স্কুল সার্ভিস কমিশনের নিয়োগ দুর্নীতি ও পঁচিশ হাজার শিক্ষক শিক্ষাকর্মীর চাকরি বাতিলের রায় প্রসঙ্গে
school-service-commission

২০১৬ সালের স্কুল সার্ভিস কমিশন আয়োজিত নিয়োগ পরীক্ষায় মারাত্মক রকমের দুর্নীতি হয়েছিল। সেই সংক্রান্ত মামলাগুলির বিচার প্রসঙ্গে ২২ এপ্রিল ২০২৪ হাইকোর্টের ডিভিশান বেঞ্চ যে রায় দিয়েছে, তা বাংলার সমাজ রাজনীতিতে প্রবল আলোড়ন ফেলেছে। এই রায়ে অন্তত তিনটি বড়সড় ঘোষণা আছে।

রায়ের যে দিকটি সবচেয়ে বেশি আলোড়ন ফেলেছে তা হল কলমের এক খোঁচায় প্রায় পঁচিশ হাজার শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর চাকরি বাতিল করে দেওয়া ও এরফলে তাঁদের জীবন জীবিকা অনিশ্চিত হয়ে পড়া। নিয়োগ সংক্রান্ত পুরো প্যানেলটিই বাতিল করে দেওয়া হয়েছে ও নতুন করে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করতে বলা হয়েছে।

রায়ের এই দিকটি আমাদের কাছে তীব্র আপত্তিকর, অমানবিক ও বাতিলযোগ্য বলে মনে হয়েছে। আমাদের সংবিধান সহ পৃথিবীর সমস্ত সভ্য দেশের আধুনিক আইনবিধি স্পষ্টভাবে বলেছে যে, কোনও পরিস্থিতিতেই কোনও নিরপরাধ যেন শাস্তি না পান, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। অথচ এই রায়ে মানবাধিকারের সেই মৌলিক দিকটি লঙ্ঘিত হল। যারা অপরাধী নন, যারা দুর্নীতি করেছেন বলে কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি, যোগ্যতার সঙ্গে যারা বেশ কয়েক বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তের স্কুলে পাঠদানের দায়িত্বভার সামলে আসছেন, তেমন হাজার হাজার শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীকে এই রায় চাকরি থেকে বরখাস্ত করার এক ভয়াবহ নিদান দিল। আমরা চাই উচ্চতর আদালত নির্দোষ শিক্ষক শিক্ষিকা শিক্ষাকর্মীদের কাজে পুনর্বহালের ঘোষণা করুন। তাঁদের জীবন, জীবিকা ও সম্মান ফিরে আসুক। আমরা আমাদের সমস্ত শক্তি নিয়ে এই সমস্ত মানুষদের আন্দোলনের পাশে থাকার অঙ্গীকার করছি।

এই রায়ে এছাড়াও বলা হয়েছে যাদের দুর্নীতির স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে, তাদের শুধু যে চাকরি যাবে তাই নয়, চাকরিকালীন পাওয়া যাবতীয় বেতনের টাকা সুদসহ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফেরৎ দিতে হবে। না দিলে জেলাশাসক ব্যবস্থা নেবেন। এই দুর্নীতির প্রমাণের মধ্যে আছে সাদা খাতা জমা দিয়ে চাকরি পাওয়া, প্যানেলে নাম না থাকা সত্ত্বেও চাকরি পাওয়া ইত্যাদি। রায়ের এই অংশটি নিয়ে যে প্রশ্নটি দানা বেঁধেছে সেটি শ্রমের মূল্য সংক্রান্ত। যারা এত বছর শ্রম দিলেন, সেই শ্রমের মূল্য হিসেবে যে বেতন পেলেন, তা দিয়ে গ্রাসাচ্ছাদন চালালেন অন্য কোনও জীবিকায় যুক্ত না হয়ে, সেই শ্রমের মূল্যে পাওয়া বেতন কেন তাঁদের ফেরৎ দিতে হবে।

