নয়া কৃষি আইনের পাশাপাশি কেন বিদ্যুৎ বিল (সংশোধনী) ২০২০-র বিরোধিতা করছেন কৃষকরা?
dddd

চলমান কৃষক আন্দোলনের ভরকেন্দ্রে নয়া কৃষি আইন থাকলেও, কৃষকদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি হল বিদ্যুৎ বিল (সংশোধনী) ২০২০ প্রত্যাহার। বর্তমান নিবন্ধে আমরা এই স্বল্পালোচিত বিষয়টি সম্পর্কে আলোচনা করব। ওয়াকিবহাল মহলের আশঙ্কা এই বিলটি পাশ হলে দেশের কৃষকদের উপর বার্ষিক ১ লক্ষ কোটি টাকার অতিরিক্ত বোঝা চাপবে।

আলোচনার সুবিধার্থে এই প্রস্তাবিত বিলটি বিদ্যুৎ-এর দামের ক্ষেত্রে কী ধরনের পরিবর্তন চায় তা প্রথমে দেখে নেব। বর্তমানে যারা ধনী (বিদ্যুৎ খরচ তারাই বেশি করে) তাদের বিদ্যুতের দাম  বেশি দিতে হয় এবং যারা গরিব (বিদ্যুৎ-এর খরচ তাদের কম) তারা তুলনায় কম দাম দেয়। একইভাবে গ্রামাঞ্চলে গরিব মানুষ এবং কৃষকদের ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ-এর দাম কম হয়। এই বিষয়টাকে বলা হয় ক্রস সাবসিডি। বর্তমান বিলে এই ক্রস সাবসিডির ব্যবস্থা তুলে দিয়ে বলা হয়েছে গ্রাহককে (সে ধনকুবের হোক বা নিরন্ন চাষি) বিদ্যুৎ পরিবহনের প্রকৃত দাম (cost to serve the consumer) দিতে হবে। এই সংশোধনীর ফলে প্রকৃত অর্থে কৃষক তথা গ্রামীণ গ্রাহকদের বিদ্যুতের দাম বেশি দিতে হবে কারণ গ্রামীণ এলাকায় বিদ্যুৎ পরিবহণের খরচ অনেক বেশি। আর বড়ো শিল্পের মালিক তথা ধনী গ্রাহকদের বিদ্যুতের খরচ কম হবে স্বাভাবিক অবস্থায়। ক্রস সাবসিডি ব্যবস্থা চালু থাকায় এতদিন ধনী গ্রাহককে বিদ্যুতের বেশি দাম যা দিতে হত তা গ্রামীণ কৃষক ও দরিদ্র জনতাকে ভর্তুকি দিতে কাজে লাগত। প্রথমেই এই বিলে কলমের এক খোঁচায় গরিবদের জন্য চলে আসা সমস্ত ভর্তুকিকে বাতিল করা হল। তারপর বলা হয়েছে স্টেট ইলেক্ট্রিসিটি রেগুলেটরি কমিশন বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করবে। এখানে ‘cost to serve’ কথাটি থেকে পরিষ্কার বর্তমানের তুলনায় আগামী দিনে গ্রাম ভারতে বিদ্যুতের দাম অনেক বেড়ে যাবে। সোজা কথায় কৃষি, গৃহস্থালি, শিল্প যে ক্ষেত্রেরই গ্রাহক হোক না কেন সেখানে বিদ্যুৎ পৌঁছাতে যে ব্যয় হবে তাই গ্রাহককে মেটাতে হবে। এই পলিসিতে গ্রামীণ মানুষকে বিদ্যুতের বেশি দাম দিতে হবে কারণ এদের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছাতে কোম্পানিগুলোর ব্যয় তুলনামূলক ভাবে বেশি। দীর্ঘ পরিবহণ ও বিতরণ (transmission and distribution) লাইন ও স্টেপ ডাউন ট্রান্সফরমারের জন্য পরিষেবা খরচ বেশি হয়। অন্যদিকে শিল্প গ্রাহকরা সোজাসুজি হাই টেনশন লাইন থেকে বিদ্যুৎ নেয় বলে নতুন আইনে তাদের কম দাম দিতে হবে।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে যে কৃষক ও গ্রামীণ জনতা এতদিন যে ভর্তুকি পেত তা কি উঠে যাচ্ছে? এখানেও সরকারের তরফে একটা চালাকি লুকিয়ে আছে। বিলে বলা হয়েছে যে, যদি কোন রাজ্য সরকার কোন একটি ক্ষেত্রের গ্রাহকদের সুবিধা দিতে চায় তবে তাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে সরাসরি টাকা দিতে হবে (direct benefit transfer)। এই প্রশ্নেও কৃষকরা বিরোধিতা করছেন। এই বিল অনুসারে রাজ্য সরকার প্রথমে যাদের ভর্তুকি দরকার তাদের চিহ্নিত করবে। কিন্তু যারা এই ভর্তুকি পাবে তাদের প্রথমে নিজের পয়সায় বিদ্যুতের বিল মিটিয়ে দিতে হবে। আর যদি সেটা সে না দিতে পারে তবে তার বিদ্যুৎ সংযোগ কেটে দেওয়া হবে। ইতিমধ্যেই ঋণভারে জর্জরিত ক্ষুদ্র কৃষক ও গ্রামীণ দরিদ্র জনতা এর ফলে আরো বিপদে পড়বেন। ভারতে রাজ্যগুলির বর্তমান আর্থিক অবস্থার দিকে নজর ফেরাই তাহলে গ্রাহকদের একটা বড়ো অংশের (কৃষক, শ্রমজীবী পরিবার, সরকারী স্কুল, হাসপাতাল, ক্ষুদ্র শিল্প) ভর্তুকি রাজ্য সরকারগুলি আদৌ দিতে পারবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন চিহ্ন উঠে যাবে। জিএসটি রাজ চালু হবার পরে সমস্ত রাজ্যের আয় কমে গেছে, কেন্দ্রীয় সরকার জিএসটি বাবদ রাজ্যগুলির প্রাপ্য টাকা দিতে পারছে না – এই অবস্থায় নির্দিষ্ট সময়ে ভর্তুকি পাওয়া অসম্ভব হয়ে উঠবে। এই বিষয়টি উপলব্ধি করে আজ বহু রাজ্য সরকারও এই বিলের বিরোধিতা করছে। এছাড়া ডাইরেক্ট বেনিফিট ট্রান্সফার (ডিবিটি) নীতির দুর্বলতা সর্বজনবিদিত। যে সমস্ত প্রকল্পে বেনিফিসিয়ারিকে চিহ্নিত করা সহজ (যেমন শিক্ষার্থীদের স্কলারশিপ) সেখানেও মাসের পর মাস টাকা বাকি থাকছে। রান্নার গ্যাসের ভর্তুকির পরিমাণ নিয়ে অজস্র অভিযোগ। বিদ্যুতের ক্ষেত্রে ডিবিটি চালু হলে একমাত্র যাদের নিজস্ব জমির দলিল আছে তারাই ভর্তুকি পাবে। যারা লিজে জমি নিয়ে চাষ করে বা ভাগচাষি তাদের ভর্তুকি পাওয়ার সুযোগ এই বিলে থাকছে না।

