বিচারকের বুলডোজার মন্ত্রণা
-bulldozer-ministry

এ কেমন জাজ,

চাইছেন বুলডোজার রাজ!

ইস্টার্ন কোলফিল্ড লিমিটেড। এরা ঝাড়খন্ডে ৯টি এবং পশ্চিমবঙ্গে ৭টি বিদ্যালয় পরিচালনা করে। পশ্চিমবাংলায় এই স্কুলগুলির শিক্ষকরা বহুদিন বেতন পান না। কেউ ১০ মাস ধরে, কেউ ৭ বছর ধরে। মাসের পর মাস তাঁরা ‘অনিয়মিত শিক্ষক’। এই শিক্ষকেরা মাসের শেষে দিন গুজরানের জন্য ৫০০০ টাকা হাতে পান। এরাই ন্যায় বিচারের প্রত্যাশায় রাজ্যের সর্বোচ্চ আদালত হাইকোর্টের শরণাপন্ন হলেন। বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ‍্যায়।

৩১ জুলাই ২০২৩, সোমবার দ্বিপ্রহর। রাজ্যের অতি পরিচিত এই বিচারপতি আদালতে শুনানি চলাকালীন প্রারম্ভিক কিছু নির্দেশ (রেজিস্ট্রারের কাছে ৪ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা জমা রাখা) এবং শিক্ষকদের দুঃখে চোখের জল ফেলার পর বলতে শুরু করলেন এমন সব কথা যা শুনলে মনে হয়, একজন ‘ভক্ত’র কথা শুনছি। বিচারপতি বলতে শুরু করলেন মনের কথা, “অমৃতকাল চলছে, স্কুল চালাতে না পারলে আদানির হাতে তুলে দিন”। সত্যিই তো! দেশের প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকার অমৃতকালে যখন রেল, রাস্তা, বিমানবন্দর, স্টেশন, রাষ্ট্রায়ত্ত সমস্ত প্রতিষ্ঠান আদানি, আম্বানি ভাইদের হাতে তুলে দিচ্ছেন, তখন একটা বা দুটো স্কুল বা গোটা শিক্ষাক্ষেত্রকে আদানির হাতে তুলে দেওয়ার জজিয়তি অস্বাভাবিক কি? সাধু, সাধু!

রাজ্যবাসী অবশ্য আদালত কক্ষে বিচারপতির মুখে আরও আধুনিক, আরও রাজনৈতিক ভাষণের নমুনা দেখেছে দিন কয়েক আগেই। ২৮ জুলাই ২০২৩, কলকাতা পৌরসভা অঞ্চলে বে-আইনি নির্মাণ প্রসঙ্গে এক মামলার শুনানির সময়। কলকাতা পৌরসভা ও কলকাতা পুলিশের গুণ্ডা দমন শাখার আধিকারিকদের ভুয়সী প্রশংসার পাশাপাশি আদালত কক্ষেই বিচারপতি শোনালেন, “দরকার পড়লে যোগী আদিত্যনাথ সরকারের কাছ থেকে বুলডোজার ভাড়া করুন”! পরিস্কার কথা। আইন কানুন উকিল মোক্তার বিচার বিভাগের দরকার কি, বুলডোজ করে দেওয়া হোক সরাসরি। যোগী তো করেই দেখাচ্ছেন। তাঁর কাছ থেকেই আনা হোক সেই শাসকীয় কারিগরি।

আইনের শাসনের প্রতি এই চরম অবজ্ঞা মোদী-যোগী শাসনের মূল কার্যধারা। রাজ‍্যের এক অশুভ অঘোষিত আঁতাত এই বিচারককেই প্রায় ভগবান বানাতে চায়, যিনি প্রথম থেকেই ধাপে ধাপে ইঙ্গিত দিতে দিতে এখন প্রকাশ‍্যেই এরাজ‍্যে যোগী-মোদী রাজ আনার জজিয়তি করছেন। ৭৫’র জরুরি অবস্থার দিনগুলোতে জব্বলপুর এডিএম মামলার কথা মনে পড়ে গেল। তখন চলছিল ঘোষিত জরুরি অবস্থা। বিচারপতি জানিয়েছিলেন জরুরি অবস্থার কথা। এখন চলছে অঘোষিত দীর্ঘস্থায়ী জরুরি অবস্থা। আদালত কক্ষে বিচারপতিরা আজ বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া, কাল এনকাউন্টার চালিয়ে হত‍্যা করার কথা বলছেন। এতে হয়তো আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। আশ্চর্য হতে হয় যখন সততা, নৈতিকতা এবং আরও সব কঠিন কঠিন আদালতি শব্দে এই ধরনের বিচারপতির ভুয়সী প্রশংসা করতে দেখা যায় বামপন্থী দলের অতিপরিচিত আইনজীবীদের। অথবা, হয়তো, এটাও বাংলার মাটিতে আর অবাক করা অপ্রত‍্যাশিত নেই আর বিগত কয়েক বছরের অঘোষিত অশুভ আঁতাতের বাস্তবতায়।

নাটক এখানেই শেষ নয়। এই বিচারপতিই আদালত কক্ষে বিনা বাধায় গণহত্যার উসকানিতে ব‍্যবহৃত শব্দ ও বাক্য ব্যবহার করেন। স্কুল শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির মামলায় ধেড়ে ইঁদুর ধরে আনার হুমকি দিয়েছিলেন এই বিচারপতি। ইতিহাস বলে, হিটলারের গেস্টাপো বাহিনী গ্যাস চেম্বারে ইহুদীদের ধরে আনার সময় ইঁদুর ধরার কথা বলতো। বছর দুয়েক ধরে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত ক্ষমতাধর অমিত শাহ মহাশয় অনুপ্রবেশকারীদের উই পোকার মতো পিষে মারার কথা শুনিয়েছিলেন। ফ্যাসিস্ট গেস্টাপো নায়কদের কথার সঙ্গে উচ্চ আদালতের বিচারকের কথার সুন্দর মিল। বোঝার উপায় নেই, কে কথা বলছেন, দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাকি আদালতের কোন ধর্মাবতার!

আদালতের মেরুদণ্ড বাঁকিয়ে দেওয়ার যে কঠিন কাজ ফ্যাসিস্টরা হাতে নিয়েছিল, তা যে এতো সহজে হয়ে যাবে তা সম্ভবত ওরাও ভাবতে পারেনি। ঘন্টা খানেক নিস্পাপ সাক্ষাৎকার দেওয়ার এটাই নিট লাভ।

জনগণের দায়িত্ব তাই বেড়ে গেল। গণতন্ত্র ও আইনের শাসন রক্ষার দায়িত্ব জনগণকেই কাঁধে নিতে হবে।

- পার্থ ঘোষ

খণ্ড-30
সংখ্যা-26