ভারত যখন চাঁদে নামছে তখন তার শ্রেণিকক্ষ হয়ে উঠছে বিভীষিকাঘর
indian-classroom-turns-into-horror-chamber

চাঁদের মাটিতে চন্দ্রযান-৩’র সফল আলতো অবতরণ নিঃসন্দেহে ইসরোর এক ঐতিহাসিক সাফল্য সূচিত করেছে। চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে এই প্রথম কোনো চন্দ্রাভিযান সম্পন্ন হল যা চাঁদের বাস্তবতা নিরীক্ষণ করার ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দেবে বলে প্রত্যাশা। ভারতের এ’ধরনের বৈজ্ঞানিক পরাক্রম সাধারণভাবে বিজ্ঞান ও কারিগরির জগতে এবং নির্দিষ্টভাবে মহাকাশ গবেষণায় ভারতের সামগ্রিক অগ্রযাত্রাকে অনুপ্রাণিত করবে। মাত্র ৬০০ কোটি টাকার বেশ কমসম বাজেটেই এরকম সাফল্য অর্জনের দিকটিও সন্তোষজনক, বিশেষত ভারতের সড়ক নির্মাণের ওপর প্রকাশিত সর্বশেষ ক্যাগ (সিএজি) রিপোর্টে যেখানে দেখা যাচ্ছে যে এই চন্দ্রাভিযানের খরচ দ্বারকা এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে প্রতি তিন কিলোমিটারের খরচের থেকে কম। চন্দ্রযান-৩ অভিযানের সমস্ত সদস্য এবং ইসরো ও অন্যান্য সংস্থার যে সমস্ত কর্মীরা এই সাফল্যে অবদান রেখেছেন তাঁদের সকলেরই আন্তরিক অভিনন্দন প্রাপ্য।

মোদী সরকার চন্দ্রযান-৩ অভিযানের কৃতিত্ব নিতে ব্যস্ত। কিন্তু একটু গভীরে দেখলেই দেখা যাবে যে সরকারের অবহেলা অতিক্রম করেই এই মিশন সফল হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রাঁচির হেভি ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন (এইচইসি), যারা চন্দ্রযান-৩’র চলমান উৎক্ষেপণ চাতালটি নির্মাণ করে এবং নির্ধারিত সময়ের আগেই তা সম্পূর্ণ করে প্রদান করে, গত আঠারো মাস ধরে মাইনে পাচ্ছে না। ভারতের সরকারি ক্ষেত্রের ইস্পাত কারখানাগুলি নির্মাণেও এই এচইসির অবদান বিরাট। বর্তমানে মোদী সরকার এই সংস্থার প্রয়োজনীয় কার্য-পুঁজির জোগান দিতে, এমনকি কর্মীদের বেতন পর্যন্ত দিতে অস্বীকার করে একে রুগ্নদশার দিকে ঠেলে দিয়েছে। অথচ, এখন যখন মিশন সফল হয়েছে, যখন কোটি কোটি ভারতবাসী তাঁদের মোবাইল ফোন কম্পিউটার বা টিভির সাথে সেঁটে আছেন চাঁদে ভারতের অবতরণের ঐতিহাসিক মুহূর্ত অবলোকন করতে, তখনই নরেন্দ্র মোদী গোটা টিভিস্ক্রীন জুড়ে হাজির হয়েছেন ভাষণ দিয়ে সমস্ত প্রচারের আলো কেড়ে নিতে।

