মণিপুরে জিঘাংসার শিকার আদিবাসীদের জন‍্য সুবিচার চাই
victims-of-rape-in-manipur

মণিপুরের আদিবাসীদের সুরক্ষা দিতে ব‍্যর্থ কেন্দ্র ও রাজ‍্যের বিজেপি সরকারকে ধিক্কার

আদিবাসীদের ওপর ক্রমবর্ধমান অত‍্যাচার এবার রুখে দাও

জল জঙ্গল জমির কর্পোরেট লুট থামিয়ে দাও

আমরা সমস্ত আদিবাসীদের প্রতিবাদে সামিল হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। দেশজুড়ে আদিবাসী জনতার ওপর উত্তরোত্তর বেড়ে চলা অত‍্যাচার এবং ক্রমাগত তাঁদের আরো দুর্দশা আরো প্রান্তিক জীবনে ঠেলে দেওয়ার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানাচ্ছি। ২০২৩’র ৯ আগস্ট আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসে আসুন আমরা শপথ নিই, আমাদের অধিকার আমাদের স্বার্থ আমরা রক্ষা করব।

মধ‍্যপ্রদেশের সিঢ়ি জেলা ও উত্তরপ্রদেশের সোনভদ্রায় গায়ে পেচ্ছাপ দেওয়ার জঘন‍্য ঘটনা থেকে, এবং মণিপুরের দুই কুকি-জো মহিলাকে নগ্ন করে, গায়ে হাত দিতে দিতে, মারতে মারতে ঘোরানো ও শেষে একটা মাঠে নিয়ে ফেলে ধর্ষণ করার চরম মর্মান্তিক ভিডিও থেকে একথা খুবই স্পষ্ট হয়ে গেছে যে বর্তমান শাসক দলটি আদিবাসীদের ভালোমন্দের তোয়াক্কাই করে না। আরএসএস-বিজেপি সংঘ পরিবার যে মনুস্মৃতিকে সংবিধান হিসেবে তুলে ধরে সেই মনস্মৃতি আসলে দলিত ও আদিবাসীদের ওপর চরম বৈষম‍্য ও হিংস্রতা চালানোর সামাজিক অনুমোদন দেয়।

দেশজুড়ে আদিবাসীদের ওপর অত‍্যাচার বছর বছর বেড়েই চলেছে। ২০২০ সালে অত‍্যাচারের মামলা ছিল ৮২৭২টি, পরের বছর তা বেড়ে হয়েছে ৮৮০২টি। এরমধ‍্যে আছে আদিবাসী মেয়েদের ওপর, মণিপুরের মতো, হিংস্র যৌন অত্যাচারের অনেক ঘটনাও। বিজেপির উত্থান এবং তার আগ্রাসী হিন্দুত্ব রাজনীতি ‘এসসি ও এসটি নিপীড়ন নিবারণ আইন, ১৯৮৯’কে ক্রমাগত অকেজো করেছে এবং এই আইনকে আরো লঘু করে দেওয়ার, এমনকি একদম তুলে দেওয়ার জন‍্য চেঁচামেচিও শোনা যাচ্ছে।

এইসব হিংস্রতা ছাড়াও বিজেপি শাসনে আদিবাসীরা খতরনাক হামলার সম্মুখীন হতে চলেছেন জঙ্গল আইনের নয়া সংশোধনীর মাধ‍্যমে যা জঙ্গল এলাকা থেকে আদিবাসীদের সরিয়ে দিতে চায়। আর সেই সাথে মোদী সরকার আনতে চাইছে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি যা আদিবাসীদের সংবিধান প্রদত্ত রক্ষাকবচ ও সুযোগ সুবিধা নাকচ করে দেবে এবং আদিবাসীদের অন্যান‍্য রীতিনীতি, প্রথা ও অনুশীলনকে চরম ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

