সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির নবম জাতীয় সম্মেলন সর্বাত্মকভাবে সফল কর
all-india-progressive-womens-association

দিল্লী : ৩০ সেপ্টেম্বর – ১ অক্টোবর ২০২৩

আইপোয়ার নবম জাতীয় সম্মেলন অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতিতে আয়োজিত হচ্ছে। দেশজুড়ে এখন স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের আওয়াজকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার নির্মম চেষ্টা চলছে। মেয়েরা যখনই জীবন, জীবিকা, অধিকার, সমতা ও ন্যায়বিচারের আওয়াজ তোলে তখনই বিজেপি সরকার এবং তার অনুগত সাম্প্রদায়িক বাহিনী আর সরকারের তাঁবেদারি করা সুবিধাভোগী প্রভাবশালী ধর্মীয়-সামাজিক শ্রেণী নিষ্ঠুরভাবে মেয়েদের প্রতিবাদী স্বর দমিয়ে দিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সামন্ততান্ত্রিক ও ব্রাহ্মণ্যবাদী মূল্যবোধে আটকে থাকা পরিবার ও সমাজ নারীর স্বাধীনতার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়।

মহিলা কুস্তিগিরদের উপর বছরের পর বছর যৌনহেনস্থা চালানো বিজেপি সাংসদের শাস্তি হয়না, প্রতিবাদী কুস্তিগিরদের ওপরই অকথ্য পুলিশি অত্যাচার নামায় মোদী-শাহ। মনিপুরে কুকি সম্প্রদায়ের দুই মহিলাকে নগ্ন করে হাঁটানো, মহিলাদের হত্যা ও গণধর্ষণ চলে বিজেপি সরকারের প্রত্যক্ষ মদতে। গুজরাট দাঙ্গার সময়ে বিজেপির যেসব সাম্প্রদায়িক গুন্ডারা বিলকিস বানোকে গণধর্ষণ করেছিল ও তাঁর পরিবারের সকলকে খুন করেছিল সেই জঘন্য অপরাধীদের ‘সংস্কারী’ আখ্যা দিয়ে মুক্ত করে ফুল-মালা দিয়ে সংবর্ধনা দেয় বিজেপি। এই হল বিজেপির ‘বেটি বাঁচাও’ শ্লোগানের আসল চিত্র। আর, ‘বেটি পড়াও’! সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থাকে এতটাই ব্যয়বহুল করে দেওয়া হয়েছে যে সাধারণ পরিবারের মেয়েদের উন্নত মানের শিক্ষার স্বপ্ন অধরা থেকে যাচ্ছে। মুসলিম মেয়েদের হিজাবের অজুহাতে স্কুলে আসা বন্ধ করার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। ওদিকে আবার মুসলিম মেয়েদের অধিকারের জন্য মায়াকান্না কেঁদে ইউনিফর্ম সিভিল কোডের কথা বলে সাম্প্রদায়িক বিভাজন করছে। অন্যদিকে আরএসএস-বিজেপি নেতারা বহুভাবে প্রতিনিয়িত বলে চলেছে যে মেয়েদের স্থান ঘরের ভেতর। মনুস্মৃতিকে ওরা সংবিধান বানাতে চাইছে, যে মনুস্মৃতি নারী ও শূদ্রকে সমস্ত মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার বিধান দেয়। মেয়েদের ব্যক্তিগত পছন্দের স্বাধীনতা এবং নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকার হিংস্রভাবে দমন করা হচ্ছে। আশা, অঙ্গনওয়াড়ি, মিড-ডে-মিল রন্ধনকর্মীদের সাম্মানিকের নামে শোষণ করা হচ্ছে। দরিদ্র মহিলাদের জন্য আবাস যোজনায় বাড়ি, একশো দিনের কাজ ও সরকারি হাসপাতালে সুচিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা নেই।

