ভারত ও চীনকে লাদাখে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখায় উদ্ভূত সংঘাত তথাঅচলাবস্থার সমাধান কূটনৈতিক উপায়েই করতে হবে
deplo

লাদাখে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর গালোয়ান উপত্যকা অঞ্চলে ভারত ও চীনা সেনাদের মধ্যে সংঘর্ষ দুই প্রতিবেশীর মধ্যে এক নতুন বিস্ফোরক পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে। ১৯৭৫ সালের পর এটাই ভারত ও চীনের মধ্যে সীমান্ত অঞ্চলে খণ্ডযুদ্ধের প্রথম বড় ঘটনা। উভয় পক্ষেই হতাহতের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলায় এই সংঘর্ষ ১৯৬৭ সালে সিকিম সীমান্তে নাথু লা ও চো লা অঞ্চলে ১১-১৪ সেপ্টেম্বর ও ১ অক্টোবরের সংঘর্ষের পর সবচেয়ে বড় আকারের রক্তক্ষয়ী সংঘাত হয়ে দেখা দিয়েছে।

লাদাখের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখায় দুই পক্ষের মধ্যে সংঘাত তথা অচলাবস্থার সংবাদ কয়েক সপ্তাহ ধরেই প্রকাশ্যে আসছে। বাস্তব ক্ষেত্রে দু-পক্ষের সেনাদের মধ্যে চলা উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের ভিডিও ইন্টারনেটে ভাইরাল হয়েছে। প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রের বিশ্লেষকরা চীনা সেনাদের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা পেরিয়ে ভারতের দিকে ঢুকে আসার কথা জানাচ্ছিলেন, যে অনুপ্রবেশের ফলে ভারতকে গালোয়ান উপত্যকায় ষাট বর্গ কিলোমিটার এলাকার ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে হয়েছে। মোদী সরকার কিন্তু এই রিপোর্টগুলোর কোনোটাকেই সরকারীভাবে স্বীকার তো করেইনি, উল্টে বলে এসেছে যে উত্তেজনা প্রশমন নিয়ে কথাবার্তা চলছে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

ভারতীয় সেনার তরফে প্রাথমিকভাবে দেওয়া ১৬ জুনের বিবৃতিতে তিন জওয়ানের মৃত্যুর কথা স্বীকার করা হয় – কর্ণেল সন্তোষ বাবু, হাবিলদার কে পালানি এবং সিপাই কুন্দন ওঝা। এরপর নিহতের সংখ্যা কুড়িতে পৌঁছেছে বলে আমাদের জানানো হয় – যার মধ্যে গুরুতর আহত ১৭ জন শূন্য ডিগ্ৰির নীচের তাপমাত্রায় প্রবল ঠাণ্ডার কারণে মারা যান। কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রকৃত পরিস্থিতি অস্বীকার করে আসার ব্যাপারটা অবশেষে একেবারে কুড়ি জনের নিহত হওয়ার মর্মান্তিক স্বীকৃতিতে পরিণত হল। চীনের পক্ষে কতজন নিহত হয়েছে সে কথা অবশ্য চীন সুস্পষ্টভাবে জানায়নি। ভারতীয় সেনাদের সম্পর্কে আরও যা সরকারীভাবে আমাদের জানানো হয়নি তা হল, কতজন আহত সেনার চিকিৎসা চলছে এবং কোন সেনা চীনাদের হাতে বন্দী হয়ে আছে কিনা।