অন‍্যদিকে, রাষ্ট্র অনুমোদিত কর্পোরেট লুট তথা প্রাকৃতিক সম্পদের ধ্বংস সাধন এবং নয়া উদার অর্থনীতির মাধ‍্যমে আদিবাসীদের জঙ্গল ও জমি থেকে উৎখাত করার ফলে আদিবাসীদের জীবন ও জীবিকা বর্তমানে সম্পূর্ণ অরক্ষিত হয়ে পড়েছে এবং নিজেদের সংস্কৃতি ও পরিচিতি বাঁচিয়ে রাখতে লড়াই করতে হচ্ছে। জমি, শিক্ষা, স্বাস্থ‍্যসেবা, জীবিকা, খাদ‍্য নিরাপত্তা, পানীয় জল, স্বাস্থ‍্যকর পরিবেশ ইত‍্যাদি মৌলিক প্রয়োজনীয়তা পূরণের জন‍্য আদিবাসীদের লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে।

এই সবের মাঝেই আরএসএস তাদের ‘জনজাতি ধর্ম সংস্কৃতি সুরক্ষা মঞ্চ’র মধ‍্যে দিয়ে ‘আদিবাসীদের হিন্দুত্বকরণ’এর চেষ্টা চালাচ্ছে এবং আদিবাসীদের নিজেদের ধর্মপরিচিতি বেছে নেওয়ার অধিকারকে অস্বীকার করছে। অভিন্ন দেওয়ানি বিধিও আসলে এইসব সম্প্রদায়কে জোর করে হিন্দুত্বের অধীনস্ত করার প্রচেষ্টা। স্পষ্টতই আরএসএস আদিবাসীদের মধ‍্যে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন ঘটাচ্ছে এবং সংবিধান প্রদত্ত অধিকারগুলি ছিনিয়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে।

আদিবাসীরা ভারতের জনসংখ‍্যার এক দশমাংশ। তাঁরাই ভারতের আদি বাসিন্দা। তাঁদের পূর্বজ বংশধরেরাই ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম মানব বসতি স্থাপন করেছিল। এবং তাঁরা যৌথতা, সামাজিকতা, সহ-অবস্থান, সহযোগিতা ও সহমর্মিতায় বিশ্বাস করেন। তাঁরাই এই ভূখণ্ডের প্রথম নাগরিক। এবারের আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসে আসুন আমরা অঙ্গীকার করি আমাদের অধিকার রক্ষায় লড়াই করার এবং মোদী সরকারকে বাতিল করার, যে সরকার আদিবাসী সংস্কৃতি পরিচিতি জীবিকা ও অস্তিত্ব মুছে ফেলতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

we-want-justice-for-the-tribals
আমরা দাবি তুলছি

১) মধ‍্যপ্রদেশ ও উত্তরপ্রদেশে গায়ে পেচ্ছাপ করে দেওয়ার জঘন‍্য ঘটনা দুটি এবং মণিপুরে আদিবাসীদের ওপর অত্যাচারের ঘটনা সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে তদন্ত কর; এসসি এসটি নিপীড়ন নিবারণ আইন ১৯৮৯ কঠোরভাবে লাগু কর; এই আইনের অধীনে যে বিভিন্ন কমিটি গঠিত হয়েছে তাদের অবশ‍্যই নিয়মিত রিভিউ চালিয়ে আদিবাসীদের সুরক্ষা প্রশ্নে ইউনিয়ন ও রাজ‍্য সরকারের কাছে পরামর্শ পাঠাতে হবে।

২) মণিপুরে হিংসা হামলা বন্ধ কর। হিংসার শিকার হওয়া প্রতিটি পরিবারকে এবং যাদের যাদের সম্পদ নষ্ট হয়ছে তাঁদের প্রত‍্যেককে ক্ষতিপূরণ দাও। খুন লুট তাণ্ডবে যুক্ত সকলের বিরুদ্ধে কঠোর ব‍্যবস্থা নেওয়া হোক। ঘরছাড়াদের ঘরে ফেরানোর যথাযথ বন্দোবস্ত কর, নাহলে তাঁদের পূর্ণাঙ্গ ও সার্বিক পুনর্বাসন দাও। তথ‍্যানুসন্ধানী দলের সদস‍্যদের ওপরে চাপানো ফৌজদারি মামলা প্রত‍্যাহার কর।

৩) ইউনিয়ন গভর্মেন্ট ও রাজ‍্য সরকারগুলি ৯ আগষ্ট আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসে জাতীয় ছুটি ঘোষণা করুক।

