হার না মানা লড়াই!
Do-not-give-up-fight_0

বিগত ৯ আগস্ট মধ্যরাত্রে ছাত্র মৃত্যুর ঘটনা যাদবপুরের শিক্ষার্থী-শিক্ষক-কর্মচারী সবাইকেই স্তব্ধ করে দিয়েছে প্রায়। রেগিংয়ের ভয়াবহতা অন্যান্য ক্যাম্পাসের মতোই যাদবপুরেও যে প্রচণ্ডভাবে বিদ্যমান, যা এক শিক্ষার্থীর জীবনকে যে সম্পূর্ণভাবে শেষ করে দিতে পারে এটা অনেকেই হয়তো ভেবে উঠতে পারছিলেন না। তথাকথিত গণতান্ত্রিক পরিসর, আলোচনার মাধ্যমে সব সিদ্ধান্ত নেওয়ার যে অনুশীলন যাদবপুরের ছাত্র রাজনীতিতে ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠা করা গিয়েছিল, তা যে পড়ুয়াদেরকে নিজের অভিজ্ঞতা, কোনও অবিচার হলে তার কথা সবার সামনে বলার ক্ষমতা জুগিয়েছে তা নিয়ে হয়তো আমরাও কিছুটা আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। হয়তো সম্পূর্ণ হয়ে ওঠেনি সেই লক্ষ্য, অনুশীলনে কিছুটা খামতি রয়ে গিয়েছিল। তার মূল্য দিতে হল একটা জীবন দিয়ে।

তবে তার পরবর্তী সময়ে যে ধরনের মিডিয়া ট্রায়াল চলেছে এবং ৯ আগস্ট পরবর্তী পরিস্থিতিতে জনচেতনার মধ্যে যাদবপুর সম্বন্ধে যে বিরূপ ধারণা তৈরি হয়েছে তা আসলেই ক্ষতিকারক। কারণ আক্রমণ ‘রেগিং’-এর উপর নয় বরং ক্যাম্পাস গণতন্ত্র, ঐক্যবদ্ধতা এবং সার্বিকভাবে সরকারি শিক্ষাক্ষেত্রের উপরে পড়ছে যা বহু সাধারণ পরিবারের শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ প্রশ্নের মুখে ফেলতে পারে!

রেগিংয়ের সমস্যা 

বিভিন্নি সুত্রে দেখা যাচ্ছে ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে প্রায় ৫১১টি রেগিংয়ের ঘটনার রিপোর্ট জমা পড়েছে ইউজিসি-র কাছে। সংখ্যাটা প্রথমে খুব কম লাগলেও মনে রাখতে হবে যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পড়ুয়াদের জানাই থাকে না যে কিভাবে অভিযোগ নথিভুক্ত  করতে হয় বা কর্তৃপক্ষের তরফে তা চেপে দেওয়া হয়। অন্যদিকে আমরা এও দেখি যে কিভাবে রেগিংয়ের ঘটনাকে বা তার কারণে মৃত্যু হলে সেটাকে খুব সুপরিকল্পিতভাবে আত্মহত্যা বলে চালানো হয়। যাদবপুরের ছাত্র হত্যার ঘটনা সামনে আসার সাথে সাথেই আমরা দেখতে পেলাম কিভাবে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়-বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়-আইআইটি খড়গপুরের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের রেগিংয়ের ঘটনা সামনে আসছে। আইআইটি খড়গপুরের ফায়জান আহমেদ-র মৃত্যুকেও কর্তৃপক্ষ সুপরিকল্পিতভাবে আত্মহত্যা হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করে।

তাই স্বপ্নদীপের মৃত্যুর ঘটনাকে ‘যাদবপুরের’ ঘটনা হিসেবে বারবার বিভিন্নভাবে বলে আসলেই তো ‘রেগিং’-য়ের ভয়াবহতা সার্বিকভাবে যে ক্যাম্পাসগুলোতে বিদ্যমান তা আড়াল করার একটা চেষ্টা চলছে। তাই আজকে শুধু স্বপ্নদীপের মৃত্যুর বিচার আমরা যদি বলি এবং ফায়জানের মতো শিক্ষার্থীদের মৃত্যুর বিচারের কথা না বলি তাহলে কোথাও বিচার আংশিক রয়ে যায়। রেগিং বিরোধী জনমত তৈরি করতে গেলে এই পরিপ্রেক্ষিতে সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে ঘটে চলা ঘটনার বিরুদ্ধে এক বলিষ্ঠ অবস্থান নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।

কেন হোস্টেল?

