প্রতিবেদন
আদানিদের দুর্নীতির পর্দা ছিন্ন, উন্মোচিত অন্তরালে থাকা লগ্নিকারীরা
open-hidden-investors-exposed

হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ-এর রিপোর্টৈর পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট সেবিকে যে তদন্তের নির্দেশ দেয় সেবি তার আংশিক রিপোর্ট সুপ্রিম কোর্টে জমা দিয়েছে গত ২৫ আগস্ট। সেবি তাদের রিপোর্টৈ জানিয়েছে – তারা ২৪টা বিষয়ে তদন্ত চালিয়ে ২২টা বিষয়ে তদন্ত শেষ করলেও দুটো বিষয়ে তদন্তে যথাযথ অগ্ৰগতি এখনও ঘটাতে পারেনি। তারা ১৩টা লগ্নিকারীর সন্ধান পেয়েছে যারা আদানিদের বিভিন্ন সংস্থায় লগ্নি করেছে। কিন্তু এরা আদানি সরকারের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কিনা তার কিনারা তারা করে উঠতে পারেনি। কিন্তু সেবি কানাগলিতে আটকে গেলেও আদানিদের অস্বচ্ছ বিনিয়োগ জালের রহস্যভেদে সক্ষম হয়েছে বিশ্বজুড়ে অনুসন্ধানকারী সাংবাদিকদের গোষ্ঠী অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট (ওসিসিআরপি)। ওসিসিআরপি-র রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে বিশ্বের দুই প্রথিতযশা সংবাদপত্র ফিনান্সিয়াল টাইমস ও দ্য গার্ডিয়ানে। প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে যে তদন্তকারী সাংবাদিকরা মরিশাসের মতো কর ছাড়ের স্বর্গরাজ্যে থাকা বিভিন্ন ফাইল, চুক্তিপত্র, কর্পোরেট রেকর্ড, আদানি গোষ্ঠীর অভ্যন্তরীণ ই-মেইল, ইত্যাদি পরখ করে আদানিদের সংস্থাগুলোতে বিনিয়োগ করা বিদেশী লগ্নিকারীদের প্রকৃত পরিচয় উদঘাটনে সক্ষম হয়েছেন। রিপোর্ট জানিয়েছে, “বিদেশে অস্বচ্ছ কাঠামোয় থাকা অর্থ কেমনভাবে গোপনে ভারতের শেয়ার বাজারে নথিবদ্ধ কোম্পানিগুলোর শেয়ারে ধাবিত হতে পারে, এই নথিগুলো তাতে আলোকপাত করে।” এই সমস্ত নথির ভিত্তিতে তদন্ত যে লগ্নিকারীদের ওপর থেকে পর্দাটাকে সরিয়ে তাদের প্রকৃত পরিচয়কে উদঘাটিত করল, তারা কারা?

ওসিসিআরপি-র রিপোর্ট যে দুই লগ্নিকারীর উন্মোচন ঘটালো তারা হল সংযুক্ত আরব আমিরশাহির নাসের আলি শাবান আহলি এবং তাইওয়ানের চ্যাং চুং-লিং। এই দুই ব্যক্তিই আদানি পরিবারের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন, তাদের সঙ্গে আদানি গোষ্ঠীর ছিল দীর্ঘদিনের ব্যবসায়িক সম্পর্ক। এদের পরিচালনা করতেন গৌতম আদানির দাদা বিনোদ আদানি এবং তাঁরা বিনোদ আদানির সংস্থার ডিরেক্টর হিসাবে কাজ করেছেন, আবার ঐ সমস্ত সংস্থার কিছু শেয়ারও কিনেছিলেন। এদের মাধ্যমে ২০১৩ থেকে ২০১৮-র মধ্যে কোটি-কোটি ডলার লগ্নি হয়েছে আদানি গোষ্ঠীর চারটে সংস্থায়।

