বিবৃতি
মিজোরামে রেল সেতু ভেঙ্গে মালদার ২৩ জন পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যু রেল প্রশাসনের চূড়ান্ত অবহেলা ও ব্যর্থতা
collapses-in-mizoram

মালদা জেলার পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যুর মিছিলে সম্প্রতিক সংযোজন হলো গত ২৩ আগস্ট ২০২৩ মিজোরামের নির্মীয়মাণ রেল সেতু ভেঙ্গে ২৩ জন শ্রমিকের মৃত্যু। বিগত ১৫-২০ বৎসর যাবৎ প্রতি মাসেই অসংখ্য পরিযায়ী শ্রমিকের কফিন বন্দী দেহ মালদায় আসে ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্য থেকে। এই জেলায় লক্ষ লক্ষ কর্মহীন মানুষ। জেলায় বা রাজ‍্যে কাজের ব্যবস্থা না থাকায় বিভিন্ন রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে কাজে যেতে বাধ্য হয়। একদিকে এই জেলায় ৪-৫ দশক ব্যাপী গঙ্গা ও ফুলহর নদীর বিধ্বংসী ভাঙ্গনে কয়েক লক্ষ মানুষ সর্বহারা উদ্বাস্তু, অন‍্যদিকে, জেলার ঐতিহ্যশালী রেশম শিল্প, তাঁত শিল্প ধ্বংস প্রাপ্ত। জেলার উৎপাদিত ফসলের যথাযথ দামও পায়না চাষি, যথা — আম, লিচু, ধান ও পাট এবং কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের উদাসীনতায় কৃষিভিত্তিক কোনো শিল্প না হওয়া, এমজিএনআরইজিএ তথা ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে অত‍্যন্ত স্বল্পমজুরি ও আকাশচুম্বী দুর্নীতির ফলে কর্মহীনতা ও বেকারত্ব সীমাহীন। যার ফলে শ্রমিকরা পেটের টানে ভিনরাজ্যে কাজে যেতে বাধ্য হন।

মিজোরামের রেল সেতু ভেঙ্গে পড়ার ঘটনাটিতে মালদার রতুয়া-২ ব্লকের পুখুরিয়া চৌদুয়া গ্রামেরই ১১ জন শ্রমিক মারা যান। এই ঘটনায় ২৬ আগস্ট সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের জেলা কমিটি সম্পাদক কমরেড এব্রাহিম সেখ, জেলা সদস্য কয়েশ আলি ও মৃত্যুঞ্জয় দাস ওই গ্রামের শোকাহত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাৎ করা পরিবারগুলির মৃতদের সংক্ষিপ্ত পরিচয়,

১) সরিফুল সেখ, বয়স ২০, অবিবাহিত, পরিবারে রয়েছে পিতাসহ‌ ৪-৫ জন সদস্য। মাতা আমনুর বিবি পরিবারের জন্য সরকারি চাকরি দাবি করেছেন।
২) মোজাফ্ফার আলী, বয়স ৩৬, পরিবারে স্ত্রী ও তিন নাবালিকা মেয়ে, বৃদ্ধ মা বাবা রয়েছেন।
৩) অসীম আলী, বয়স ১৮, অবিবাহিত, পরিবারে অসুস্থ পিতা সহ কয়েকজন সদস্য।
৪) শহিদুর রহমান, বয়স ৩৫, পরিবারে দু’টি নাবালিকা মেয়ে, স্ত্রী ও পিতা মাতা রয়েছে।
৫) কাসিম আলী, বয়স ২০, অবিবাহিত, বৃদ্ধা পিতা মাতা রয়েছে।
৬) সামিরুল, বয়স ১৯, অবিবাহিত, পরিবারের চার সদস্য, মা ১০ বছর শয্যাশায়ী।
৭) মনিরুল নাদাব, বয়স ২০, অবিবাহিত, পাশের পাড়া কোক্লামারীতে ঘর, মা এবং বোন রয়েছে।
৮) মোজাম্মেল, বয়স ২৮, পরিবারে পিতা মাতা স্ত্রী ও দু’টি নাবালক সন্তান রয়েছে।
৯) সাইন আখতার, বয়স ৩০, উচ্চ মাধ্যমিক পাস, ৩ মাস আগে বিবাহ করেছিলেন, ওঁর স্ত্রী এখন বিধবা।
১০) সানাউল, বয়স ৫০, পরিবারে পিতা মাতা, স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে রয়েছে।
১১) জসিম রহমান, বয়স ১৮, বয়স, স্ত্রী সাবিনূর খাতুন, ছ’মাস আগে বিবাহিত, পরিবারে পিতা মাতা রয়েছে।