তবে প্রশ্নে যখন যাদবপুর রয়েছে তো বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলগুলি নিয়েও কিছু কথা বলা প্রয়োজন রয়েছে – বিশ্ববিদ্যালয়ের যাদবপুর ক্যাম্পাসের ভেতরে এবং যাদবপুর থানা সংলগ্ন মেইন হোস্টেল মিলিয়ে ১৩টি ব্লক রয়েছে যেখানে প্রায় ২০০০-এরও বেশি ছাত্রছাত্রীরা বোর্ডার এবং গেস্ট হিসেবে থাকেন। সল্টলেক ক্যাম্পাসেও রয়েছে আরও কয়েকশো ছাত্রছাত্রীর থাকার ব্যবস্থা। কারা থাকেন এই হোস্টেলগুলিতে? মূলত দারিদ্র সীমার আশেপাশে থাকা তথা কৃষিজীবী-শ্রমজীবী পরিবার থেকে আসা শিক্ষার্থীরা যারা জীবনের সাথে এক অসম সংঘর্ষ করে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে আসেন। ন্যূনতম টাকার বিনিময়ে হোস্টেলগুলিতে থাকা যায় এবং তার থেকেও কম খরচে পড়াশোনা করা যায়। তবে এই টাকাও প্রতিবছর অনেকে জোগাড় করে উঠতে পারেন না; তাদের জন্যে রয়েছে স্কলারশিপ-আন্দোলনের ফসল। প্রায় কয়েক দশকের উপর সময় ধরে বারবার হোস্টেল ফি/কোর্স ফি বাড়িয়ে দিতে চেষ্টা করেছে কর্তৃপক্ষ কিন্তু পারেনি; কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রামী ছাত্র আন্দোলন এবং তার ফলে আজকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে রয়েছেন কৃতী ছাত্রছাত্রীরা যারা বিভিন্নভাবে সমাজকে দিয়ে চলেছেন অনেককিছু। সাম্প্রতিক চন্দ্রযান অভিযানে যুক্ত বিজ্ঞানীরাও এই ব্যবস্থারই ফলাফল।

মিডিয়া ট্রায়ালে বারবার প্রশ্ন উঠেছে যে প্রাক্তনীরা যাদবপুরে কিভাবে গেস্ট হিসেবে থাকেন? প্রচণ্ড চাপের মুখে কর্তৃপক্ষ নোটিশ জারি করে সমস্ত গেস্টদের বের করে দিল হোস্টেল থেকে। সত্যটা কী? পাশ করার পর তারা কয়েকমাস থাকেন কারণ একটা বড় অংশের শিক্ষার্থীরাই এই হস্টেলগুলিতে থেকে চাকরীর পরীক্ষা বা অন্যান্য পরীক্ষার প্রস্তুতি চালান এবং হোস্টেল থেকে বেরিয়ে গেলে তাদের ওইটুকু সামর্থ্য নেই যে শহরাঞ্চলে টিকে থাকবেন।

হোস্টেলে কি সবাই রেগিং করেন? স্পষ্ট উত্তরটা না। তাই মুষ্টিমেয়র দোষের ভাগীদার সবাইকে করে দেওয়ার মাধ্যমে আমরা আসলেই অনেকের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে কেড়ে নিচ্ছি কিনা সেটাও ভেবে দ্যাখার দরকার রয়েছে।

কর্তৃপক্ষকে দায় নিতে হবে!

অন্যদিকে বারবার প্রশ্ন উঠেছে যে এতদিন ধরে রেগিং বিরোধী প্রচারাভিযান কেন চলেনি ক্যাম্পাসে? অভিযোগটা মিথ্যে। রেগিং সংস্কৃতির বিরুদ্ধে বারবার লড়াইয়ে নেমেছে আইসা। ২০০২ সালের থেকে সংগঠনের কর্মীরা বারবার প্রতিবাদ জানিয়েছে; এর ফলে অনেককে বের করে দেওয়া হয়েছে হোস্টেল থেকে যারা লড়াই করেছেন। কিন্তু সব ক্ষেত্রেই কর্তৃপক্ষ চুপ থেকেছে বা তদন্ত এগোয়নি। ২০১৩ সালে রেগিংয়ের প্রতিবাদ করায় চাপের মুখে পড়তে হয় আইসার কর্মীদের। ২০১৫ সালে আইসা-র দুই কর্মীকে রেগিংয়ের বিরোধীতা করার কারণে তাদের সাধারণ সভা ডেকে মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তি বের করে দেয় হোস্টেল থেকে; কর্তৃপক্ষ তখনও চুপ থেকেছে।

