানার সমস্যা নিয়ে করা সমীক্ষাটির কথা। ২০০৫ সালে কলকাতার নাগরিক মঞ্চর উদ্যোগে করা এই সমীক্ষা পশ্চিমবঙ্গের বন্ধ কলকারখানা, তার শ্রমিকদের সমস্যা, তাদের স্বনিযুক্তি ও পুনর্বাসনের প্রশ্ন, কলকারখানার উদ্বৃত্ত জমির ব্যবহারের মতো নানা বিষয়কে রাজনীতির অঙ্গনে নিয়ে আসে।

বিশেষ জনগোষ্ঠীর জীবন যাপনের মান, সুবিধে অসুবিধে ইত্যাদি বোঝার জন্য যেসব সমীক্ষা হয়েছে তারমধ্যে সাম্প্রতিককালের একটি সমীক্ষার কথা এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। ২০১৬ সালে স্ন্যাপ এবং গাইডেন্স গিল্ড সংস্থাদ্বয়ের পক্ষ থেকে প্রতীচী ট্রাস্টের সহায়তায় এই গুরুত্বপূর্ণ সমীক্ষা রিপোর্টটি প্রকাশিত হয়। রিপোর্টটির নাম ‘লিভিং রিয়েলিটি অব মুসলিমস ইন ওয়েস্ট বেঙ্গল’। সমীক্ষাটি করা হয় বহুদিন ধরে এবং এর পরিসরও ছিল বিস্তৃত। ৯৭,০১৭টি পরিবারের ওপর এই সমীক্ষা চালানো হয়। এর মধ্যে ৭৯,৯১৩টি গ্রামীণ পরিবার ও ১৭,১০৪টি শহুরে পরিবার। সমীক্ষার আওতায় এসেছেন ৪,৬৩,৯০৪ জন মানুষ। সরকারি বা বেসরকারি স্তরে সাম্প্রতিক অতীতে মুসলিম জনগোষ্ঠী নিয়ে এ’ধরনের বিস্তৃত কোনও সমীক্ষা হয়নি। ফলে এই সমীক্ষাটি রাজ্যের মুসলিম জনগোষ্ঠীর হাল হকিকত বুঝতে অত্যন্ত কার্যকরী। জনবিন্যাস, স্বাক্ষরতা ও শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, লিঙ্গগত সাম্য অসাম্য, নাগরিকত্বর প্রশ্নে বিভিন্ন সুবিধা অসুবিধা, বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা ও সাংস্কৃতিক মানের মতো অত্যন্ত গুরূত্বপূর্ণ কয়েকটি দিকের ওপর এই সমীক্ষা আলো ফেলেছে।

কোভিড লকডাউনে দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ফলে স্কুল শিক্ষার যে মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে তা প্রায় সবাই জানেন। এই ক্ষতি কতটা গভীর ও ব্যাপক তা জানার জন্য দরকার ছিল একটি ব্যাপক সমীক্ষার। কিছুদিন আগে অর্থনীতিবিদ ও সমাজ বিশেষজ্ঞ জঁ দ্রেজের নেতৃত্বে এইরকম একটি সমীক্ষা হয়েছে। তার রিপোর্টও প্রকাশিত হয়েছে। আগস্ট ২০২১এ এই সমীক্ষাটি চালানো হয় ভারতের ১৫টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল জুড়ে। তারমধ্যে আছে অসম, বিহার, চণ্ডীগড়, দিল্লী, গুজরাট, হরিয়ানা, ঝাড়খন্ড, কর্ণাটক, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব, তামিলনাড়ু, উত্তরপ্রদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গ। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলাগুলি নিয়ে আলাদা একটি সমীক্ষাও হয়েছে এই সময়ে এবং সেখানেও একই ধরনের ফলাফল উঠে এসেছে।