২০১৮-১৯ আর্থিক বর্ষে দেশে যত বিদ্যুৎ বিক্রি হয়েছিল তার মধ্যে ২২.৪% হয়েছিল কৃষিক্ষেত্রে। সে বছর দেশে বিদ্যুতের গড় দাম ছিল ৬.১৩ টাকা ইউনিট। যদি কৃষকেরা ভর্তুকি মূল্যে বিদ্যুৎ না পেত তাহলে কৃষকদের মেটাতে হত ১,৩২,০০০ কোটি টাকা। মনে রাখতে হবে নতুন ফর্মুলায় (cost to serve) ইউনিট প্রতি বিদ্যুতের দাম অনেক বেড়ে যাবে। তাই বিশেষজ্ঞদের মতে নতুন বিলে কৃষকদের অতিরিক্ত ১ লক্ষ কোটি টাকা মেটাতে হবে। যদি ধরেও নিই এর একটা অংশ দেরীতে হলেও কৃষকদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ভর্তুকি বাবদ ফেরত আসবে। তবুও চাষের খরচ অনেকটাই বেড়ে যাবে। যদি একজন কৃষক ৫ অশ্বশক্তি বিশিষ্ট পাম্প প্রতিদিন ৪ ঘন্টা হিসাবে সপ্তাহে দুদিন করে চালায় তবে তাকে বিল মেটাতে হবে ৩,০০০ টাকা যা বর্তমান সময়ের চেয়ে ৫০০% বেশি। যদিও রাজ্য ভেদে এই খরচের কিছু উনিশ–বিশ হবে তবে প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকদের উপর এই বিল ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলবে। ২০১৮-১৯ সালের আর্থিক বর্ষে ভর্তুকির ৫৫ শতাংশ ছিল ক্রস সাবসিডি ও ৪৫ শতাংশ গেছে সরাসরি ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিগুলোর ঘরে। যদি রাতারাতি এই ক্রস সাবসিডি তুলে দেওয়া হয় তাহলে রাজ্যগুলির আর্থিক স্থিতি ভেঙে পড়তে পারে। অনেকে বলার চেষ্টা করছেন বিদ্যুতের ভর্তুকিতে শুধুমাত্র ধনী কৃষকরাই উপকৃত হন এবং ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের ভাগে কিছুই জোটে না। কিন্তু সরকারি তথ্যে একথার সমর্থন মেলে না। যেমন অন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলেঙ্গনাতে ভূগর্ভস্থ জলের ৪০ শতাংশ প্রান্তিক কৃষকরা পায় যাদের জমির পরিমাণ এক হেক্টরের কম, ৫০ শতাংশ পায় ক্ষুদ্র ও মধ্য কৃষকরা। পঞ্জাব ও রাজস্থানে ৩০%-৪০% ভূগর্ভস্থ জল পায় সেই কৃষকরা যাদের জমির পরিমাণ ৪-১০ হেক্টর, আরো ৪০% পায় ক্ষুদ্র ও মধ্য কৃষকরা। বরং ভারতে কৃষি সমৃদ্ধ রাজ্যগুলিতে ক্যানেলের জলে বেশি অধিকার ধনী কৃষকদের।