১১ জন শ্রমিকই চৌদুয়া গ্রামের। মালদা শহর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে প্রত্যন্ত এ’গ্রামের অধিকাংশ বাড়ি টালি ও ভাঙা ইঁটের। কেউ কেউ ঋণ করে বাড়িঘর নির্মাণ করেছিল। এলাকার অধিকাংশ লোক গরিব পরিযায়ী শ্রমিক। মিজোরামে এঁরা গত দেড়-দু’মাস পূর্বে কাজে যান, তারপর এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। পার্শ্ববর্তী এলাকার অসংখ্য মানুষ সকাল হতেই শোকাহত চৌদুয়া গ্রামে হাজির হন। ২৩ জন শ্রমিকের মধ্যে একজন রয়েছেন কালিয়াচক তিন নম্বর ব্লকের পঞ্চানন্দপুর এলাকার শ্রমিক এবং রয়েছে্ন ইংলিবাজারের সাট্টারির শ্রমিক। বাকিদের নামের তালিকা,

১) নুরুল হক, পুখুরিয়া, চৌদুয়া, রতুয়া।
২) মাসরেকুল, পুখুরিয়া, চৌদুয়া, রতুয়া।
৩) আনসারুল হক, পুখুরিয়া, চৌদুয়া, রতুয়া।
৪) রহিম সেখ, পুখুরিয়া, চৌদুয়া, রতুয়া।
৫) সাকিরুল সেখ, পুখুরিয়া, চৌদুয়া, রতুয়া।
৬) মহম্মদ জহিরুল শেখ, কালিয়াচক, পঞ্চনন্দপুর।
৭) সেবুল হক, গাজোল।
৮) ঝাল্লু সরকার, সাট্টারি, ইংলিশবাজার।
৯) জয়ন্ত সরকার, সাট্টারি, ইংলিশবাজার।
১০) রঞ্জিত সরকার, সাট্টারি, ইংলিশবাজার।
১১) সুমন সরকার, সাট্টারি, ইংলিশবাজার।
১২) নব চৌধুরী, সাট্টারি, ইংলিশবাজার।

গত ২৫ আগস্ট পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল ডক্টর সি ভি আনন্দ বোস মৃত পরিবারের হাতে রেল প্রশাসনের ১০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিলেও এলাকা ও পরিবারের পক্ষ থেকে সরকারি চাকরি দাবি করা হয়েছে। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে ২ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ ঘোষণা সত্ত্বেও এখনো ক্ষতিপূরণ মেলে নাই। রাজ‍্যে পরিযায়ী শ্রমিকদের জন‍্য আইন থাকা সত্ত্বেও পরিযায়ী শ্রমিকদের অধিকার সেই অনুকূলে নাই। লকডাউনের সময় এই জেলার কুড়ি থেকে বাইশ জন শ্রমিক মারা যায়। আজও কেউ ক্ষতিপূরণ পায়নি। জেলার পরিযায়ী শ্রমিক পরিবারের কান্নার রোল বন্ধেরও কোনো সম্ভাবনার কথা সরকারি সূত্রে বলা হচ্ছে না। মালদা জেলায় যখন কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তখন শ্রমদপ্তর তৎপর হয় শ্রমিকদের রেজিস্ট্রেশনের জন্য। শ্রমদপ্তর বেশিরভাগ দালালদের দ্বারা পরিচালিত হয়। শ্রমদপ্তর হতে প্রত্যেকটা পঞ্চায়েতে যে লোক নিয়োগ করা হয়েছে তারাও শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী কাজের সঙ্গে যুক্ত, এই সমস্ত কারণে শ্রমিকরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত। আবার কিছু শ্রমিকের যে রেজিস্ট্রেশন হয়েছে তাদের অনেকেরই রেজিস্ট্রেশন শ্রমদপ্তরের গাফেলতির কারণে বাতিল হয়ে যায়। মালদা জেলায় সাড়ে চার লক্ষ বিড়ি শ্রমিক রয়েছে। এঁরা সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরি তো দূরের কথা দিপাক্ষিক চুক্তি মোতাবেক মজুরি পান না। কোথাও ১৩০, অথবা ১৪০, কোথাও ১৫০ টাকা হারে মজুরি পেয়ে থাকেন। মজুরি আদায়ে শ্রমদপ্তরের কোনো ভূমিকা নেই।

- সিপিআই(এমএল), মালদা জেলা কমিটি

খণ্ড-30
সংখ্যা-30