এছাড়াও এই রায়ে বলা হয়েছে দুর্নীতির স্পষ্ট প্রমাণ সামনে আসার পরেও বিদ্যমান সার্ভিস রুল অনুযায়ী দুর্নীতিগ্রস্তদের চাকরি বাতিল করে শূন্যপদ তৈরি করা হয়নি। তার পরিবর্তে প্যানেলভুক্ত চাকরি না পাওয়া বঞ্চিত ও আন্দোলনরতদের চাকরি দিতে সুপার নিউমেরিক পোস্ট সৃষ্টি করা হয়েছে। এটিকে আদালত দুর্নীতিকে মদত দেওয়া বলে মনে করেছে ও যাঁরা পশ্চিমবঙ্গের আইনসভায় সুপার নিউমেরিক পোস্ট বানিয়েছিলেন তাঁদের বিরুদ্ধে সিবিআই’কে তদন্ত শুরু করতে বলেছে। তদন্তের প্রয়োজনে সংশ্লিষ্টদের হেফাজতে নেবার কথাও বলা হয়েছে।

এই রায় লোকসভা নির্বাচনের যে উত্তুঙ্গ সময়ে প্রকাশিত হল তা নানা প্রশ্ন তৈরি করছে। যে সময়ে দেশের নানা প্রান্তে বিরোধী নেতাদের হরেক মিথ্যা মামলা ও অভিযোগে গ্রেপ্তার ও হেনস্থা করে চলেছে ইডি, সিবিআই সহ কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলি, সেই সময়েই এসেছে এই রায়। এই রায় প্রকাশের ঠিক আগে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা যখন রাজনৈতিক বোমা ফাটার পূর্বাভাস করেন, তখন তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। এই সংক্রান্ত মামলার পূর্বতন বিচারক বিচারকাজ ছেড়ে এখন বিজেপির লোকসভার প্রার্থী হয়েছেন, এই তথ্য স্বাভাবিকভাবেই বর্তমান রায়টি নিয়েও নানা জল্পনাকে উসকে দিচ্ছে।

তবে আদালতের রায় ও তা প্রকাশের সময় নিয়ে যে সব প্রশ্ন বা আপত্তিই থাকুক না কেন, নিয়োগে যে মারাত্মক রকম দুর্নীতি হয়েছে এবং তাতে রাজ্য সরকার, এসএসসি, পর্ষদ, রাজ্যের শাসক দল তৃণমূলের নেতা মন্ত্রীদের যে প্রত্যক্ষ ভূমিকা আছে, সেই সম্পর্কে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যে সব অসঙ্গতি ও দুর্নীতির কথা এসেছে তা এরকম,

  • ১) নাইসা নামক সংস্থাকে OMR স্ক্যানের বরাত দেওয়া।

  • ২) নাইসার তরফে অন্য একটি সংস্থাকে আবার কিছু কাজ আউটসোর্স করে দেওয়া।

  • ৩) OMR’র অরিজিনাল কপি ধ্বংস করে দেওয়া।

  • ৪) স্ক্যান করা OMR সংক্রান্ত তথ্য SSC’র ডেটাবেস থেকে সরিয়ে দেওয়া।

  • ৫) প্যানেলে নাম না থাকা ব্যক্তিদের প্রচুর পরিমাণে নিয়োগ করা।

  • ৬) সাদা খাতা জমা দেওয়াদের প্রচুর পরিমাণে প্যানেলে অন্তর্ভুক্তি।

  • ৭) প্যানেলের মেয়াদ শেষ হবার পরেও অনেককে চাকরি দেওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি।

যারা এই দুর্নীতির মূল কাণ্ডারী উচ্চ আদালতে যোগ্য প্রার্থীদের সসম্মান পুনর্বহালের পাশাপাশি তাদেরও যথাযোগ্য শাস্তি হওয়া দরকার।

বে-আব্রু হয়ে যাওয়া রাজ্য সরকারের উচিত দুর্নীতির বিষয়গুলি আর আড়াল করার চেষ্টা না করে যা যা দুর্নীতি হয়েছে তা খোলাখুলি স্বীকার করে নেওয়া। কারা দুর্নীতি করেছেন ও কারা স্বচ্ছভাবে চাকরি পেয়েছেন তা সরকার ও স্কুল সার্ভিস কমিশনের তরফে এখনই স্পষ্ট করে দেওয়া দরকার। দুর্নীতিগ্রস্তদের বাঁচানোর চেষ্টা না করে স্বচ্ছভাবে চাকরি প্রাপ্তদের পাশে দাঁড়ানোটাই এখন মূল কাজ। যোগ্যদের চাকরির যাতে কোনওরকম ক্ষতি না হয় তা নিশ্চিত করার দায়দায়িত্ব সরকার, তদন্তকারী সংস্থা ও আদালতকে নিতে হবে।

- সৌভিক ঘোষাল

খণ্ড-31
সংখ্যা-15