প্রতিবেদন
সাংবাদিকদের শাস্তি দিতে অতি তৎপর মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী
to-punish-journalists

মণিপুরে বীরেন সিং-এর বিজেপি সরকার কুকি নারীদের যৌন নিগ্ৰহে নিষ্ক্রিয় থেকেছে, কুকি নারীদের লাঞ্ছনাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে একটুও তৎপরতা দেখায়নি। সেই সরকারই সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নিতে কী ভয়ঙ্কর সক্রিয়তার নিদর্শন রাখল। এডিটার্স গিল্ড অব ইন্ডিয়ার কাছে অভিযোগ আসে যে, মণিপুরের সংবাদমাধ্যম নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করছে না, তারা মেইতেইদের দিকে ঝুঁকে একতরফা সংবাদ পরিবেশন করছে। সেনা বাহিনীও রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অসুবিধার মুখে পড়ে অভিযোগ জানায়, সংবাদপত্রের সংবাদ পরিবেশন “উত্তেজনা উস্কিয়ে তুলে স্থায়ী শান্তি আসতে দিচ্ছে না।” এই অভিযোগের তদন্ত তাদের দায়িত্ব বিবেচনা করে গিল্ড মণিপুরের সংবাদপত্রগুলোর সংবাদ পরিবেশনের ধরনের তদন্তে তিন সদস্যের এক দল গড়ে দেয়। ঐ দলে যে সাংবাদিকরা ছিলেন তাঁরা হলেন সীমা গুহ, ভরত ভূষণ ও সঞ্জয় কাপুর। গিল্ডের এই সাংবাদিকরা মণিপুর ঘুরে এবং হিংসার শিকার আর রাষ্ট্রীয় ও মেইতেই সশস্ত্র বাহিনীর পীড়নকে প্রত্যক্ষ করা মানুষদের সাথে কথা বলে গত ২ সেপ্টেম্বর ২৪ পাতার এক রিপোর্ট প্রকাশ করেন। ঐ রিপোর্টে বলা হয়, ইম্ফল ভিত্তিক সংবাদমাধ্যমগুলো নিজেদের “মেইতেই মিডিয়া”তে রূপান্তরিত করেছে এবং “পক্ষপাতদুষ্ট রিপোর্ট” প্রকাশ করেছে, এবং তার উদ্দেশ্য হল মেইতেইদের পক্ষে এক অভিন্ন জাতিগত ভাষ্য তৈরি করা। সংবাদমাধ্যমগুলোয় প্রকাশিত রিপোর্টে সেনা সংগঠনগুলোর গায়েও কালি ছেটানো হয়, বিশেষভাবে আসাম রাইফেলস-এর বিরুদ্ধে চালানো হয় “লাগাতার প্রচার”। রিপোর্টে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়েছে, মেইতেই ও কুকিদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পর চুড়াচাঁদপুর, কাংপোকপি ও টেংনৌপল-এর মতো কুকি অধ্যুষিত জেলাগুলো থেকে সরেজমিন রিপোর্ট আসা বন্ধ হয়ে গেছে। গিল্ডের রিপোর্টে ইম্ফল থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্রের ১০টা রিপোর্টকে নির্দিষ্ট করে দেখানো হয়, সেগুলোতে ভুয়ো সংবাদ পরিবেশন করা এবং বিকৃত তথ্য ছড়ানো হয়েছে। মণিপুরের মিডিয়া পরিবেশিত সংবাদকে কটাক্ষ করে বলা হয়, “এখন সুস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে যে, ভুয়ো সংবাদের মাধ্যমে জাতিগত বিভেদ গভীরতর হয়ে উঠেছে, যে সংবাদের স্থান হয় একমাত্র ইম্ফল মিডিয়াতেই।” গিল্ডের এই রিপোর্টের মূল লক্ষ্য সম্পর্কে বলা হয়, “গিল্ড পুনরায় এটা বলতে চায় যে এই রিপোর্টের মূল লক্ষ্য হলো এই ধরনের সংবেদনশীল পরিস্থিতিতে মিডিয়াকে তার আচরণ সম্পর্কে আত্মবিশ্লেষণে ও বিবেচনায় সক্ষম করে তোলা।” রিপোর্টে বিজেপিপন্থী মিডিয়া এবং বীরেন সিং সরকারের গ্লানিকর ভূমিকার দিকে আঙুল তোলা হয় বলে বীরেন সিং সরকার গিল্ডের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসাপরায়ণ পদক্ষেপ গ্রহণে উঠেপড়ে লাগে। প্রসঙ্গত, গোদি মিডিয়া এখন একটা সর্বভারতীয় পরিঘটনা এবং মণিপুরে তার অস্তিত্ব থাকবে না এমন ভাবার কোনো ভিত্তি থাকতে পারে না।