বিরোধী পক্ষে থাকার সময় বিজেপি মনমোহন সরকারের বিদেশ নীতিকে দুর্বল বলে চড়া পর্দায় তার সমালোচনা করত। আর এখন মোদী সরকার প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখায় বর্তমান পর্যায়ের সংঘাতময় পরিস্থিতিকে গোপন করা ও এড়িয়ে চলার যে নিদর্শন রাখল তা ওপরে ব্যক্ত প্রতিক্রিয়ার সম্পূর্ণ বিপরীত। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে পুলওয়ামা-বালাকোট উপাখ্যানে মোদী সরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যেভাবে গলা চড়িয়েছিল এবং আগ্ৰাসী হাবভাব দেখিয়েছিল, এবারের প্রতিক্রিয়া প্রকটভাবেই তার সম্পূর্ণ বিপরীত হয়েই দেখা দিচ্ছে। এর সঙ্গে সার্কভুক্ত কার্যত সমস্ত দেশের সঙ্গেই, আফগানিস্তান থেকে পাকিস্তান থেকে নেপাল, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের অবনতির কথা ধরলে, চীনের সঙ্গে এই সংঘাত বিদেশ নীতির ক্ষেত্রে মোদী সরকারের বড় ধরনের সংকটকেই প্রতিপন্ন করছে।

indo
ফটো সংগৃহীত

 

চীন ও ভারতের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে গেলে তা দু-দেশের কাছে সর্বদাই বিপর্যয় ঘনিয়ে তুলবে। কোভিড-১৯ মহামারী এবং বিপুল অর্থনৈতিক মন্দার বর্তমান পরিস্থিতিতে সংঘর্ষ বাধলে তা ভারতের কাছে বিভীষিকাময় হয়েই দেখা দেবে। এই সম্ভাবনা এতটাই প্রকট যে তা আমাদের ভাবনায় ধরা না দিয়ে পারে না। যেদিন কুড়ি জন সেনাকে হারানোর খবর এল, সেদিনই আবার এল কোভিড-১৯ রোগীদের একদিনে সবচেয়ে বেশি সংখ্যকের মৃত্যু সংবাদ। মাত্র একদিনে ২০০০-এর বেশি রোগীর মৃত্যু ১৬ জুনকে অবশ্যই ভয়াবহ মঙ্গলবার করে তুলেছিল।

দু-দেশের সরকারের মধ্যে আন্তরিক কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মধ্যে দিয়েই সংঘাত তথা অচলাবস্থার অবসান ঘটাতে হবে। ভারতের সমস্ত প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে নরেন্দ্র মোদীই সবচেয়ে বেশি বার চীন সফর করেছেন, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাঁচ বার এবং তার আগে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে চার বার। প্রতিবারের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তিনি চীনা প্রেসিডেন্ট শি শিনফিং-এর সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সৌহার্দ্যকে জাহির করার চেষ্টা করেছেন। চীন ভারতীয় বাণিজ্যের সবচেয়ে বড় শরিক হওয়ায় দু-দেশের মধ্যে জড়িয়ে থাকা অর্থনৈতিক স্বার্থের পরিমাণও যথেষ্ট। কোভিড-১৯ নিয়ে ট্রাম্প তত্ত্বের পুনরাবৃত্তি করা অথবা চীনা পণ্য বয়কটের ডাক দিয়ে উগ্ৰ চীন-বিরোধী জিগির উস্কিয়ে তোলার চেয়ে ভারতের বিদেশ নীতির সাফল্যের প্রকৃত পরীক্ষাটা রয়েছে চীনের সঙ্গে দ্রুত ও সম্মানজনক কূটনৈতিক সমাধানে পৌঁছতে পারার মধ্যে। মোদী দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০১৪ সালে ক্ষমতায় এসেছিলেন, কিন্তু মোদীর শাসনাধীনে অর্থনীতির ক্রমাবনতি হয়ে চলেছে। নিজের “বিশ্ব নেতার” তথাকথিত ভাবমূর্তিকে ধরেই মোদী ২০১৯ সালে তাঁর প্রচারকে চালিয়েছিলেন।

‘হাউডি মোদী’ ও ‘নমস্তে ট্রাম্প’-এর লোকদেখানো দৃশ্যকে ছাড়িয়ে লাদাখে সংঘাত তথা অচলাবস্থার  সমাধানই মোদীর বিদেশ নীতির সাফল্যের সামনে সবচেয়ে বড় প্রশ্নচিহ্ন হয়ে রয়েছে।

(এমএল আপডেট সম্পাদকীয় ১৬ জুন ২০২০) 

খণ্ড-27