সম্পাদকীয়
হিংসা বিদ্বেষে উন্মত্ত দেশ
obsessed-with-violence

এবার উত্তরপ্রদেশের মুজফ্ফরনগরের এক স্কুলের শিক্ষিকা রাতারাতি চলে এলেন সংবাদের শিরোনামে, সম্পূর্ণ ঘৃণিত এক ঘটনার কারণে। চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণকে কেন্দ্র করে আবেগ ও বিজ্ঞানের অগ্রগতি নিয়ে যখন দেশ তোলপাড়, তার ঠিক একদিন পরই যোগীর রাজ্যে ঘটল এই ঘৃণা বিদ্বেষের কলঙ্কিত অধ্যায়।

মজফ্ফরনগরের নেহা পাবলিক স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ত্রিপ্তা ত্যাগী এক সাত বছরের সংখ্যালঘু শিশুকে ‘মুসলমান’ হওয়ার ‘অপরাধে’ সহপাঠীদের ডেকে একে একে থাপ্পড় মারার নির্দেশ দেন। ভাইরাল হওয়া ভিডিও’তে দেখা যাচ্ছে, শিক্ষিকা আরও জোরে চড় মারার নির্দেশ দিচ্ছেন অন্য সহপাঠীদের। এই ঘটনায় দৃশ্যত আতঙ্কিত শিশুটি অঝোরে কাঁদছে। কিন্তু তাতেও বিরাম নেই।

এই ঘটনায় এত শোরগোল হলেও প্রধান শিক্ষিকার নেই বিন্দুমাত্র অনুশোচনা। তিনি তাঁর এই কান্ডের সপক্ষে যুক্তি হাজির করে এটাকে স্রেফ এক ‘তুচ্ছ ঘটনা’ বলে মনে করছেন তাই নয়, বরং মিথ্যার জাল বুনে জানালেন, হোমওয়ার্ক ঠিক মতো না করার জন্যই নাকি শিশুটির অভিভাবক তাকে শাস্তি দেওয়ার নিদান দেয়! এদিকে, শিশুটির পিতাই শিক্ষিকার নামে এফআইআর করার সময় জানান, এক-দু ঘণ্টা ধরে তাঁর ছেলের উপর অত্যাচার হয়েছে, শিশুটি তারপর থেকে ভয়ে কুঁকড়ে রয়েছে। শিক্ষিকার বিরুদ্ধে অত্যন্ত মামুলি অভিযোগ পুলিশ এনেছে, যা গ্রেপ্তারযোগ্য নয়। বুঝতে অসুবিধে হয় না, যোগী রাজ্যে গভীরে গেঁড়ে বসে থাকা সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন গোটা প্রশাসনই এই গুরুতর অপরাধকে কেন লঘু করে প্রায় ছাড় দিয়ে দিল ওই শিক্ষিকাকে। সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ, ওই শিশুটির পরিবারের উপর মামলা প্রত্যাহারের প্রবল চাপ, সঙ্গে হুমকি শুরু হয়েছে। ‘নিজেদের’ মধ্যে মিটমাঠ করে নেওয়ার জন্য এলাকাবাসীরা পীড়াপীড়ি করছেন।

এরই ঠিক দিন কয়েক আগে আরেকটি ঘটনা ঘটে খোদ লক্ষ্ণৌ’এ। শহরের মহিলা মেয়র সুশমা খাড়াকওয়াল শহরের এক বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউ’তে একজন রোগীকে দেখতে যান সদলবলে। পায়ের জুতো খুলে, ভিড় না করে, একে একে সেখানে ঢোকার অনুরোধ করেন হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীরা। তাতে ঘোর আপত্তি তোলেন মেয়র ও তার সঙ্গী সাথীরা। এই ঘটনা চলতে থাকার মধ্যেই বুলডোজার সেখানে চলে আসে (বলাই বাহুল্য, মেয়রের নির্দেশে), হুমকির মূর্ত প্রতীক হয়ে। তড়িঘড়ি পুলিশ বাহিনী এসে হস্তক্ষেপ করে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।

যোগীরাজের ‘হিন্দুরাষ্ট্রে’ এমন অনেক ঘটনা হামেশাই ঘটছে, যা আজ যোগীর কল্যাণে হয়ে উঠছে রীতিমতো আইনসম্মত। বুলডোজার হয়ে উঠেছে শাসনতন্ত্রের এক স্বাভাবিক অঙ্গ। ত্রাস সৃষ্টি করে সবাইকে সন্ত্রস্থ করার আরেকটা হাতিয়ার। শুধু সে রাজ্যেই আর তা সীমাবদ্ধ নেই। যোগীর এনকাউন্টার মডেল এ’রাজ্যেও আমদানি করার পক্ষে জোরাল সওয়াল করলেন এ’রাজ্যে প্রধান বিরোধী দলের নেতা। বিজেপির যুব মোর্চা প্রকাশ্য রাজপথে যাদবপুরে ছাত্র সমাজের উদ্দেশ্যে ‘গোলি মারো’ শ্লোগান তোলে, রাষ্ট্রীয় মদতে বিজেপি শাসনাধীনে মণিপুর কি হিংস্রভাবে, মধ্যযুগীয় বর্বরতায় ভর করে জো-কুকিদের নিকেষ করার নরমেধ যজ্ঞে নামল, সেই ধ্বংসযজ্ঞে কিভাবে গণধর্ষণকে হাতিয়ার করা হল (যা ২০০২ সালে হয়েছিল মোদীর শাসনাধীন গুজরাটে) তা দেখেছে গোটা ভারতবর্ষ। কয়েকজন রাষ্ট্রীয় নেতা, বা কয়েকটি ঘৃণা-বর্ষী সংগঠনের সংগঠকদের উত্তপ্ত উস্কানিমূলক ভাষণ’ই শুধু নয়, আজ আমাদের সমাজের গভীরে কি মারাত্মক দ্রুতগতিতে অপরায়ন — ঘৃণা-হিংসা-বিদ্বেষ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে, আমাদেরই সহ নাগরিকেরা কিভাবে তার সওয়ার হয়ে সামিল হয়ে পড়ছেন এই নিমর্মতার মহোৎসবে, ১৯৪৭-এ ভৌগলিকভাবে ভাগাভাগি হওয়ার পরও আজ মোদীর শাসনকালে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি প্রতিদিন প্রতিনিয়ত ভাগ হয়ে চলেছে ঘৃণা-আশ্রিত হিন্দুত্ববাদী নব্য দেশপ্রেমের বিষাক্ত ছোবলে। এর বিরুদ্ধেই আজ দরকার নতুন এক চেতনার জাগরণ, আরেক স্বাধীনতা সংগ্রাম। নতুন আরেক ভারত নির্মাণের প্রকল্প।

খণ্ড-30
সংখ্যা-30