বিজেপি বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা তাদের পছন্দের একটা কৌশল এ ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করল, এনগাঙ্গম শরৎ সিং ও সরোখাইবাম থৌবাল সঙ্গীতা নামে দুই ব্যক্তিকে দিয়ে গিল্ডের রিপোর্টের বিরুদ্ধে দায়ের করালো অভিযোগ। অভিযোগগুলোতে বলা হল, মণিপুরে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে শত্রুতা ও হিংসা বাড়ানোর উদ্দেশ্যেই গিল্ডের রিপোর্ট তৈরি হয়েছে। সম্প্রদায়গত আবেগ উস্কিয়ে তোলাও ঐ রিপোর্টের উদ্দেশ্য। মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং নিজেও বললেন গিল্ডের রিপোর্ট “পক্ষপাতদুষ্ট, বানানো এবং কারো কথায় তৈরি।” আরও বললেন, “ওরা (সাংবাদিকরা) রাষ্ট্র-বিরোধী, দেশদ্রোহী এবং সরকার-বিরোধী, ওরা এসেছিল বিদ্বেষ ঢালতে। আগে জানলে ওদের ঢোকার অনুমতিই দিতাম না।” অভিযোগ জানানোর সঙ্গে-সঙ্গেই তিন সাংবাদিক এবং গিল্ডের সভাপতি সীমা মুস্তাফার বিরুদ্ধে দুটো এফআইআর দায়ের হলো। গিল্ড ও তার সাংবাদিকদের শিক্ষা দিতে, তাদের গ্রেপ্তারের উদ্যোগ নিতে নিজের তৎপরতায় কোনো খামতি বীরেন সিং রাখলেন না। তবে গিল্ডের পক্ষে দ্রুতই সুপ্রিম কোর্টে এফআইআর-এর বিরুদ্ধে আবেদন জানানো হলে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ শুনানির সময় দুই অভিযোগকারীর আইনজীবী গুরু কৃষ্ণের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন রাখলেন, “আমাদের বলুন তাদের রিপোর্ট থেকে এই অভিযোগগুলো কী ভাবে প্রমাণ হচ্ছে।… যে অপরাধ ঘটেইনি, তা নিয়ে এফআইআর হয়ে গেল।” গিল্ডের পক্ষে আইনজীবী শ্যাম ডিভান বিচারপতিদের জানালেন, “বাস্তব ঘটনার ভিত্তিতে রিপোর্ট তৈরির পরিবর্তে তাদের সম্প্রদায়ের (মেইতেইদের) মতামত প্রচারের জন্য সাংবাদিকদের ওপর প্রভূত চাপ রয়েছে।” বিচারপতিরা মণিপুর সরকারকে দু-সপ্তাহের মধ্যে হলফনামা দিয়ে বলতে বলেছেন, কেন গিল্ডের সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো ও দায়ের করা এফআইআর বাতিল করা হবে না। আর এই দু-সপ্তাহ সরকার সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে কোনও দমনমূলক ব্যবস্থা নিতে পারবে না বলেও বিচারপতিরা নির্দেশ দিয়েছেন।

সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের সাথে মেরুকরণকেও আরও তীব্র করে তোলা হতে থাকল। মণিপুরে মেরুকরণ এতটাই পূর্ণ যে ইম্ফল উপত্যকা ও সংলগ্ন অঞ্চলের বাইরে মেইতেইদের সন্ধান পাওয়া যাবে না, আর কুকিদেরও অবস্থান একমাত্র পার্বত্য জেলাগুলোতেই। এরপরও ইম্ফল উপত্যকায় কোনো কুকির সন্ধান পাওয়া গেলে সরকারের বাহিনীই তাদের স্থানান্তরিত করে পার্বত্য জেলাগুলোতে, যেমনটা করল গত ২ সেপ্টেম্বর। প্রবল হানাহানি এবং মেইতেইদের সম্ভাব্য হামলার মধ্যেও দশটা কুকি পরিবার ইম্ফলের নিউ লাম্বুলেন ছেড়ে যাননি, চরম বিপদ সংকেতকে উপেক্ষা করে এবং অসীম সাহসিকতা দেখিয়ে উপত্যকা অঞ্চলেই থাকছিলেন। কিন্তু গত ২ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে ঘুম থেকে তুলে তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হল পার্বত্য জেলা কাংপোকপির মটরবাঙে। ঐ দশটা পরিবারে ছিল ২৪ জন সদস্য। তাদেরই একজন, কুকি স্বেচ্ছাসেবক এস প্রিম ভাইপেই জানিয়েছেন, “আমাদের ২৪ জনকে জিনিসপত্র গোছগাছের সময়টুকু পর্যন্ত দেওয়া হলো না, এবং যে জামাকাপড় পরেছিলাম সেগুলো গায়ে থাকা অবস্থাতেই গরু খেদানো করে গাড়িতে তুলে দেওয়া হল।”