রিপোর্ট থেকে দেখা যাচ্ছে যে গ্রামীণ এলাকায় মাত্র ২৮ শতাংশ ছাত্রছাত্রী এই পর্বে নিয়মিত পড়াশুনো করেছে। ৩৫ শতাংশ ছাত্রছাত্রীর পড়াশুনো চলেছে অনিয়মিতভাবে। আর ৩৭ শতাংশ ছাত্রছাত্রী পড়াশুনোর সম্পূর্ণ বাইরে থেকেছে। সমীক্ষকরা দেখেছেন ৫০ শতাংশ ছাত্রছাত্রী কয়েকটি শব্দও একটানা পড়তে পারছে না। অভিভাবকরাও জানিয়েছেন যে তাদের সন্তানদের অনেকেই এই সময় পড়া ও লেখার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে, কারণ অনলাইন শিক্ষার সুযোগ তাদের সন্তানদের পক্ষে সেভাবে নেওয়া সম্ভব হয়নি। এই সমীক্ষা রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে যে শহুরে এলাকায় ২৪ শতাংশ ছাত্রছাত্রী নিয়মিত অনলাইন ক্লাসের সুবিধে নিতে পেরেছে। গ্রামীণ এলাকায় পেরেছে মাত্র ৮ শতাংশ ছাত্রছাত্রী। স্মার্টফোন না থাকাটা এর একটা কারণ কিন্তু একমাত্র কারণ নয়। যে সমস্ত পরিবারের স্মার্টফোন আছে, শহুরে এলাকায় সেই সব ঘরের ছাত্রছাত্রীদের ৩১ শতাংশ নিয়মিত অনলাইন ক্লাস করেছে। গ্রামীণ এলাকায় করেছে স্মার্টফোন থাকা পরিবারের মাত্র ১৫ শতাংশ ছাত্রছাত্রী। এর কারণ খতিয়ে দেখতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে স্মার্টফোন মূলত পরিবারের রোজগেরে সদস্য সঙ্গে নিয়ে কাজে চলে যান, ফলে অনলাইন ক্লাসের সময় ছাত্রছাত্রীরা তা ব্যবহার করে উঠতে পারে না। সমীক্ষা রিপোর্ট জানিয়েছে মাত্র ৯ শতাংশ ছাত্রছাত্রীর নিজেদের স্মার্টফোন আছে। স্মার্টফোনের সমস্যা ছাড়াও অনলাইন ক্লাসের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে দুর্বল ইন্টারনেট ব্যবস্থা ও ইন্টারনেটের ডেটা প্যাক কেনার ক্ষমতার অভাব। শহুরে এলাকার মাত্র ২৩ শতাংশ অভিভাবক মনে করেছেন তাদের সন্তানরা ঠিকমত অনলাইন ক্লাস করতে পেরেছে। গ্রামীণ এলাকায় এটা মাত্র ৮ শতাংশ।

সমীক্ষা কোথায় হচ্ছে, তার ভিত্তিতে সমীক্ষার পদ্ধতিতে কিছু বদল আনতে হয়। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে অনুসন্ধান চালানো সমীক্ষকরা খেয়াল করেন যে সাধারণভাবে প্রবীণ মানুষেরা দীর্ঘক্ষণ কথা বলতে আগ্রহী থাকেন এবং তাঁদের কথার মধ্যে দিয়ে মৌখিক ইতিহাস অনেকটাই ধরা পড়ে। বদলগুলোকেও তাঁরা দীর্ঘ সময়ের পটে চিহ্নিত করে দিতে পারেন। কী বদল হয়েছে সেই তথ্যটুকুই শুধু নয়, বদলকে তাঁরা কী চোখে দেখছেন সেই দৃষ্টিকোণটাও ধরা পড়ে। তবে রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত বা কাছাকাছি থাকা মানুষেরা অনেক হিসাব করে মেপে কথা বলেন। চায়ের দোকানের আড্ডা বা মন্দির মসজিদের জমায়েতে হাজির হলে অনেক আলাপ আলোচনা তথ্য জানা সম্ভব। গ্রামের মানুষের সাধারণ মেজাজ বোঝার জন্য এই ধরনের আড্ডা বা জমায়েত খুবই সাহায্য করে। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে দোকানে বা বাজারে সন্ধ্যের পর জমা হয়ে আড্ডা মারার প্রবণতা রয়েছে। সমীক্ষকদের এখানে হাজির হয়ে কথা শোনা জরুরি।

আবার আজকের দিনে শহর বা শহরতলীর গিগ শ্রমিকদের মধ্যে যদি সমীক্ষা চালাতে হয়, এই ক্রম বিকাশমান জীবিকা ও সংলগ্ন অর্থনীতিকে বুঝতে, তাহলে একেবারে ভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। গিগ শ্রমিকেরা মূলত অল্পবয়সী যুবক-যুবতী। কোনও নির্দিষ্ট জায়গায় তাদের অনেককে একসঙ্গে বেশি সময়ের জন্য পাওয়া যাবেনা। ফলে তাদের মধ্যে সমীক্ষা চালাতে হবে অল্প সময়ে, সুনির্দিষ্ট কিছু প্রশ্নমালার ভিত্তিতে।

সমীক্ষা করার সময়ে কেন সমীক্ষা করতে চাইছি তা নিয়ে সমীক্ষকদলকে খুব স্পষ্ট থাকতে হবে। কিন্তু সমীক্ষা করতে হবে সম্পূর্ণ খোলা মনে কোনও পূর্বসিদ্ধান্তকে মনে স্থান না দিয়ে। সমীক্ষা করার সময়ে কোন ধরনের পদ্ধতি প্রকরণ আজকের দিকে অনুসন্ধান করা হয়, কোন কোন ধরনের সমস্যা সাধারণভাবে সমীক্ষকদের সামনে উপস্থিত হয়, সেগুলি কাটানোর জন্য বিশেষজ্ঞরা কী পরামর্শ দেন, সমীক্ষাজাত তথ্যকে কীভাবে বিশ্লেষণ করতে হয় — এইসমস্ত রীতি পদ্ধতি বিষয়ে আমরা পরে আরো কিছু কথা বলব।

- সৌভিক ঘোষাল

খণ্ড-30
সংখ্যা-26