সাম্প্রতিক সময়ে বিজেপি সরকার যে সমস্ত আইন লাগু করেছে তার একটা অন্যতম লক্ষ্য যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে দুর্বল করে কেন্দ্রীভূত শাসনের পথ প্রশস্ত করা। কৃষি আইন, নয়া শিক্ষানীতির মতো প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ বিলও তার ব্যতিক্রম নয়। সংবিধানে বিদ্যুৎ যুগ্ম তালিকায় আছে এবং গ্রাহকের ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়াটা রাজ্যের উপরেই  বর্তায়। কিন্তু প্রস্তাবিত বিলে বলা হয়েছে স্টেট ইলেক্ট্রিসিটি রেগুলেটরি কমিশন তৈরি করবে কেন্দ্র এবং এক্ষেত্রে রাজ্যের সম্মতি জরুরি নয়। একই ভাবে এই বিলে ‘electricity contract enforce authority’ বলে একটি সংস্থা তৈরির সুপারিশ করা হয়েছে যা আসলে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণকে আরো দৃঢ় করবে। এই প্রসঙ্গে একটি বহু আলোচিত কথার পুনরাবৃত্তি করতে চাই। ৯০’এর দশকে আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নি সংস্থাগুলির চাপে ভারতের শাসকশ্রেণি যে আর্থিক কর্মসূচী চালু করে তাতে বাকি ক্ষেত্রগুলির মতো বিদ্যুৎ ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ কমানো ও কর্পোরেট অনুপ্রবেশের পথ প্রশস্ত করার কর্মসূচী নেওয়া হয়। ২০০৩ সালে এই ব্যাপারে যে সংশোধন আনা হয় তাতে বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে উৎপাদন, বিতরণ, সংবহন, বাণিজ্যগুলিকে আলাদা করা ও বেসরকারি বিনিয়োগের পথ খোলা হয়। বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে কর্পোরেটকরণের সবচেয়ে বড়ো কর্মসূচী ছিল মহারাষ্ট্রের এনরন প্রকল্প যা নিয়ে দেশজোড়া বিতর্ক হয়। এরপর ২০১৪, ২০১৮-তেও নানান সংস্কার আনা হয়েছে। বর্তমান সংস্কার সেই ধারাবাহিকতারই অঙ্গ। বর্তমান নিবন্ধে আমরা কৃষির ক্ষেত্রে এই বিল কী সর্বনাশা প্রভার আনবে তা নিয়ে আলোচনা করলাম কিন্তু সামগ্রিক ভাবে বিদ্যুৎ বিলের জনবিরোধী চরিত্রকে উন্মোচিত করা দরকার।

- সুমনকল্যাণ মৌলিক    

খণ্ড-27
সংখ্যা-47