রাত্রিকালীন কার্ফ্যু এবং শূন্য পাকস্থলী
karfu

ছোটোবেলা থেকে দেখে আসছি বেশিক্ষণ খালি পেটে থাকলে বুক জ্বালা করে, গলার কাছে টকটক ভাব, মাঝে মাঝে বমির নামে শুধু জল উগরে আসে। মা বলে খালি পেটে থাকলে পিত্ত পড়ে যায়। আজকাল এই পিত্ত পড়ার পরিমাণটা একটু বেশিই দেখছি চারিদিকে। ইদানিং প্রায় ৯টার মধ্যেই আমাদের পাড়ার প্রায় বাড়ির আলো নিভে যাচ্ছে। ঘুমিয়ে পড়ছে সকলেই তাড়াতাড়ি। পাড়ায় আমার সুনাম বা বদনাম যে আমি ভোররাত পর্যন্ত জেগে থাকি। এই লকডাউন পর্যায়ে নানা জনের নানারকম আব্দারের সঙ্গে আরেকটা আব্দার জুড়ে গেছে, যেটা কার্যত এখন আমার দায়বদ্ধতাই বলা চলে, কাউকে রাত ১২টা, কাউকে বা রাত ১টা, আবার কাউকে ২টা ৩০ মিনিটে ডেকে দিতে হচ্ছে। কাউকে ফোন করে, আবার কারও বাড়িতে গিয়ে দরজা ধাক্কিয়ে জাগিয়ে দিয়ে আসছি। তারপর তারা কেউ টোটো নিয়ে, কেউ বন্ধুদের সঙ্গে চলে যাচ্ছে ফুল আনতে হাওড়া জগন্নাথ ঘাট, কেউ ধূলাগড় থেকে ফল নিয়ে আসছে, কেউ বৈদ্যবাটি বা তারকেশ্বর চলে যাচ্ছে কয়েকজন মিলে ছোটো হাতি ভাড়া করে নিয়ে আসছে সব্জি বা মাছ। যাতায়াতের পথে পুলিশের হাতে গুঁজে দিতে হচ্ছে কোথাও ৫০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত। রাত ১টার পর থেকে জিটি রোড জুড়ে টোটো আর গাড়ির সারি, তার সাথে পাল্লা দিয়ে পুলিশেরও পকেট ভারি হচ্ছে।

সকাল ৭টার মধ্যে ফিরেই বিক্রি করে ফেলতে হবে সব জিনিস ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে। নাহলে আবার এলাকার পুলিশের হাঙ্গামা, মারধর, তোলাবাজি। যতটা বিক্রি হয় হল, যা বাঁচল তার অধিকাংশই এই গরমে নষ্ট হচ্ছে, রাখার মতো ব্যবস্থা নেই। প্রত্যেকটা দিন এইভাবে পরিবারগুলোর যাপনের চাকা ঘুরছে ! টিকে থাকতে হবে তো!

আমাদের পাড়ার অধিকাংশই এই লকডাউনে পেটের লকডাউনের বিরুদ্ধে লড়তে বেছে নিয়েছে এই পথ। এই মানুষগুলোর পেটে যে চরা পড়েছে সেখানে রাত্রিকালীন ‘কার্ফ্যু’র কারণে পেটে চরা দীর্ঘতর আর স্থায়ী হতে থাকবে। কেউ কেউ বেঁচে থাকার আকুতি নিয়ে আবার সওয়ার হবে রাতের রাস্তায়; যে পুলিশ এতদিন ৫০ চাইত সে হয়তো এবার ‘কার্ফ্যু’র ভয় দেখিয়ে ১০০০ চাইবে; যে ১০০০ চাইত, সে হয়তো আরও বেশী চাইবে। পেটের জ্বালায় এরপরে যদি কেউ আবারও রাস্তায় বের হতে মরিয়া হয় তখন দাগিয়ে দেওয়া হবে ‘আইন-শৃঙ্খলা মানছে না’, নেওয়া হবে কড়া ব্যবস্থা ! কোনো দল আবার ‘দেশদ্রোহী’ তকমা সেঁটে দিতে পারে। শাসক যখন আর্তি কানে তোলে না, তখনই তো হারবার্টদের সশব্দে ফেটে জানান দিতে হয় চুল্লিতে ভাত না ফুটলে শাসককে ফোটানো হবে।

– নীলাশিস বসু

খণ্ড-27