রাজনৈতিক প্রপাগাণ্ডা ও নির্বাচনী ফায়দার স্বার্থে চন্দ্র অভিযানকে দোহন করার মরিয়া প্রচেষ্টায় মোদী সরকার যে একে কেবলমাত্র প্রধানমন্ত্রীর আত্মপ্রচারের মঞ্চই বানাচ্ছে তা নয়, এমনকি ধর্মীয় কুসংস্কার ও আধুনিক বিজ্ঞানের এক অদ্ভুত জগাখিচুড়ি তৈরি করছে। চন্দ্র অভিযানকে বিজ্ঞানমনস্কতা প্রসারের প্রেরণা হিসেবে ব্যবহার করার বদলে সর্বতোভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে ধর্মীয় কুসংস্কারের সাথে যুক্ত করার। ল্যাণ্ডার বিক্রমের (ভারতের মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠার প্রেরণা বিক্রম সারাভাইয়ের নামানুসারে) চাঁদে অবতরণবিন্দুকে মোদী তড়িঘড়ি ‘শিবশক্তি বিন্দু’ নামে ঘোষিত করলেন, স্পষ্টতই হিন্দু ধর্মীয় অভিঘাত যুক্ত করতে। মোদীর শিবভজনা শেষ হতে না হতেই সেই সূত্র ধরে হিন্দু মহাসভার এক নেতা দাবি তুললেন শিবশক্তি বিন্দুকে রাজধানী করে চাঁদকে হিন্দুরাষ্ট্র ঘোষণা করার! এটাকে যদি একটু বেশিই চরম ব্যাপার বলে মনে হয় তাহলে নজর করে দেখুন, চন্দ্র অভিযানে যুক্ত বিজ্ঞানী নারীদের ধর্মীয় বিশ্বাসকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে কীভাবে পিঠ চাপড়ানো হল এবং কীভাবে তাঁদের ‘আদর্শ ভারতীয় নারী’ বলে দেখানো হল যাদের কাছে বিজ্ঞান ধর্মের সাথে দৃঢ়ভাবে যুক্ত, যুক্ত নয় শুধু, ধর্মেই প্রতিষ্ঠিত।

ইসরো যে ব্রেকথ্রু করল তা কয়েক দশকের গবেষণা ও অধ্যবসায়ের ফল। সব অভিযানই সাফল্য পায়নি। বিজ্ঞানিরা ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়েছেন। চন্দ্রযান-২’র ব্যর্থ অভিযান চন্দ্রযান-৩’র সাফল্যের পথ প্রশস্ত করেছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী কয়েক দশক ধরে আধুনিক ভারতে সরকারী অর্থানুকুল্যে যে শিক্ষা ও গবেষণা ব্যবস্থা গড়ে উঠছিল ইসরোর বিজ্ঞানী গোষ্ঠির অধিকাংশই তার ফসল। অন্যান্য সরকারি ক্ষেত্রের মতো সরকারি অর্থানুকুল্যে চলা শিক্ষাব্যবস্থাকেও এখন সুব্যবস্থিত কায়দায় দুর্বল করে দেওয়া হচ্ছে ক্রমবর্ধমান হারে শিক্ষা ও গবেষণাকে বেসরকারিকরণের দিকে ঠেলে দিয়ে। এবং উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার প্রায় সমস্ত ক্ষেত্র ও স্তর জুড়ে অনুসন্ধিৎসা, বিদ্যাচর্চার স্বাধীনতা ও বিদ্যায়তনের গণতন্ত্রকে খর্ব করে কুসংস্কার, চাটুকারিতা, ভীতি ও নীরবতার আবহ তৈরি করা হচ্ছে। অবাক হওয়ার কিছু নেই যে বিজ্ঞানমনস্কতাকে বলি দেওয়া হচ্ছে ধর্মান্ধতা ও বিদ্বেষের বেদিতলে, এবং তার মারাত্মক পরিণতি আমাদের চোখের সামনে প্রকট।

