মোদী জমানায় মিডিয়া
media-in-the-age-of-modi_0

আজকের ভারতে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদীর সম্পর্ক কেমন? এই প্রশ্নের উত্তর এক কথায় লাভ-হেট বা ভালোবাসা ও ঘৃণার সম্পর্ক। আজ এই বিষয়টা সম্পর্কে সকলেই একরকম অবহিত যে, মূল ধারার সংবাদমাধ্যমের এক বড় অংশই পরিণত হয়েছে সরকারের অনুগত প্রতিষ্ঠানে, আজকের জনপ্রিয় ভাষায় যা মোদী ঘনিষ্ঠ বৃহৎ পুঁজিপতিদের মালিকানাধীন গোদি মিডিয়া বলেই পরিচিত। সরকারের কাজ নিয়ে তার কাছে অস্বস্তিকর প্রশ্ন তোলার চেয়ে সরকারের গুণকীর্তনই এই সংবাদমাধ্যমের কাছে অভিপ্রেত হয়। এমনকি আরএসএস’এর মতাদর্শ প্রচারেও এরা কুণ্ঠিত নয়। এই মিডিয়া মোদীর কাছে অতএব একান্তই কাম্য। তবে, সরকারের সার্বিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও মিডিয়ার একটা অংশকে এখনও বশীভূত করা যায়নি। তারা সরকারের কাজ নিয়ে তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করায়, মোদী ঘনিষ্ঠ পুঁজিপতিদের বিশেষ সুবিধা দান ও অন্যায্য পথে বরাত দানের উন্মোচন ঘটায়, ধর্মীয় বিভাজন ভিত্তিক সামাজিক মেরুকরণের শাসকের উদ্যোগকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায়। ডিজিটাল ও সামাজিকমাধ্যমেই এই মিডিয়া বেশি সক্রিয়। এই মিডিয়ার বিরুদ্ধে মোদী সরকার সহজাতভাবেই অসন্তুষ্ট ও প্রতিহিংসাপরায়ণ। এদের নিয়ন্ত্রণে আইন তৈরি হয়, অ-বশীভূত সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার করে জেলে পোরা হয়, সরকারের সমালোচক সংবাদমাধ্যমের অফিসে ও ডিরেক্টরদের বাড়িতে তদন্তকারী সংস্থা দিয়ে তল্লাশি চালানো হয়। আর মোদী শাসনের এক দশকে এটাও পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, সাংবাদিকদের কাছে নিজের সরকারের কাজের জবাবদিহি মোদীর ধাতে একেবারেই নেই। কেন্দ্রে ক্ষমতায় বসার পর থেকে নরেন্দ্র মোদী তাই সাংবাদিকদের মুখোমুখি হওয়াকে পুরোপুরি এড়িয়ে গেছেন। তাঁর পূর্বসূরী মনমোহন সিং ‘মৌন’ বলে অভিযুক্ত হলেও এক দশকের শাসনকালে তিনি নয় নয় করে ১১৭টা সাংবাদিক সম্মেলন করেছিলেন।

সরকারের খবরের প্রকাশকে যথাসম্ভব সীমিত করতে সরকারের মন্ত্রী, কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে সাংবাদিকদের সাক্ষাৎকেও মোদী সরকার অনুমতি নির্ভর করল। মোদী জমানা শুরু হওয়ার কয়েক বছর পর থেকে, বিশেষভাবে ২০১৯’র নির্বাচনে জয়ের পর দ্বিতীয় দফায় নিয়ম বলবৎ হল যে, অনুমতি পাওয়া গেলে তবেই মন্ত্রী ও আমলাদের সঙ্গে সাংবাদিকদের সাক্ষাৎ হতে পারবে। সাংবাদিকদের সংসদে প্রবেশও অবাধ রইল না। ভারতে এসে বিদেশি সাংবাদিকদের কাজ করার, বিশেষভাবে আসাম ও কাশ্মীর থেকে রিপোর্ট করার ক্ষেত্রে বিদেশ ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের অনুমতি লাভকে বাধ্যতামূলক করা হলো। বিদেশি সাংবাদিকদের ভারত থেকে কাজ করার ভিসা, পারমিটের আবেদন প্রায়শই প্রত্যাখ্যাত হতে থাকল।

