বৈষম্য ও বঞ্চনার পলিসি
der

ঘরে ফেরা পরিযায়ী শ্রমিকদের জীবিকায় পুনর্বাসন দেওয়ার প্রশ্নে মোদী সরকার ঘোষণা করল একটা প্যাকেজ প্রকল্প। নাম দেওয়া হয়েছে ‘গরিব কল্যাণ রোজগার যোজনা’। ১২৫ দিনের প্রকল্প। কোভিড সংক্রমণ আর লক ডাউনে তিন মাস যাবত কাজ হারানো, বেতন না পাওয়া এবং কোনরকম সরকারী অনুদান না পাওয়া শ্রমিকদের জন্য অগত্যা ঘোষণা হল চার মাসের মতো কাজের ব্যবস্থা করা হবে। প্যাকেজ ৫০ হাজার কোটি টাকার। যোজনার তালিকাভুক্ত ধরা হয়েছে ছয়টি রাজ্যের ১১৬টি জেলাকে। মাপকাঠি করা হয়েছে ফিরে আসা পরিযায়ী শ্রমিক সংখ্যা যেখানে ২৫ হাজারের ওপর, প্রকল্পের আওতায় আসবে কেবল সেইসব জেলা। কর্মসংস্থানের মোট আনুমানিক লক্ষ্যমাত্রা হতে পারে ৩০ লক্ষাধিক। এই পরিকল্পনা গ্রামীণ ক্ষেত্র ভিত্তিক, থাকবে ২৫ রকমের কাজ, যা কেন্দ্রের ১২টি মন্ত্রকের যেমন জল সংরক্ষণ থেকে ইন্টারনেট পরিষেবা, সড়ক নির্মাণ থেকে রেল, টেলিকম ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকল্প রূপায়ণের অঙ্গ। স্বীকৃতি পাওয়া ছয়টি রাজ্যের মধ্যে রয়েছে বিহার, উত্তরপ্রদেশ, ওড়িশা, ঝাড়খন্ড, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থান। তালিকায় পশ্চিমবাংলার নাম নেই। তাজ্জবই লাগার কথা। যে রাজ্যের পরিযায়ী শ্রমিকদের ফেরানো নিয়ে কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাত হল সবচেয়ে বেশি সেই রাজ্যের নাম কেন্দ্রের তৈরি কর্মসংস্থানে পুনর্বাসনের রাজ্য তালিকায় নেই! দেশের আজকের পরিস্থিতিতে শ্রমশক্তি পরিযায়ী হয় মূলত পূর্ব ও উত্তর ভারতের কয়েকটি রাজ্য থেকে, যার অন্যতম পশ্চিমবঙ্গ। বিহারে ফিরে আসা পরিযায়ী শ্রমিক সংখ্যা ২০ লক্ষাধিক, তালিকায় থাকা বাকি রাজ্যগুলির সংখ্যাও নিশ্চয় বিপুল; পশ্চিমবঙ্গের ফিরে আসা সংখ্যাটিও যথেষ্ট, ১১ লক্ষাধিক, এবং কেন্দ্রের ঘোষিত মানদন্ড অনুসারে প্রকল্পটির আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত ছিল একনজরে  গণ্য করলে এরাজ্যের অন্তত ছয়টি জেলাকে। উত্তরবঙ্গের কোচবিহার, মালদা; দক্ষিণবঙ্গের মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, পুরুলিয়া ও দক্ষিণ ২৪ পরগণা। কিন্তু তা করা হল না। আরও একবার বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার বানানো হল বাংলাকে, বাংলার জেলাগুলির হাজার হাজার ঘরে ফেরা গ্রামীণ গরিব পরিযায়ী শ্রমজীবীদের। এই অসদাচরণ করে ছাড়তে কেন্দ্র ও বিজেপি সাফাই গাইছে, তৃণমূল সরকার ফিরে আসা পরিযায়ী শ্রমিকদের জেলাওয়ারী তথ্য পরিসংখ্যান পাঠায়নি, তাই এরাজ্য বাদ থেকে গেছে। কথা হল, রাজ্য না হয় গাফিলতি দেখিয়েছে, কিন্তু কেন্দ্র আগ্রহ দেখিয়েছে কতটা? কোভিড মোকাবিলার প্রশ্ন তুলে কেন্দ্র যেভাবে হস্তক্ষেপের ঝড় তুলেছিল, তার কণামাত্র নমুনা কি পরিযায়ীদের এককালীন আর্থিক অনুদানের নিরন্তর দাবি ওঠা সত্ত্বেও দেখিয়েছে? কেন্দ্রের কাছে ট্রেনে ফেরানোর মোট সংখ্যাগত হিসাবও ছিল, ক’বার জেলা ভিত্তিক তালিকা চেয়ে পাঠিয়েছে? প্রত্যুত্তর দেওয়ার মুখ আছে বিজেপির?

বৈষম্য ও বঞ্চনার এই বিষয়টিকে বাংলার ‘বিশেষ থেকে সার্বিক’ সারা ভারতের প্রশ্ন হিসাবেও তোলা প্রয়োজন। প্রথমত, পঁচিশ হাজার শ্রমিকের বাধ্যতামূলক সীমার শর্ত চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে কেন? কোন ‘যুক্তি’তে এটা নির্দ্ধারিত হল? এবিষয়ে কি রাজ্যগুলোর মতামত নেওয়া হয়েছে? বাকি পরিযায়ী শ্রমিকদের জীবিকার সংস্থান পরিত্যক্ত হয়ে থাকবেন কেন? এই পলিসির মধ্যে নতুন এক বিপদ ডেকে নিয়ে আসার অশনি সংকেত থাকছে। অবশ্যম্ভাবীভাবে পরিযায়ী শ্রমিকদের নতুন এক ধরনের বৈষম্য-বঞ্চনা তো বটেই, পরন্তু বিদ্বেষ-বিভাজনের রাজনীতির বা দলাদলি-দ্বন্দ্ব-সংঘাতের শিকার করে তুলবে। মোদী সরকার মুখোশ আর মুখ আবারও উন্মোচিত হচ্ছে। মোদী প্রায়শ বলেন, ’সবকা সাথ, সবকা বিকাশ, সবকা বিশওয়াস’। আর মোদী সরকারের পলিসি আচরণ ঠিক বিপরীত, বৈষম্য ও বঞ্চনা চালিয়ে যাওয়া। মোদী বলেন, ‘প্রতিযোগিতামূলক জনকল্যাণবাদ, যুক্তরাষ্ট্রবাদ’ অনুশীলনের কথা, আর মোদী সরকার অনুসরণ করছে একদিকে দেশ বেচার, অন্যদিকে কেন্দ্রের মর্জিমাফিক ছকে দেওয়া কিছু অস্থায়ী জীবিকার দুমুখো পলিসি। আর ‘যুক্তরাষ্ট্রীয়তাকে আমল দিচ্ছে’ কেবল কেন্দ্রকে শক্তিশালী করার জিগির তুলে কেন্দ্রের হাতে ক্ষমতার লাগাতার অতিকেন্দ্রীকরণ করে চলে, একইসাথে পক্ষে থাকা রাজ্যগুলোর প্রতি পক্ষপাতিত্ব এবং বিপক্ষে থাকা রাজ্যগুলোর ওপর ছড়ি ঘুরিয়ে।

খণ্ড-27