অ্যান্টি রেগিং সেল-এর যে কমিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে তাতে কারা রয়েছেন এটা কেউ কয়েকদিন আগে অব্দিও জানতো না কারণ তার কোনও কাজ মূলত ক্যাম্পাসে ছিল না। আইসিসি-র কমিটির মতোই সেটিও বিকল বছরের পর বছর। অ্যান্টি রেগিং সেলের অন্যতম কাজ হল রেগিং-বিরোধী সচেতনতা বৃদ্ধি করা। তার জন্যে প্রয়োজন নিয়মিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে সেই প্রচার নিয়ে যাওয়া, হোস্টেলগুলিতে আলোচনার পরিসর গড়ে তোলা। বিগত সময়ে কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে সেই প্রচেষ্টা ছিল ‘শূন্য’। তাই এই ঘটনা হঠাৎ ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা নয় বরং পরিকাঠামোহীনতা এবং কর্তৃপক্ষের গাফিলতিকেই তা সামনে আনে। স্বপ্নের মৃত্যুর দায় তাদেরকে নিতেই হবে!

মিডিয়া ট্রায়াল ও সিসিটিভি বিতর্ক

স্বপ্ন-র মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে যে মিডিয়া ট্রায়াল চলেছে তা অচিরেই ‘রেগিং’ থেকে ‘যাদবপুর’-এ সরে গিয়েছে। অর্থাৎ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে ‘যাদবপুরের বামপন্থী’,’সিসিটিভি’, ‘সিকিউরিটি’, ‘যাদবপুরের সংস্কৃতি’ এরকম আরও কিছু শব্দ। মিডিয়া অ্যাঙ্কররা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদেরকে ডেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চালিয়েছেন জেরা। বড় বিশারদ এবং তার থেকেও বড় তাদের জ্ঞানের ভার। সব কিছুর সোজা উত্তর – ‘সিসিটিভি’। যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেওয়া যায় যে ‘সিসিটিভি’ ও ‘বায়োমেট্রিক’ রেগিং সমস্যা সমাধানের একমাত্র রাস্তা তাহলে প্রতিনিয়ত আইআইটি, মেডিক্যাল কলেজ বা অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রেগিংয়ের ঘটনাগুলি বেড়ে চলে কিভাবে? এর মধ্যে বেশিরভাগ ক্যাম্পাসেই সিসিটিভি, বায়োমেট্রিক ব্যবস্থা রয়েছে!

কথায় আসছে ইউজিসি-র গাইডলাইন - একবার চোখ বোলালেই দ্যাখা যাবে ২০২২ সালের পরিবর্তিত গাইডলাইনে ইউজিসি মূলত রাস্তা, লাইব্রেরী, গেট এবং এমন অংশ যেখানে জনগণের অনুপ্রবেশের বিষয় রয়েছে সেখানে সিসিটিভি বসাতে বলেছে এবং বায়োমেট্রিকের মূল উদ্দেশ্য ছাত্রছাত্রীদের উপর বর্ধিত নজরদারি, তারা কতদিন ক্লাসে আসেন এই সমস্ত বিষয়। কিন্তু এই ইউজিসি-র গাইডলাইনে রেগিং বিরোধী সচেতনতা নিয়ে রয়েছে ন্যূনতম কিছু বিধান যা খাতায় কলমেও দেখানো সম্ভব। যাদবপুরের মতো ক্যাম্পাসে যেখানে হোস্টেল ছাড়াও রয়েছে আবাসন, কর্মচারীদের থাকার জায়গা, শিক্ষকদের কোয়ার্টার, সেখানে হঠাৎ করে আইকার্ড দেখতে চাওয়াটাও সৃষ্টি করতে পারে নতুন সমস্যা এবং পর্যাপ্ত পরিকাঠামো ছাড়া তা কখনই সম্ভব নয়।