মোদী সরকার ২০২১’র মার্চে তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে নতুন বিধি নিয়ে আসে। সেই বিধিতে এমন সংস্থান রয়েছে যার ভিত্তিতে ডিজিটাল সংবাদমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ সম্ভব। ঐ বিধির বলে সরকার দেশের যে কোনো স্থানে প্রকাশিত ও প্রচারিত সংবাদকে ব্লক করতে, মুছে দিতে বা পাল্টে দিতে পারবে। মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে সরকার গত তিন বছরে যে আইনগুলো নামিয়েছে সেগুলো হলো : ওপরে উল্লেখিত ২০২১’র মার্চের তথ্য প্রযুক্তি ক্ষেত্রের বিধি ছাড়াও ইন্ডিয়ান টেলি কমিউনিকেশন বিল ২০২২; ডিজিটাল ব্যক্তিগত তথ্য পরিসংখ্যান আইন ২০২৩; সংবাদপত্র ও পত্রিকা নথিবদ্ধকরণ বিল; এবং ডিজিটাল ইন্ডিয়া বিল। এই আইনগুলোর উদ্দেশ্য সম্পর্কে ক্যারাভান পত্রিকায় ২০২৩’র ২ ডিসেম্বর প্রকাশিত অনন্ত নাথের লেখা ‘কণ্ঠস্বরকে দাবিয়ে রাখা’ শীর্ষক নিবন্ধে বলা হয়েছে, “এই আইনগুলোর মধ্যে দিয়ে সরকার অরওয়েলীয় বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন এমন কাঠামো তৈরি করবে যা ক্ষমতা বণ্টিত করে মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রিত করবে, বিষয়বস্তুকে সেন্সর করবে এবং সরকারের সমালোচক কণ্ঠস্বরগুলোকে নিশানা বানাবে।...”

মোদী জমানায় সাংবাদিকদের ওপর নিপীড়ন আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে এবং সাংবাদিকদের নিরাপত্তাও বিপন্ন হয়েছে। কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট বা সাংবাদিকদের সুরক্ষায় কাজ করে চলা কমিটির প্রকাশ করা তথ্য জানাচ্ছে — মোদী জমানায় ২০১৪ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত ৩৬ জন সাংবাদিককে কারারুদ্ধ করা হয়েছে, মনমোহন সিং’এর ইউপিএ জমানায় এক দশকে যে সংখ্যাটা ছিল মাত্র আট। এখানে উল্লেখ জরুরি যে, যোগী আদিত্যনাথ শাসিত উত্তরপ্রদেশের হাথরসে দলিত তরুণীর গণধর্ষণ ও নিহত হওয়ার খবর সংগ্রহ করতে যাওয়ার সময় সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পানকে গ্রেপ্তার করে যোগীর পুলিশ এবং জামিনে মুক্তিলাভের আগে তাঁকে ৮৫০ দিন কারাবাস ভোগ করতে হয়। লব্ধ তথ্য আরও জানাচ্ছে, ২০১৪ থেকে ২০২৩’র মধ্যে ২৮ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন, ১৬ জনের বিরুদ্ধে দানবীয় ইউএপিএ প্রয়োগ হয়েছে এবং তাদের মধ্যে ৭ জন সাংবাদিক কাশ্মীরের। সাংবাদিকদের ওপর নজরদারি বেড়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে নজরদারি যন্ত্রের প্রয়োগও হচ্ছে। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায়, ভীমা কোরেগাঁও মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগকে গুরুতর করে তুলতে ইজরায়েলি নজরদারি প্রযুক্তির মাধ্যমে অভিযুক্তদের মোবাইল ফোনে ডুয়ো তথ্য ঢোকানোর অভিযোগের কথা। সামাজিকমাধ্যমে, ফেসবুক ও এক্স হ্যান্ডেলের (পূর্বের টুইটার) ওপর নজরদারি প্রবলতর হয়েছে।