৪) ভারত আইএলও ১৬৯নং প্রথাকে মান‍্যতা দিয়ে আদিবাসী সম্প্রদায়গুলির জন‍্য বিবিধ সুরক্ষা ব‍্যবস্থার বাধ‍্যতামূলক ব‍্যবস্থাপনা গ্রহণ করুক এবং তাঁদের পরম্পরাগত ভূমি ও সম্প্রদায়কে প্রভাবিত করে এমন সমস্ত প্রজেক্টের প্রশ্নে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়ায় আদিবাসীদের অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করুক।

৫) আদিবাসী সমাজকে সাম্প্রদায়িক করা ও বিভাজন করার অপচেষ্টা চালানোর দায়ে ‘জনজাতি ধর্ম সংস্কৃতি সুরক্ষা মঞ্চ’র বিরুদ্ধে ব‍্যবস্থা নেওয়া দরকার — আদিবাসীদের নিজস্ব বিশ্বাস, প্রথা ও উৎসব অনুশীলনের অধিকার আছে।

৬) সংবিধানে বিধৃত ২৪৪(ক) অনুচ্ছেদ মেনে আসামের পার্বত‍্য আদিবাসী জেলাগুলিকে স্বায়ত্ব শাসিত রাজ‍্য হিসেবে ঘোষণা কর।

৭) সমস্ত রাজ‍্যে ৩০ শতাংশ আদিবাসী জনসংখ‍্যা বিশিষ্ট সমস্ত শহর ও গ্রামকে তপশীলভূক্ত এলাকা হিসেবে ঘোষণা কর।

৮) ‘পেশা’ আইন শক্তিশালী কর এবং তপশীলভূক্ত এলাকার শহরগুলিতেও এই আইন প্রসারিত কর।

৯) ২০০৬’র বনাধিকার আইন কঠোরভাবে কার্যকর কর; এই আইনের আওতায় প্রতিটি ভূমিহীন আদিবাসী পরিবারকে ২ একর আবাদী জমি ও ৫ একর অনাবাদী জমির পাট্টা দাও।

১০) অরণ‍্য (সংরক্ষণ) আইন ও বন‍্যপ্রাণ সুরক্ষা আইনের সংশোধনী প্রত‍্যাহার কর।

১১) স্কুল, চিকিৎসা পরিষেবা, বিদ‍্যুৎ, রাস্তা, পানীয় জল ইত‍্যাদি বুনিয়াদি সুযোগসুবিধা ১০০ শতাংশ আদিবাসীদের পাওয়া নিশ্চিত করতে ইউনিয়ন গভর্মেন্ট ও রাজ‍্য সরকারগুলি অতি অবশ‍্যই সময় বেঁধে পরিকল্পনা গ্রহণ করুক।

১২) আদিবাসীদের জমি থেকে বিচ্ছিন্ন করাকে নিষিদ্ধ করে যেসব আইন আছে সেগুলি কঠোরভাবে বলবৎ করা হোক, এবং তাঁদের এযাবৎ হারানো জমি অবিলম্বে ফিরিয়ে দেওয়ার ব‍্যবস্থা নেওয়া হোক।

১৩) যেসব আদিবাসী মানুষ পরিযায়ী কাজে বাধ‍্য হচ্ছেন তাঁদের জীবন ও জীবিকা সুরক্ষিত কর, তাঁদের অধিকার রক্ষায় দৃঢ়ভাবে শ্রম আইন কার্যকর কর।

১৪) বিচারাধীন সমস্ত আদিবাসী মানুষকে নিঃশর্তে মুক্তি দাও এবং আদিবাসীদের বিরুদ্ধে চলা ফৌজদারি মামলাগুলি নির্দিষ্ট সময়ের মধ‍্যে পুনর্বিবেচনা করতে প্রতিটি রাজ‍্যে বিচার বিভাগীয় কমিশন বসাও যাতে মিথ‍্যা মামলাগুলি খারিজ হয়, নির্দোষ ব‍্যক্তিরা মুক্তি ও ক্ষতিপূরণ পায়, এবং এই ধরণের অন‍্যায় শাস্তির পেছনে যুক্ত পুলিশ কর্মকর্তারা চিহ্নিত ও সাজাপ্রাপ্ত হয়।