স্বাভাবিকভাবেই তাই ‘সিসিটিভি’ বা অন্যান্য বক্তব্য আসলে রেগিংকে রোখার সক্রিয় প্রচেষ্টার বিষয়ের সাথে যুক্ত নয় অর্থাৎ ‘সিসিটিভি’, ‘বায়োমেট্রিক’ বা ‘আইডি কার্ড’ কোনোভাবেই রেগিংয়ের সমস্যাকে সমাধানের লক্ষ্যে নয়। সংবাদমাধ্যমগুলির কাছে শাসকশ্রেণীর নির্দেশও হয়তো অন্যরকম বলে অনুমান করা যায়। বরং বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সিসিটিভি’, ‘বায়োমেট্রিক’ বা ‘আইডি কার্ড’ এসবের ব্যবস্থার কথার সাথে যোগ রয়েছে অন্য এক বিষয়ের – সক্রিয় ছাত্র রাজনীতিকে আঘাতপ্রাপ্ত করার চেষ্টা; ক্যাম্পাসের গণতান্ত্রিক পরিসরকে শেষ করে দিয়ে সোজাসুজি শাসকদল পরিচালিত কর্তৃপক্ষের শাসনের অধীন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা। জেএনইউ, জামিয়া সহ এই রাজ্যের বিশ্বভারতী বা প্রেসিডেন্সীর ছাত্র আন্দোলনের উপর সরাসরি আক্রমণ তা জানান দেয় যে আসল লক্ষ্যটা কি। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে সিসিটিভি বসবে কি বসবে না বা কিভাবে তা পরিচালিত হবে এই আলোচনার আগে প্রয়োজন রয়েছে। মিডিয়া ঠিক করে দেবে না যে ক্যাম্পাসে কী হবে আর কী হবে না। বরং তার জন্যে ক্যাম্পাসের সমস্ত অংশীদারদের অর্থাৎ শিক্ষার্থী-গবেষক-শিক্ষক ও কর্মচারীদের ঐকমত্যে আসার প্রয়োজন রয়েছে।

এই মিডিয়া ট্রায়ালের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হল যাদবপুরের মধ্যে দিয়ে আসলে সার্বিকভাবে সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিরোধী এক জনমত গড়ে তোলা। আর তাতে আখেরে সুবিধা কাদের? গত কয়েকদিন ধরে দৈনিক কাগজগুলি খুললে দেখতে পাবেন যে বেসরকারি কলেজের বিজ্ঞাপন – ‘রেগিংমুক্ত ক্যাম্পাস’! আর যা উহ্য তা হল – টাকা থাকলে পড়তে আসুন।

সুযোগের সদ্ব্যবহার 

যখন এই লেখাটা লেখা হচ্ছে তখন আচার্য তথা গভর্নর সমস্ত আইনকানুনকে অগ্রাহ্য করে দিয়ে মূলত বিজেপি-র শিক্ষক সংগঠনের একের পর এক কর্মীদের উপাচার্য পদে নিয়োগ করে নিয়েছেন। আবার নিজেকে উপাচার্য হিসেবেও দাবি করছেন।

বিগত কয়েক সপ্তাহের ঘটনাপ্রবাহকে যদি একটু বিশ্লেষণ করা যায় তো দেখা যাবে পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বিজেপি একদিকে যেমন তাদের বামপন্থা বিরোধী প্রচার আরও জোরদার করেছে সেরকমই রাজ্যপালের তরফ থেকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অস্থায়ী উপাচার্যের নিয়োগ হয়েছে। বিজেপি-র শিক্ষক সংগঠনের অন্যতম সদস্য হওয়ার কারণেই এই নিয়োগ। উপাচার্য দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই প্রথমে ছাত্রছাত্রীদের সাথে কথা বলতে বা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত অংশীদারদের নিয়ে আলোচনায় বসতে তিনি অস্বীকার করেন। অর্থাৎ বিষয়টা খুব স্পষ্ট যে মৃত্যুর ঘটনাকে ব্যবহার করে যাদবপুরের গণতান্ত্রিক পরিসর, স্বায়ত্ততা নস্যাৎ করে দেওয়ার এই সুযোগকে কাজে লাগাতে তৎপর হয়ে উঠেছে কেন্দ্রের শাসক দল এবং তাদের সামনে কার্যত নতিস্বীকার করে নিয়েছে তৃণমূল। রাজশাসনকে রুখে দেওয়ার স্পর্ধা যে তাদেরও চক্ষুশূল আর তাই মুখ্যমন্ত্রী যাদবপুরকে আখ্যায়িত করলেন ‘আতঙ্কপুর’ নামে। অথচ এই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যই দেশীয় শিক্ষাক্ষেত্রে রাজ্যের নাম উজ্জ্বল!