ধর্ম ও ঐতিহ্যের নামে কুসংস্কার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রচার করা হচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় স্বঘোষিত ধর্মগুরুরা খোলাখুলি লিঙ্গ-বিদ্বেষী বক্তব্য ও বিধান দিচ্ছে। সারা দেশে চলে পণের জন্য নিগ্রহ, অনার কিলিং, দলিত ও আদিবাসী মহিলাদের ওপর অত্যাচার, কন্যাভ্রুণ হত্যা, ধর্ষণ ও ডাইনি সন্দেহে হত্যা। নতুন রূপে অপরাধমূলক কার্যকলাপও বেড়ে চলেছে। যেমন, সাইবার ব্ল্যাকমেলিং, অনলাইনে ভয় দেখানো, ট্রল করা, সাইবার পর্নোগ্রাফি, বিকৃত ভিডিওর মাধ্যমে মেয়েদের হেনস্থা করা ইত্যাদি। বিজেপি-আরএসএসের মদতে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা হিন্দুত্ববাদী দলেরা ধর্ম ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করার নামে এই ধরনের লিঙ্গ-বিদ্বেষী ও সমাজ-বিরোধী হিংসা সংগঠিত করছে। ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষার নামে সমলিঙ্গ বিবাহ আইন প্রস্তাবের সক্রিয় বিরোধিতা করছে। প্রান্তিক লিঙ্গ ও যৌন পরিচয়ের মানুষদের জীবিকা ও সামাজিক সুরক্ষার অধিকার নিশ্চিত করার বদলে, বিজেপির নেতা মন্ত্রীরা এঁদের প্রতি বিদ্বেষমূলক বক্তব্য রাখছে।

সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি তার জন্মলগ্ন থেকে নারীমুক্তির লড়াই লড়ে আসছে। আমরা ভারতের নারী, সাবিত্রীবাই ফুলে-ফতেমা শেখের বৈপ্লবিক চেতনার উত্তরাধীকারী। আমরা ঘোষণা করছি যে নারীদের ও প্রান্তিক যৌনলিঙ্গ পরিচয়ের মানুষদের অধিকারের উপর ফ্যাসিবাদী আক্রমণ আমরা মেনে নেব না। লিঙ্গসাম্যের আন্দোলন ও ন্যায়ের পক্ষে থাকা নাগরিকদের প্রতি আইপোয়ার পক্ষ থেকে আহ্বান : “লিঙ্গসাম্যের পক্ষে, নারী স্বাধীনতার সমর্থনে, আরএসএস-বিজেপি’র বিরুদ্ধে আইপোয়ার ৯ম জাতীয় সম্মেলন সফল করুন”।

আমাদের করণীয়, আমাদের দাবি

১) সংবিধান ও ধর্ম-নিরপেক্ষতার বুনিয়াদী মর্মকে ধ্বংস করার চক্রান্ত মানছি না। লিঙ্গ, ধর্ম, জাতি নির্বিশেষে সকল ভারতবাসীর সমান নাগরিকত্ব নিশ্চিত করতে হবে।

২) অবিলম্বে ২০১৪ সালে ‘মহিলাদের অবস্থা’ (স্ট্যাটাস অফ উইমেন)-র উপর ভিত্তি করে রাখা উচ্চস্তরীয় কমিটির সুপারিশগুলি লাগু করতে হবে।

৩) ব্যক্তিগত বিবাহ আইন ও বিশেষ বিবাহ আইনের পরিভাষায় ন্যায় ও সমতার বিধানগুলি সুস্পষ্ট ও সুনিশ্চিত করতে হবে।

৪) জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ ও গণহত্যার সময় মহিলাদের বিরুদ্ধে হিংসাকে তোল্লাই দেওয়ার রাজনীতিকে কড়া হাতে দমন করতে হবে। ভার্মা কমিশনের সুপারিশ (সংঘাতপূর্ণ এলাকায় যৌন অপরাধের জন্য দোষী ব্যক্তিদের সাধারণ ফৌজদারি আইনের অধীনে বিচার নিশ্চিত করা) লাগু কর।

