ভারতের সংবিধানে অন্তর্ঘাত চালানোর ষড়যন্ত্র রুখে দিন
constitution-of-india

ভারতের সংবিধানকে অচল বলে বাতিল করে দেওয়াটা হিন্দু প্রভুত্ববাদী শিবিরের দীর্ঘদিনের এজেন্ডা। বর্তমানে প্রকাশ‍্যেই এই চেঁচামেচি শুরু করেছে ওরা। নতুন সংবিধান প্রণয়নের সবচেয়ে ধৃষ্টতাপূর্ণ ওকালতি এসেছে ৭৬তম স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের দিনে একটি খবরের কাগজে অর্থনীতিবিদ বিবেক দেবরায়ের লেখা এক নিবন্ধ রূপে। এটাকে একজন ব‍্যক্তির বিচ্ছিন্ন একটা মতো হিসেবে গণ‍্য করা মূর্খতা হবে। কারণ ইনি আর কেউ নন, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদের চেয়ারম‍্যান। এবং এই নিবন্ধে যে বক্তব‍্য তুলে ধরা হয়েছে সেগুলি ইতিপূর্বেই সরকারের বিভিন্ন ঘোষণা ও পদক্ষেপে প্রতিফলিত হতে দেখা গেছে। বিবেক দেবরায়ের নিবন্ধকে বরং দেখা যেতে পারে মাত্র ক’দিন আগেই রাজ‍্যসভায় প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের বক্তব‍্যের ধারাবাহিকতা হিসেবে, যেখানে গগৈ সংবিধানের বুনিয়াদি কাঠামো সম্পর্কেই প্রশ্ন তোলেন।

বাজপেয়ী জমানার এনডিএ সরকারও এই এজেণ্ডা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। প্রধান বিচারপতি এমএন বেঙ্কটচালাইয়ার নেতৃত্বে এগারো সদস‍্য বিশিষ্ট ‘সংবিধানের কার্যকারিতা খতিয়ে দেখার জাতীয় কমিশন (এনসিআরডব্লুসি)’ গঠন হয়েছিল। তবে, এই কমিশনকে দায়িত্ব ও ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল সংবিধানের বুনিয়াদি কাঠামো ও মৌলিক বৈশিষ্ট‍্যগুলিতে কোনোরকম হস্তক্ষেপ না করে সম্ভাব‍্য কিছু পরিবর্তনের সুপারিশ করার। ২০০৪ সালে বাজপেয়ী সরকারের পরাজয়ের পর এই এজেণ্ডাকে আর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি ওরা, এবং সেই এনসিআরডব্লুসি রিপোর্টকে আর কেউ গুরুত্বও দেয়নি। মোদী জমানার সংশোধনীসমূহ ও বিলগুলি অবশ‍্য ইতিমধ‍্যেই সংবিধানের বুনিয়াদি বৈশিষ্ট‍্যকে এবং মূল সুরকে খর্ব করতে শুরু করেছে। নাগরিকত্বের ধর্মনিরপেক্ষ ভিত্তিমূলে অন্তর্ঘাত চালিয়েছে সিএএ; সামাজিক অবিচার ও বৈষম‍্যের বিরুদ্ধে যে এফার্মেটিভ অ‍্যাকশান সংরক্ষণের মূল ভিত্তি ছিল তাকে নড়িয়ে দিয়েছে ইডব্লুএস সংরক্ষণ; জম্মু ও কাশ্মীর এবং দিল্লীর সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেওয়া ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় গঠন কাঠামোর ওপর তীব্র আঘাত হেনেছে; এবং প্রাতিষ্ঠানিক স্বায়ত্তশাসন ও নাগরিকের অধিকারকে সম্ভাব‍্য সমস্ত উপায়ে পদে পদে খর্ব করা হচ্ছে।