প্রকাশিত রিপোর্ট জানিয়েছে, আহলি এবং চ্যাং এমার্জিং ইন্ডিয়া ফোকাস ফান্ডস (ইআইএফএফ) এবং ই এম রিসার্জেন্ট ফান্ড (ইএমআরএফ) নামে মরিশাসের দুটো লগ্নি তহবিলে প্রচুর অর্থ পাঠায়। এই অর্থ পাঠানো হয়েছিল পাঁচটা সংস্থার মাধ্যমে। এদের মধ্যে চারটে কোম্পানি হল ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডের লিঙ্গো ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড যার মালিক চ্যাং; সংযুক্ত আরব আমিরশাহির গাল্ফ আরিজ ট্রেডিং এফজেডই যার মালিক আহলি; মরিশাসের মিড ইস্ট ওসেন ট্রেড যার মালিক আহলি; এবং ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডের গাল্ফ এশিয়া ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড যার “নিয়ন্ত্রক ব্যক্তি” ছিলেন আহলি; আর পঞ্চম সংস্থাটি ছিল বারমুডার লগ্নি তহবিল গ্লোবাল অপরচুনিটিজ ফান্ড (জিওএফ)। ইআইএফএফ এবং ইএমআরএফ-এ জড়ো করা অর্থ বিনিয়োগ করা হলো আদানিদের সংস্থা আদানি এন্টারপ্রাইজেস, আদানি পাওয়ার, আদানি পোর্টস ও আদানি ট্রান্সমিশনে। এই বিনিয়োগের ফল কী হল? রিপোর্ট জানাচ্ছে, “নথি দেখাচ্ছে যে তাদের বিনিয়োগের সর্বোচ্চ মাত্রায় আহলি ও চ্যাং ইআইএফএফ ও ইএমআরএফ-এর মাধ্যমে আদানি গোষ্ঠীর চারটে কোম্পানির সাধারণের অধিগ্ৰহণের (অর্থাৎ, কোম্পানি ও তাদের পরিবারের বাইরে) ৮ শতাংশ ও ১৩.৫ শতাংশ শেয়ার অধিগ্ৰহণ করেছিল। তাদের হস্তগত শেয়ারকে যদি বিনোদ আদানির প্রতিনিধি নিয়ন্ত্রিত বলে চিহ্নিত করা হতো তবে আদানি গোষ্ঠীর প্রমোটারের অধীনে থাকা শেয়ার ৭৫ শতাংশের সীমা ছাড়িয়ে যেতে।” অর্থাৎ, সেবি আইনের ১৯এ ধারার লঙ্ঘন যে হয়েছিল, আদানি গোষ্ঠী তাদের কোম্পানিগুলোর ৭৫ শতাংশের বেশি শেয়ার যে নিজেদের অধীনে রেখেছিল তা সুস্পষ্ট।

তবে, আহলি ও চ্যাং-এর অর্থ আদানিদেরই পাচার করা অর্থ কিনা তা রিপোর্টে সুস্পষ্টভাবে বলা নেই। রিপোর্টে জানানো হয়েছে, “আদানি গোষ্ঠীতে চ্যাং ও আহলির অর্থ আদানি পরিবার থেকে এসেছে এমন কোনো তথ্যপ্রমাণ নেই। এই তহবিলের উৎস অজানাই থেকে গেছে।” কিন্তু অনেক এই অভিযোগ করে থাকেন যে – অবশ্যই কিছু নথির ভিত্তিতে – আদানিদের ১০০ কোটি ডলার অর্থ কর ফাঁকির স্বর্গরাজ্যে পাচার হয়ে ঘুরপথে ফিরে এসে লগ্নি হয়েছে আদানি গোষ্ঠীর কোম্পানিগুলোতেই। এবং এই বিনিয়োগই আদানি গোষ্ঠীর সংস্থাগুলোর শেয়ার মূল্যের বহুগুণ বৃদ্ধি ঘটিয়েছে। উল্লেখ্য যে, নরেন্দ্র মোদী ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর গোপনীয়তায় মোড়া মরিশাসের তহবিলগুলোর মাধ্যমে বিনিয়োগ বেড়ে চলে এবং ২০০১৭-র মার্চ মাসে চ্যাং ও আহলির বিদেশী কোম্পানির আদানিদের সংস্থাগুলোয় লগ্নি দাঁড়ায় ৪৩০ মিলিয়ন ডলার।