৫) মহিলাদের উপর যৌনহিংসার ঘটনা প্রতিরোধ করতে ও যৌনহেনস্থায় অভিযুক্তদের ক্ষমতা ও পদমর্যাদার অপব্যবহার বন্ধ করতে প্রতিটি সংগঠিত ও অসংগঠিত কর্মক্ষেত্রে সক্রিয় ইন্টারনাল কমপ্লেইন্টস কমিটি ও লোকাল কমপ্লেইন্টস কমিটি গঠন করতে হবে। প্রতিটি কলেজে ও ক্যাম্পাসে নির্বাচিত পড়ুয়া প্রতিনিধিদের নিয়ে যৌনহেনস্থা বিরোধী সচেতনতামূলক সেল গড়ে তুলতে হবে। এই সেলে দলিত, আদিবাসী, সংখ্যালঘু, রুপান্তরকামী ও প্রান্তিক যৌন পরিচয়ের নারীদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে।

৬) মহিলা ও প্রান্তিক যৌনলিঙ্গ পরিচয়ের মানুষদের উপর নীতিপুলিশি ও সামাজিক শোষণ বন্ধ করতে হবে। নারী ও প্রান্তিক যৌনলিঙ্গ পরিচয়ের মানুষদের শরীর ও মনের উপর স্বায়ত্ত্ব অধিকার সুনিশ্চিত করতে সরকারকে লিঙ্গসাম্যের লক্ষ্যে কাজ করা সংগঠনগুলির সাহায্যে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।

৭) মহিলাদের শ্রম লুট করা বন্ধ কর। অবিলম্বে মহিলাদের প্রাপ্য ন্যায্য মজুরি দাও এবং নারী ও শ্রমিক বিরোধী চারটি লেবার কোড বাতিল কর।

৮) প্রকল্প কর্মীদের স্থায়ীকরণ চাই। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর অন্তর্গত মহিলাদের জীবিকা নিশ্চিত করতে হবে। অসংগঠিত শ্রমিক মহিলাদের বিভিন্ন শ্রমিকের অধিকারগুলো দিতে হবে।

৯) ধর্মীয় গুরুদের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা অবিলম্বে বন্ধ কর। এহেন ধর্মীয় গুরুদের রাজনৈতিক সমর্থন কুড়ানোর জন্য ব্যবহার করা বন্ধ কর।

১০) অবিলম্বে সংসদে মহিলাদের ৩৩ শতাংশ আসন নিশ্চিত করতে মহিলা সংরক্ষণ বিল পাশ করো। এই বিলে দলিত, আদিবাসী, সংখ্যালঘু, রুপান্তরকামী ও প্রান্তিক যৌন পরিচয়ের নারীদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত কর।

১১) অবিলম্বে মানব পাচার প্রতিরোধ করার জন্য কার্যকরী একটি আইন পাশ কর এবং সেটি লাগু কর।

১২) যৌনহিংসা, লিঙ্গবিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িক হিংসার শিকার নারী ও প্রান্তিক যৌনলিঙ্গ পরিচয়ের মানুষদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন নিশ্চিত কর।

১৩) স্বাস্থ্যব্যবস্থার বেসরকারীকরণ মানছি না। প্রতি ৫০০০ জনসংখ্যায় স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ, মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসক ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা সহ সরকারী হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র গঠন করো।

১৪) বেটি পড়ানোর মেকী স্লোগান দেওয়ার বদলে স্নাতকস্তর অবধি মেয়েদের বিনামূল্যে শিক্ষা প্রদান কর। শ্রেণী, জাতি, ধর্ম, ভাষা নির্বিশেষে প্রত্যেকের জন্য সর্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরি কর।

১৫) রান্নার গ্যাসের দাম ৫০০ টাকা ধার্য কর।

১৬) প্রতিবন্ধী, বয়স্ক ও বিধবা মহিলাদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা ও সম্মান সুনিশ্চিত করার ব্যবস্থা নাও।

১৭) প্রতিটি পরিবারের জন্য পুষ্টিকর খাদ্যসুরক্ষা নিশ্চিত কর।

১৮) সমলিঙ্গ বিবাহের আইনি স্বীকৃতি চাই। প্রান্তিক লিঙ্গ ও যৌন পরিচয়ের মানুষদের জীবিকা ও সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।

১৯) সোমা সেন, গুলফিশা, ফতিমা সহ সব রাজনৈতিক বন্দীদের নিঃশর্ত মুক্তি চাই।

খণ্ড-30
সংখ্যা-31