দেবরায়ের নিবন্ধ এইসব প্রবণতাগুলিকে তাদের স্বাভাবিক যৌক্তিক সিদ্ধান্তে এনে ফেলেছে এবং ধাপে ধাপে সংশোধনী আনার বদলে এবারে গোটাগুটি সংবিধানটাই নতুন করে লেখার আওয়াজ তুলেছে। স্পষ্টতই বুনিয়াদি কাঠামোর শাসন, যা যেকোনো সংশোধনের সীমা নির্ধারণ করে দেয় এবং সরকারকে বাধ‍্য করে যুক্তরাষ্ট্রীয় ভারসাম‍্য ও ক্ষমতার ভাগাভাগি মেনে চলতে, এবং প্রস্তাবনায় নির্দিষ্ট করে দেওয়া সাধারণতন্ত্রের চরিত্র ও মৌলিক দিশা, এগুলি মোদী সরকারের ক্ষমতা ও সম্পদ কেন্দ্রীভূত করার সীমাহীন তাড়নাকে এখনও কিছুটা আটকে রেখেছে। এই বাধা অতিক্রম করতে দেবরায় হাজির হয়েছেন এক সম্পূর্ণ নতুন সংবিধান প্রণয়নের আমূল সমাধান নিয়ে।

মজার বিষয় হল, নতুন সংবিধানের ওকালতি করতে গিয়ে দেবরায় হিন্দুরাষ্ট্রের হিন্দুত্ববাদী লক্ষ‍্য পূরণ বা মনুস্মৃতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার বিষয় মোটেই আলোচনায় আনেননি। এই প্রসঙ্গ তাঁর নিবন্ধে লক্ষ‍্যণীয়ভাবে অনুপস্থিত। তিনি সংবিধানকে আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলতে বলছেন কারণ ওটা নাকি ঔপনিবেশিক ঐতিহ‍্য, তাই নতুন সংবিধান হবে ঔপনিবেশিকতা মুক্তির প্রকল্প। অমিত শাহও একই যুক্তি দেখিয়ে ফৌজদারি বিচারশাস্ত্রের আইনগুলিকে প্রতিস্থাপন করতে চেয়েছেন। ইণ্ডিয়ান পেনাল কোডকে প্রতিস্থাপিত করতে চাওয়া হয়েছে ভারতীয় ন‍্যায় সংহিতা দিয়ে। বেশ মহৎ ভঙ্গী নিয়ে এটা পেশ করা হয়েছে, ঔপনিবেশিক যুগের শাস্তির ধারণা থেকে সরে এসে নাগরিকদের ওপর নজর কেন্দ্রীভূত করা হবে সুবিচার নিশ্চিত করতে। কিন্তু নাম বদলের ভঙ্গীর পেছন দিয়ে আসা ‘নতুন’ বিধিগুলি ঔপনিবেশিক যুগের আইনগুলিকেই আরো কঠোর ও নিপীড়নমূলক করে তুলছে।

অন‍্য প্রেক্ষিতটা হল সরকারের ‘কার্যকারিতা ও গতি’। একনায়কতন্ত্র সর্বদাই গণতন্ত্রকে তুলে ধরে ‘সিদ্ধান্ত নেওয়া’ এবং তা ‘দ্রুত কার্যকর করার’ পথের বাধা হিসেবে। আমরা ইতিমধ‍্যেই দেখতে পাচ্ছি যে সংসদীয় প্রক্রিয়াকে সুব্যবস্থিতভাবে ছিন্ন করা হচ্ছে, যার উদগ্র বহিঃপ্রকাশ দেখা গেল কোভিড-১৯ মহামারীর সময়, যখন সরকার সংসদ ও জনতাকে সম্পূর্ণ স্তব্ধ করে রেখে নতুন নতুন আইন প্রণয়নের এক আগ্রাসী অভিযান চালালো কর্পোরেটদের ক্ষমতা আরো জোরালো করতে। দেবরায় এই ব‍্যবস্থাকেই এক আইনসিদ্ধ সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্রে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে চান।