১৫) আদিবাসীদের বনের জমি থেকে বেদখল ও উচ্ছেদ করার যে কোনো প্রক্রিয়ার ওপর স্থগিতাদেশ জারি করতে হবে যদি না তা গ্রামসভার অনুমোদিত হয় এবং অনুমোদিত ক্ষেত্রে স্থানান্তরণের আগেই পূনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণের বন্দোবস্ত করতে হবে। এবং স্বাধীনতার পর থেকে উন্নয়ন/সংরক্ষণমূলক প্রকল্পসমূহে যত আদিবাসী উচ্ছেদ হয়েছেন তাঁদের সকলকে প্রতিদান, ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন দিতে হবে।

১৬) ডি-নোটিফায়েড, যাযাবর ও আধা যাযাবর আদিবাসী সম্প্রদায়গুলির জন‍্য সুবিচার নিশ্চিত কর।

১৭) বিশেষ বিপন্ন আদিবাসী গোষ্ঠি ‘পিভিটিজি’রা যে অস্তিত্বের সংকটের সম্মুখীন তার মোকাবিলায় উচ্চ মৃত‍্যুহার, ধারাবাহিক দারিদ্র, অপুষ্টি, অনাহার ও যথাযথ চিকিৎসা পরিষেবার সুযোগ থেকে বিচ্ছিন্নতা এবং সেই সাথে জীবিকা সুরক্ষার অভাব — এই সমস‍্যাগুলি নিরসনে পদক্ষেপ নাও।

১৮) আদিবাসীদের হেফাজতে নিয়ে হত‍্যা, ধর্ষণ ও ফেক এনকাউন্টারের জন‍্য পুলিশ ও সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নাও বিশেষত শিশু ও মহিলাদের ওপর চলা নানান অত‍্যাচারগুলিতে।

১৯) কর্পোরেট লুট ও ধ্বংসকে অনুমোদন আর আদিবাসীদের ওপর চালানো রাষ্ট্রীয় হিংসা এবার থামাও। নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সংগ্রামরত আদিবাসীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনকে হাতিয়ার বানানো বন্ধ কর, এবং আদিবাসী আন্দোলনের কারণে যারা জেলে পচছেন তাঁদের মুক্ত কর আর ফৌজদারি মামলাগুলি তুলে নাও।

২০) আদিবাসী এলাকাগুলিকে সম্পূর্ণ ও সার্বিক বে-সামরিকীকরণ কর ও পুলিশ রাজ থেকে মুক্ত কর।

২১) যেখানে যেখানে আর্মড ফোর্সেস (স্পেশাল পাওয়ার্স) অ‍্যাক্ট লাগু আছে সর্বত্র তা প্রত‍্যাহার করে নাও। এই রাজ‍্যগুলিতে সশস্ত্র বাহিনীর দ্বারা বিচারবহির্ভূত যে সমস্ত হত‍্যা এবং ধর্ষণ ও হয়রানির ঘটনা নথিভূক্ত হয় সেগুলির প্রত্যেকটি অত‍্যন্ত কঠোর হাতে বিচার করে অপরাধিদের শাস্তি সুনিশ্চিত কর।

২২) সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত অনুসারে পঞ্চম তপশীলভূক্ত এলাকার সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদের মালিকানা সেখানকার আদিবাসীদের হাতে ন‍্যস্ত হওয়ার কথা। জঙ্গলের সমস্ত ধরনের উৎপন্নের ও কাঠের ন‍্যূনতম মূল‍্য নির্ধারণ ও তা বিক্রয়ের ক্ষমতা গ্রামসভার হাতে থাকবে।

২৩) পঞ্চম তপশীল অনুসারে আদিবাসী উপদেষ্টা পরিষদ গঠন বাধ‍্যতামূলক। তার বাৎসরিক রিপোর্ট রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো আবশ‍্যিক। তা করতে ব‍্যর্থ হলে রাজ‍্যপালের বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা। টিএসপি এলাকার জন‍্য বরাদ্দ ফাণ্ডে কোনরকম ঘাটতি চলতে পারে না।

২৪) জনগণনার নথিতে আদিবাসীদের জন‍্য একটি স্বতন্ত্র ‘আদিবাসী/ট্রাইবাল কোড’এর কলাম থাকতে হবে।

২৫) বেসরকারি ক্ষেত্র ও বিচার বিভাগেও সংরক্ষণ লাগু করতে হবে।

খণ্ড-30
সংখ্যা-26