কী ভাবছেন ওঁরা
what-are-they-thinking-1

পার্বতী দেবী চটকলের এক ঠিকা শ্রমিক। সত্তরের দশকের শেষে হাওড়ার বেঙ্গল জুট মিলে ঢোকেন। শ্রীপুরের মিলেও কাজ করেছেন। তীব্র অভাবের সংসারে নিরুপায় হয়েই কাজে ঢোকা। ঠিকা শ্রমিক হিসেবে একেবারে শূন্য হাতে অবসর নেওয়ার পর এখন বাড়ির কাছের জুটমিলে ঢুকেছেন। সেই ঠিকা শ্রমিক হিসেবেই। ছ’বছর ধরে কাজ করছেন ফিনিশিং ডিপার্টমেন্টে। প্রায় সাড়ে চার দশক আগে কাজের শুরুতে, পঁচিশ বস্তার বান্ডিল বাঁধার কাজে বান্ডিল পিছু আট আনা পেতেন। বললেন, এখন অনেকটা ভালো পাই। কত? বান্ডিল পিছু ৩ টাকা! ইএসআই, পিএফ, গ্র্যাচুইটি — সারাজীবন এসব কিছুই পাননি। পাওয়ার কথা হয়তো ভাবেনওনি।

এখন ওনার ডিপার্টমেন্টে উনি একাই মহিলা। বেশ কয়েক জন পুরুষ আছেন। তারা ঠিকা নন, কোম্পানির শ্রমিক। তারা আট ঘণ্টায় ১৪৫ বান্ডিল দিলে যা পান তা পার্বতীর থেকে অনেকটাই বেশি। এছাড়াও অন্য প্রাপ্যগুলো আছে। কিন্তু এই ডিপার্টমেন্টে কোম্পানির মহিলা শ্রমিক নেই কেন? বললেন, মহিলাদের তো কোম্পানি অনেকদিন আগে থেকেই ছাঁটাই শুরু করেছে। প্রথম যে মিলে ঢুকেছিলাম, সেখানে কোম্পানির অনেক মেয়ে লেবার ছিল। কিন্তু কিছুদিন বাদে তাদের ছাঁটাই করে দিল। মেয়েরা আছে, কিন্তু বেশিরভাগ ফুরোনে। কেন এটা হচ্ছে? মেয়েদের দিয়ে অনেক কম পয়সায় কাজ করানো যায়, তাই ফুরোনে হিসেবেই রাখা হয়। (তার জলজ্যান্ত প্রমাণ অবশ্য উনি নিজেই, ৪৫ বছর কাজের পরও ‘ঠিকা শ্রমিক’)

সম্ভবত আশির দশকের মাঝামঝি এই ছাঁটাই শুরু হয়েছে। নয়া উদারীকরণের হাওয়ায় তা আরও তেজী হয়েছে। এই ছাঁটাইয়ের কতটা বিরোধিতা হয়েছিল? চটকলের এই মহিলা শ্রমিকরা ‘মহিলা’ বলেই কি ব্রাত্য ছিলেন ট্রেড ইউনিয়ন পরিসরে? কন্ট্রাক্টরের অধীনে থাকা যে মহিলারা বছরের পর বছর শোষিত, বঞ্চিত হয়েছেন, তাঁদের কথাও শ্রমিক আন্দোলনের পরিসরে উঠে আসেনি কেন সেভাবে?

পার্বতীর বিয়ে হয় বাহাত্তর সালে। তারপর একে একে চারটি সন্তান। বিহারের মানুষ। কিন্তু তিনি এখন এখানকার মানুষই হয়ে গেছেন। একচিলতে জমিতে পাকা ঘর। লীজ দলিলও পেয়েছেন।

ছোট বাচ্চাদের রেখে সকালবেলা বেরিয়ে যেতে হত কাজে। ফিরতে ফিরতে রাত সাড়ে এগারোটাও হয়ে যেত কোনো কোনো দিন। বাসে হাওড়া, তারপর লঞ্চে গঙ্গা পেরোনো। সামনে দাঁড়ানো ছেলেকে দেখিয়ে বললেন, ওকে ঘুমন্ত অবস্থায় রেখে বেরিয়ে যেতাম। ফিরতাম যখন, তখন ও ঘুমিয়ে পড়তো। দিনের পর দিন ও আমাকে দেখতে পেত না। এক হাঁড়ি বার্লি বানিয়ে রেখে বেরিয়ে যেতাম। সারাদিন ঐ খেত। বড় মেয়ে জলে বিস্কুট ভিজিয়ে খাইয়ে দিত। এইভাবেই সন্তানরা বড় হয়েছে। সেই সন্তানদের একটি অকালে চলে গেছে। জোয়ান ছেলে। করোনায় কন্যাতুল্য দেওরঝিও মারা গেছে। এইসব শোক তাপ নিয়ে নাতি-নাতনির মুখ দেখে বেঁচে আছেন। নিজের শরীর খাটিয়ে এখনও যে স্বাবলম্বী হয়ে বাঁচতে পারছেন, এটাই তাঁর ভালো লাগে।

ভোট কাকে দিচ্ছেন? বিজেপিকে? সটান উত্তর, কেন, বিজেপি কী দিয়েছে আমাদের? যা চাল দেয় তা অখাদ্য। তবে? রামমন্দির করেছে বলে? রাম ছিলেন না আমাদের? না কি তাঁর মন্দির ছিল না? কোটি কোটি টাকা খরচ করে মন্দির। কী, না রামের নানা, দাদা, নানী, মাসি সবাই নাকি টাকা দিয়েছে। তা এত টাকা দিয়ে কটা কারখানা বানানো যেত না দেশে? বেকার ছেলেপুলের চাকরি হত, পেটে খেয়ে বাঁচত! রাম তাতে অনেক বেশি খুশি হতেন! কী না বল! আমি রাজনীতি বুঝি না, তবে নিজের জীবন থেকে বুঝেছি, আগে পেটের ভাত, তারপর সব কিছু! আর সবচেয়ে বড় কথা — রাম নিয়ে রাজনীতি কেন? মন্দিরে রাজনীতি ঢুকিয়েছে কেন?

ভাবছি, একজন শ্রমজীবী মানুষ হিসেবে সারাজীবন আর্থিক ভাবে প্রতারিত হয়েছেন। কিন্তু সেই বঞ্চনা, কষ্ট ছাপিয়েও এই শ্রমিকের জীবন তাঁকে দিয়েছে এক জীবন বীক্ষা যা ভাত আর ইজ্জতের দাম তাঁকে বুঝতে শিখিয়েছে। বুঝিয়ে দিয়েছে ধর্ম আর রাজনীতির ফারাকটা।

শুধু পার্বতী নন, দেশজুড়ে অসংখ্য পার্বতী ক্রমশ জাগছেন। নিজেদের অধিকার বুঝে নিতে চাইছেন। তাই তো রাজনৈতিক পরিসরে তাদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আর আড়াল করে রাখা যাচ্ছে না! আর সেই জাগরণের ঢেউ কুলপ্লাবী হয়ে সমস্ত সত্তা জুড়ে ছড়িয়ে পড়বে, এটাও নিশ্চিত!

- জয়ন্তী দাশগুপ্ত

খণ্ড-31
সংখ্যা-15