স্পষ্টতই মোদী সরকারের সমস‍্যা কেবল সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকার, নির্দশাত্মক নীতি বা প্রস্তাবনার ঘোষণাগুলি নিয়েই নয়, সংবিধানে বিধৃত যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর বাধ‍্যবাধকতা, আলবৎ ঐক‍্যের দিকে জোর দিয়ে — সমস‍্যা সেটা নিয়েও। এবং কার্যনির্বাহী, আইন প্রণেতা সংস্থা ও বিচার বিভাগের ক্ষমতার আলাদা আলাদা ক্ষেত্র নিয়েও মোদী সরকারের সমস‍্যা। সংবিধান ঘোষণা করে, ইন্ডিয়া অর্থাৎ ভারত রাজ‍্যগুলির একটা ইউনিয়ন। মোদী সরকার রাজ‍্যগুলির ক্ষমতা ক্ষয় করতে এবং রাজ‍্যের আওতাধীন ক্ষেত্রে অনুপ্রবেশ করতে সদা তৎপর। অবিজেপি দল শাসিত রাজ‍্যগুলির সরকারের কাজে বাধা তৈরি করতে, অস্থিরতা তৈরি করতে এবং এমনকি সরকার ফেলে দিতে রাজ‍্যপাল ও কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলিকে লাগাতার ব‍্যবহার করছে মোদী সরকার। এবং এখন তো কার্যনির্বাহীও প্রকাশ‍্যে বেরিয়ে পড়েছে পদে পদে যেকোনো উপায়ে বিচার বিভাগকে ধমকানি দিতে আর ঘিরে ধরতে। এর আগে কখনই ভারতের প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে এরকম বিদ্বেষপূর্ণ অভিযান চলতে দেখা যায়নি, কার্যনির্বাহীর আগ্রাসী অভিযানকে সংযত করা বা তাদের সোজা রাস্তায় আনার সপক্ষে সুপ্রিম কোর্টের প্রতিটি রায়কে এরকম সুব‍্যবস্থিতভাবে খাটো করতে দেখা যায়নি আগে কখনো।

আরএসএস, যারা জন্মলগ্ন থেকেই ফ‍্যাসিস্ট মুসোলিনি আর হিটলারের মডেল থেকে অনুপ্রেরণা নেয়, এখন ক্রমবর্ধমান মাত্রায় ইজরায়েলের জায়নবাদী মডেল অনুকরণ করছে। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের বিরুদ্ধে মোদী সরকারের চলমান যুদ্ধ নেতানিয়াহুর আমলে সেখানকার বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে চলা অভিযানের সাথে মিলে যায়। ইজরায়েলে এই অপচেষ্টার বিরুদ্ধে ব‍্যাপক গণবিক্ষোভ ঘটে। সংবিধান হল আধুনিক ভারতের ভিত্তি। আজ যখন মোদী নিজেকে আধুনিক কালের হিন্দু সম্রাট হিসেবে উপস্থাপনা করতে চাইছেন — তাঁর ভক্তরা তাঁকে ‘হিন্দু হৃদয় সম্রাট’ বলে থাকে — যিনি নাকি বিগত হাজার বছরের ‘অধীনতা’ থেকে আগামী হাজার বছরের ‘গৌরব’এ উত্তরিত হওয়ার সূচক, তখন একথা স্পষ্ট যে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে এক সুদীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের পর গৃহীত সংবিধান যে রিপাবলিক অব ইন্ডিয়া বা ভারতের সাধারণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল আজ তা মৌলিক সংকট ও গভীর হুমকির মুখে।

রাজতান্ত্রিক সেঙ্গোল প্রতীকসহ নতুন সংসদ ভবন, যাকে দেবরায় ভারতের ‘বিস্মৃত ঐতিহ‍্যের’ পুনর্জাগরণ বলে অভিহিত করেছেন, সংঘ বাহিনীর দৃষ্টিতে তা স্থাপত‍্যরূপে তাদের কাঙ্খিত ‘নয়া ভারতের’ আগমন হিসেবে ইতিমধ‍্যেই ঘোষিত হয়েছে। এক নতুন সংবিধানের জন‍্য দেবরায়ের ওকালতি স্বাধীন ভারতের সাংবিধানিক ভিত্তিমূলে আঘাত হানার এই প্রক্রিয়াকেই সমাপন করতে চায়। ভারতের সংবিধানের বিরুদ্ধে এই বিষাক্ত অভিযানকে শুরু থেকেই প্রতিরোধ করতে হবে। স্বাধীন ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রকে ধর্মান্ধতা, দাসত্ব ও ত্রাসের নতুন রিপাবলিকে বদলে দেওয়া কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যবে না।

- এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ২৮ আগস্ট ২০২৩

খণ্ড-30
সংখ্যা-30