বর্তমান পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ

তদন্তের রিপোর্ট যাতে দ্রুততার সাথে প্রকাশ করা এবং নির্বাচিত প্রতিনিধি-সহ অ্যান্টি রেগিং সেল পুনর্গঠনের দাবিতে যে অবস্থান আইসা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু করে তার ৩৬৮ ঘণ্টা অবস্থান চলার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্বর্তী কমিটি একটি রিপোর্ট জমা করলেও কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের সুরক্ষা এবং রেগিং বিরোধী প্রচারভিযানের বিষয়ে কোনও মিটিং করতে রাজি ছিল না। নবনিযুক্ত উপাচার্য ভেবেছিলেন কারুর তোয়াক্কা না করেই সব সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলবেন এবং উল্টে হুমকির সুরে বারবার প্রাক্তন সেনা অফিসার নিয়োগের কথা বলে গিয়েছেন। তাই তিনি প্রায় ১৬ দিন ছাত্রছাত্রীদের সাথে দ্যাখা করতে অস্বীকার করেন এবং শেষ অব্দি ঘেরাও-বিক্ষোভের মুখোমুখি হয়ে বাধ্য হন ১ সেপ্টেম্বর স্টেকহোল্ডারস মিটিং ডাকতে।

সেই বৈঠকে তিনটে ছাত্র ইউনিয়ন, অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের কর্মীরা, শিক্ষক সংগঠনের প্রতিনিধিরা এবং গবেষক সংগঠনের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে আইসা-র পক্ষ থেকে স্পষ্ট জানানো হয় যে অবিলম্বে অ্যান্টি রেগিং স্কোয়াড গঠন এবং হোস্টেল সহ ক্যাম্পাসে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্যে প্রচার চালাতে হবে। ক্যাম্পাসের সুরক্ষার ক্ষেত্রে স্থায়ী এবং অস্থায়ী সুরক্ষাকর্মীদের বাড়তি ক্ষমতা দিতে হবে। এছাড়াও আইসা উক্ত বৈঠকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্যাকাল্টি কাউন্সিলের ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচন, জিএসক্যাশ ও ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি জানায়। সাংগঠনিকভাবে আমাদের কর্মীরা এদিনের বৈঠকে জোর দেন নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে শুরু করার জন্যে কারণ এই নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একদিকে রেগিং ও যৌন হেনস্থা বিরোধী সচেতনতার বিষয়কে যেমন শিক্ষার্থীদের আলোচনার পরিসরে নিয়ে আসা যায় সেরকম এক সচল কাঠামো গঠন করা সম্ভব যা যেকোনো বৈষম্যের ঘটনার বিরুদ্ধে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। ভাবার বিষয় এটাই যে উপরিউক্ত দাবিগুলির কোনোটার বিষয়েই কর্তৃপক্ষ কোনও নির্দিষ্ট উত্তর দিতে পারেনি বরং তারা বারবার এড়িয়ে যেতে চেয়েছে বিষয়গুলি।

ক্যাম্পাসের সমস্ত গণতান্ত্রিক কাঠামোগুলিকে সচল করার লক্ষ্যে উপরিউক্ত দাবি সহ অন্যান্য আরও কিছু দাবি নিয়ে আইসার এই পর্যায়ের প্রচারাভিযান চলছে। এর সাথে সাথেই বিজেপি-আরএসএস প্রশাসনিক কাঠামো ব্যবহারের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্ততার উপরে যে আক্রমণ নামিয়ে এনেছে তার বিরুদ্ধে আগামীতে লড়াইয়ের চলছে প্রস্তুতি। সারাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির নিরিখেই ক্যাম্পাসেও বিজেপি-আরএসএস বিরোধী জনমতকে শক্তিশালীভাবে প্রতিষ্ঠা করার চ্যালেঞ্জ নিয়েই কর্মীরা কাজ করে চলেছেন বৃহত্তর আন্দোলনের পরিসর তৈরির।

শেষ বিচারে এটাই বলার যে এই যাদবপুর স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে ফ্যাসিবাদী-দক্ষিণপন্থী শক্তির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম ঐতিহাসিকভাবে চালিয়ে এসেছে সেই ঐতিহ্যকে সামনে রেখেই ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা ব্যরিকেড করে দাঁড়িয়ে রয়েছেন, লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। ৭০-র দশকের রাজনৈতিক সংগ্রামে ছাত্রদের যোগদানের কথা শত চেষ্টা করেও ভুলিয়ে দিতে পারেনি শাসকশ্রেণি, এখনো যাদবপুর আশু-তিমিরের। তাই এবারও ফ্যাসিবাদীদের, দক্ষিণপন্থিদের বিরুদ্ধে চলবে হার না মানা লড়াই-বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্ততা, গণতন্ত্র রক্ষার লড়াই, চলবে সবার শিক্ষার অধিকারকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াই।

নো পাসারান!

ঋতম মাজি, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়

খণ্ড-30
সংখ্যা-31