এরই পাশাপাশি ডবল ইঞ্জিন সরকারের মদতে চলে কুকিদের বসবাসের পার্বত্য জেলাগুলোতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা। যার একটা নিদর্শন দেখা গেল গত ১২ সেপ্টেম্বর, যেদিন সকালে সশস্ত্র মেইতেই জঙ্গিদের গুলিতে নিহত হলো তিন কুকি গ্রামবাসী। এক অসুস্থ কুকি ব্যক্তির চিকিৎসার জন্য জিপসিতে করে গ্রাম থেকে পার্বত্য জেলা কাংপোকপির সদরে তাকে নিয়ে যাচ্ছিল আরও দুই কুকি। পশ্চিম ইম্ফল এবং কাংপোকপি জেলার সীমানা থেকে তিন কিলোমিটার ভিতরে গ্রামের মধ্যে এই হামলা চালানো হয়। নয়জন হামলাকারীর পরনে ছিল মণিপুর পুলিশের উর্দি এবং তারা ছিল স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষিত। বাফার জোন বা সংঘাত প্রবণ দুই এলাকার মাঝের নিরপেক্ষ বা অসামরিক চরিত্রের অঞ্চল পেরিয়ে মেইতেই জঙ্গিরা পার্বত্য এলাকার ভিতরে ঢুকল কী করে তা নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠছে। এই বাফার জোন পাহারা দেয় সেনা বাহিনী, এবং কোথাও-কোথাও মণিপুর পুলিশ। সূত্রকে উদ্ধৃত করে সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদ জানাচ্ছে, যে পুলিশ বাহিনীতে এখন মেইতেই ছাড়া অন্য কোনো সম্প্রদায়ের লোকজনের অস্তিত্ব বিরল, সেই বাহিনীর সহায়তা ছাড়া মেইতেই জঙ্গিদের পার্বত্য অঞ্চলে ঢোকা সম্ভব ছিল না। হামলার এই রকম আরও দুটো উদ্যোগ মেইতেইরা নিয়েছিল গত ৬ ও ৮ সেপ্টেম্বর। সে সময় সেনারা তাদের বাধা দিয়েছিল এবং সেনাদের সঙ্গে সংঘর্ষে কয়েকজন মারাও গিয়েছিল।

কিন্তু নিপীড়নের এই পদক্ষেপগুলোকে চেপে রাখা যায় না, এবং সেগুলো সারা বিশ্বেই চাউর হয়। জুলাই মাসের মাঝামাঝি মোদীর ফ্রান্স সফরের সময় ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট স্ট্রাসবুর্গের সভায় মণিপুরে মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে প্রস্তাব গ্ৰহণ করে জাতিগত ও ধর্মীয় হিংসা অবিলম্বে বন্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দেয়। সম্প্রতি আবার রাষ্ট্রপুঞ্জের ১৮ জন বিশেষজ্ঞ মণিপুরের পরিস্থিতি সম্পর্কে এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছেন, “সব বয়সের, বিশেষভাবে কুকি সংখ্যালঘু জাতির শত-শত নারী ও বালিকাদের নিশানা বানানো লিঙ্গ ভিত্তিক হিংসার রিপোর্ট ও ছবি আমাদের মর্মাহত করেছে। বিবৃত হিংসাগুলোর মধ্যে রয়েছে গণধর্ষণ, নারীদের নগ্ন করে রাস্তায় হাঁটানো, প্রবল প্রহারে ঘটানো মৃত্যু, এবং তাদের জীবন্ত অবস্থায় দগ্ধ করা বা পুড়িয়ে মারা।” এই বিবৃতির প্রতিক্রিয়ায় ভারত সরকার বলেছে এই ধরনের মন্তব্য “অসমর্থনীয়, অনুমান সাপেক্ষ এবং বিভ্রান্তিজনক।” কিন্তু বিবৃতি দিয়েই কি সত্যকে চাপা দেওয়া যায়? রাষ্ট্রপুঞ্জের বিশেষজ্ঞদের বিবৃতির শেষে এই আশা পোষণ করা হয়েছে যে, যে সরকারি কর্তাব্যক্তিরা মণিপুরের ন্যক্কারজনক পরিস্থিতিতে ইন্ধন জুগিয়েছেন, পরিস্থিতিকে অরাজকতার দিকে নিয়ে গেছেন, তাদের দায়বদ্ধ করা হবে। মণিপুরের বাস্তব পরিস্থিতি কি এই প্রত্যাশা পূরণের অনুকূল? নরেন্দ্র মোদী কি এখনও মণিপুর সফরকে পরিহার করে চলবেন, পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করে তুলতে কোনো সক্রিয়তা দেখাবেন না? জি-২০ বৈঠকে বিদেশী রাষ্ট্রনায়কদের সামনে গণতন্ত্রের বড়াই কি আদৌ বিশ্বাস উৎপাদনে সক্ষম হয়েছে? আর তা যদি না হয়ে থাকে তবে ‘গণতন্ত্রের জননীর’ সন্তানেরা পরিস্থিতির বিপন্নতায় শুধুই বিলাপ করবেন না, তাকে পাল্টাতেও প্রণোদিত হবেন।

- জয়দীপ মিত্র

খণ্ড-30
সংখ্যা-33