মুজফ্ফরনগরের শ্রেণিকক্ষের ভিডিওতে প্রাইমারি স্কুলের প্রিন্সিপালকে দেখা যাচ্ছে নিজে সাধারণভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে গালি দিতে দিতে একের পর এক ছাত্রকে নির্দেশ দিচ্ছেন একটি সাত বছর বয়সী মুসলমান সহপাঠীকে পেটাতে। এই ভিডিও আমাদের এটাই স্মরণ করিয়ে দেয় যে কীভাবে হিটলারের নাৎসি জার্মানিতে ক্লাসরুমের মধ্যে ইহুদি পড়ুয়াদের হেনস্থা করা ও শাস্তি দেওয়া হত। চলন্ত ট্রেন থেকে শুরু করে রাস্তা, রাস্তা থেকে টেলিভিশনের স্টুডিও এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম থেকে শুরু করে শ্রেণিকক্ষ বা শিক্ষায়তনগুলি — ঘৃণা যেন স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পর সমগ্র ভারতকে গ্রাস করার হুমকি দিচ্ছে। মুজফ্ফরনগর ছিল ‘লাভ জিহাদ’ মোকাবিলার নামে সংঘ বাহিনীর দ্বারা ২০১৩’র সুসমন্বিত দাঙ্গার অভিকেন্দ্র। কৃষক আন্দোলন সেই ঘৃণা ও বিভাজনের অভিযানকে পরাস্ত করতে সমর্থ হয়েছিল নতুন করে ঐক্য ও সংহতির বন্ধন জাগিয়ে। আজ আরো একবার বিদ্বেষ ও জিঘাংসার শক্তিগুলি সেই ঐক্যকে ধ্বংস করতে পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ ও হরিয়ানায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কৃষক আন্দোলন এবং শান্তি ও সুবিচারকামী সমস্ত শক্তিকে এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ প্রতিরোধ খাড়া করতে হবে।

বিজেপি নেতারা প্রকাশ্যেই এই ঘৃণা ও অত্যাচারের মঞ্চ হয়ে ওঠা স্কুলের অপরাধী প্রিন্সিপাল তৃপ্তা ত্যাগির পক্ষে দাঁড়িয়েছে। স্কুলটিকে এখন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং পড়ুয়াদের অন্য স্কুলে ঢুকিয়ে নেওয়া হচ্ছে বলে জানা যাচ্ছে। অত্যাচারীত ও আহত ছাত্রটির পরিবার আধিপত্যকারী সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তিগুলির দিক থেকে আইনি বিচার ও শাস্তি এড়িয়ে মিটমাট করে নেওয়ার চাপের মুখে রয়েছেন। দুর্ভাগ্যের বিষয় হল কিছু সন্দেহজনক কৃষক নেতার দিক থেকেও এই চাপ এসেছে। এই ধরনের বিষয়ে মিটমাট একমাত্র সত্য ও সুবিচারের ওপর দাঁড়িয়েই অর্জিত হতে পারে, সেগুলিকে জলাঞ্জলি দিয়ে নয়। ঘৃণার প্রচারক ও হিংসার কুশিলবরা সুরক্ষা পাচ্ছে, এই ভয়ঙ্কর ঘটনায় জনতার নজর আকর্ষণের জন্য সত্য-পরখকারী মোহাম্মদ জুবেইরকে আবার একবার নিশানা বানানো হচ্ছে।

আমাদের বুঝতে হবে যে, যে শিশুদের এই হিংসায় উৎসাহিত করা হল বা তা দেখতে বাধ্য করা হল তারাও যে শিশুটি এই অত্যাচারী ও আঘাতের মধ্যে দিয়ে গেল তার মতই এই ফ্যাসিবাদী বিভীষিকার শিকার। ফ্যাসিস্ট প্রচারকদের দ্বারা দৈনন্দিন ভিত্তিতে যে ঘৃণা অভিযান চালানো হচ্ছে, তা সে রাজনৈতিক বা ধর্মীয় যে কোনো ছত্রছায়াতেই হোক, অথবা টিভি সঞ্চালক বা বিবিধ সামাজিক গণমাধ্যমের মতামত-নির্মাতা ও প্রভাব বিস্তারকারীদের মাধ্যমেই হোক, এখন তা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষের অভ‍্যন্তরে চলে এসেছে ভারতের শিশুদের কিশলয় মনকে কলুষিত করতে। এই বিপজ্জনক সংকেতকে অগ্রাহ্য করলে আরো অনেক বড় বিপর্যয় আগামী দিনে আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে।

এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ২৯ আগস্ট – ৪ সেপ্টেম্বর সংখ্যা

খণ্ড-30
সংখ্যা-31