যে প্রশ্নটা খুব স্বাভাবিকভাবেই এখানে ওঠে তা হল – ওসিসিআরপি যদি আদানিদের কোম্পানিগুলোতে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের প্রকৃত পরিচয় উদঘাটিত করতে পারে, যদি তারা নথির ভিত্তিতে দেখাতে সক্ষম হয় যে ইআইএফএফ, ইএমআরএফ ও গ্লোবাল অপরচুনিটি ফান্ড ছিল পর্দার আড়াল দেওয়া সেই তহবিল যেগুলোর মাধ্যমে বিনোদ আদানি বিপুল পরিমাণ পুঁজি ঢেলেছেন আদানিদের সংস্থাগুলোয়, তবে সেবি এই বিষয়ে নির্দিষ্ট অগ্ৰগতি ঘটাতে পারছে না কেন? সেবি কি সত্য উদঘাটনে সত্যিই আন্তরিক? সম্প্রতি চর্চিত তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, ২০১৪-র জানুয়ারিতে রেভিনিউ ইনটেলিজেন্স-এর ডিরেক্টর নাজিব শাহ তৎকালীন সেবি প্রধান উপেন্দ্র কুমার সিনহাকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন, “এমন লক্ষণ রয়েছে যে, (আদানিদের) অর্থ লগ্নি এবং বিলগ্নিকরণে খাটতে ভারতের শেয়ার বাজারে পৌঁছে থাকতে পারে।” তাঁর এই চিঠি লেখার কারণ হিসাবে নাজিব শাহ সেবি প্রধানকে জানিয়েছিলেন, সেবি “শেয়ার বাজারে আদানি গোষ্ঠীর কোম্পানিগুলোর লেনদেন নিয়ে তদন্ত করছে বলে ধারণা হয়েছিল।” দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টেও উল্লেখ করা হয়েছে যে, “ওসিসিআরপি উদঘাটিত এবং দ্য গার্ডিয়ানের নজরে আসা একটা চিঠি অনুযায়ী ২০১৪র গোড়ায় শেয়ার বাজারে আদানি গোষ্ঠীর সন্দেহজনক কার্যকলাপের তথ্যপ্রমাণ সেবির হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল – কিন্তু কয়েক মাসের ব্যবধানে মোদী নির্বাচিত হওয়ার পর সরকারি নিয়ন্ত্রক আগ্ৰহচ্যুত হয়ে যায় বলেই মনে হয়।” সেবি এখন ঐ সময় আদানিদের কোম্পানিতে বিনিয়োগ নিয়ে তদন্তের কথা অস্বীকার করছে। আর গৌতম আদানি সে সময়ের সেবি প্রধান উপেন্দ্র সিনহাকে পুরস্কৃত করে এনডি টিভির ডিরেক্টর বানিয়ে দিয়েছেন!

মোদী দুর্নীতির বিরুদ্ধে আরও একবার গলা চড়িয়ে গত ৩ সেপ্টেম্বর বলেছেন – স্বাধীনতার শতবর্ষ পূর্তিতে দেশে দুর্নীতি, জাতপাত, সাম্প্রদায়িকতা থাকবে না। তাঁর দার্শনিক(!) অভিমতের প্রতিফলন ঘটিয়ে তিনি বলেন, “ভবিষ্যতের পৃথিবী কেমন হবে তা আমাদের কর্মকাণ্ড ও দর্শনের উপর অনেকটাই নির্ভর করছে।” প্রচার দিয়ে বাজিমাতের যে প্রবৃত্তি তাঁর অধিগত, এই বক্তব্যেও সেই প্রয়াস পরিলক্ষিত। দুর্নীতি রোধে তিনি কি সত্যিই আন্তরিক? তাই যদি হয় তবে আদানির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের তদন্তে তিনি সায় দিচ্ছেন না কেন? মানি লণ্ডারিং তথা বিদেশে টাকা পাচার ও ঘুরপথে সেই টাকা ফিরিয়ে এনে তাঁর কোম্পানিতে বিনিয়োগের অভিযোগ যথাযথ গুরুত্ব পাচ্ছে না কেন? ক্যাগ-এর সাম্প্রতিক রিপোর্টে আদানিদের দুর্নীতির আর একটা নিদর্শন সামনে এসেছে – তারা যোগ্য না হয়েও, রাস্তা নির্মাণের পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও জাতীয় সড়ক কতৃপক্ষ তেলেঙ্গানায় তাদের ২৫০ কিমি রাস্তা নির্মাণের বরাত দিয়েছে। মোদী কি এই অভিযোগের তদন্তে সক্রিয়তা দেখাবেন? সেবি তাদের তদন্তে ব্যর্থ হলে তিনি যৌথ সংসদীয় কমিটির তদন্তে সম্মতি দিচ্ছেন না কেন? তিনি যথার্থই বলেছেন যে তাঁদের “কর্মকাণ্ড ও দর্শন”-এর উপরই নির্ভর করবে ভবিষ্যৎ ভারতের বিশিষ্টতা। আদানিদের দুর্নীতি এইভাবে প্রশ্রয় পেলে, স্যাঙাতি পুঁজিতন্ত্র অবাধ গতিতে এগিয়ে চললে অর্থনীতির ওপর দুর্নীতিই আধিপত্য করবে, তাঁদের “দর্শন”-এর পরিণামে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও সংখ্যাগুরুবাদী স্বৈরতাই দেশে কর্তৃত্ব করবে!

- জয়দীপ মিত্র

খণ্ড-30
সংখ্যা-31