স্থানাভাবে সাংবাদিক ও সংবাদ প্রতিষ্ঠানের ওপর হানাদারি ও তল্লাশির গুটিকয়েক ঘটনার উল্লেখই আমরা এখানে করব। ফেসবুকে সরকারের সমালোচনা করার জন্য মনিপুরের সাংবাদিক কিশোর চন্দ্র ওয়াংখেমকে প্রায় তিন বছরের ব্যবধানে তিনবার গ্রেপ্তার করা হয়। কাশ্মীরে ২০২২’র ২২ নভেম্বর থেকে আজ পর্যন্ত ১৭ জন সাংবাদিকের বাড়িতে তদন্তকারী সংস্থাগুলোকে দিয়ে তল্লাশি চালানো হয়েছে। বৈদ্যুতিন ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রকের নির্দেশে ২০২৩ সালের ২৩ আগস্ট তদন্ত-ভিত্তিক সংবাদ পরিবেশনকারী সংস্থা কাশ্মীরওয়ালার সাইট বন্ধ করে দেওয়া হয়, ফেসবুক পেজ ও এক্স-সংযুক্ত (পূর্বের টুইটার) অ্যাকাউন্টও বন্ধ করা হয়। এর পাঁচদিন পরই বন্ধ করা হয় সামাজিক মাধ্যমের চ্যানেল গাঁও সবেরাকে পাঞ্জাব ও হরিয়ানার কৃষকদের প্রতিবাদের খবর প্রচারের জন্য। এই দুই চ্যানেলের ওপর হামলার পর সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার মূল্যায়নে নিযুক্ত আন্তর্জাতিক সংস্থা রিপোর্টার্স স্যান্স ফ্রন্টিয়ার বলে, “কাশ্মীরওয়ালা ও গাঁও সবেরা নরেন্দ্র মোদী সরকারের অনলাইন ইকোসিস্টেমের আরও বেশি নিয়ন্ত্রণের নীতির শিকার ...।”

ডিজিটাল সংবাদ প্রতিষ্ঠান নিউজক্লিক’এর কার্যালয়ে ও ডিরেক্টরদের বাড়িতে আয়কর দপ্তর তল্লাশি চালায় ২০২৩’র ৩ অক্টোবর সকালে। তল্লাশি এই অভিযোগের ভিত্তিতে চালানো হয়েছিল যে ঐ সংবাদ প্রতিষ্ঠানে ঘুরপথে চীনা বিনিয়োগ হচ্ছিল এবং সংস্থাটি জাতীয় স্বার্থ বিরোধী কার্যকলাপে যুক্ত ছিল। ঐ হানাদারির পর দ্য হিন্দু সংবাদপত্রের সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছিল, “কোনো সরকারই শুধুমাত্র বিনিয়োগ সম্পর্কে সন্দেহের বশবর্তী হয়েই সাংবাদিকদের নিশানা বানাতে পারে না এবং সেই সূত্রে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করতে পারে না, যে অধিকারটি সংবিধানে সুনিশ্চিত করা হয়েছে।”

জনসংখ্যার নিরিখে ভারত বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র। আর গণতন্ত্রের কাছে তার চতুর্থ স্তম্ভ সংবাদমাধ্যম যে অতীব গুরুত্বপূর্ণ, নির্ভরযোগ্য সংবাদমাধ্যম ছাড়া গণতন্ত্র যে একনায়কতন্ত্রে পরিণত হয় সেই অভিমতের যথার্থতা প্রশ্নাতীত। বিশ্বের দেশে দেশে গণতন্ত্রের অবস্থা নিয়ে সমীক্ষা চালায় যে আন্তর্জাতিক সংস্থা, সেই ভি-ডেম’এর মূল্যায়নে ভারত এখন “নির্বাচন ভিত্তিক স্বৈরতন্ত্র”। নরেন্দ্র মোদী ভারতকে অভিহিত করেছেন “গণতন্ত্রের জননী” রূপে। সেই জননীর দশা এখন এমনই যে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ সেখানে হাঁসফাঁস করছে। এর মধ্যেই মিডিয়ার যে অংশ নীতিনিষ্ঠ সাংবাদিকতার পথে অবিচল থাকছে, প্রশাসনিক অনাচারের বাস্তবতার মুখে সরকারকে দাঁড় করাচ্ছে, মিডিয়ার সেই অংশকে উৎসাহিত করে, মদত জুগিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হবে ভারতের জনগণকেই।

- জয়দীপ মিত্র

খণ্ড-31
সংখ্যা-15