কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ে খামখেয়ালিপনা বন্ধ কর
coll

ভারতবর্ষে অবৈতনিক শিক্ষার  অধিকার সার্বজনীন ভাবে আদৌ স্বীকৃত না হলেও বিনা বেতনে শিক্ষার্থীদের সংশয়, উদ্বেগ ও আতঙ্ক বিতরণের ব্যবস্থা করতে পুরোদস্তুর সক্ষম শাসকগোষ্ঠী। সব সামাজিক অবস্থার ছাত্রছাত্রীদেরকে শিক্ষাঙ্গনে টেনে আনা নয় বরং কত বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থীকে শিক্ষাঙ্গন থেকে ছেঁটে ফেলা যায় নানা ছুঁতোনাতায় তার ছক প্রতিনিয়ত কষে চলে ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থার মাথারা। নইলে খেলার শাটল কক হিসাবে কেনই বা ছাত্রছাত্রীদেরকে বেছে নেয় সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)? চলতি করোনা সংক্রমণ ও লকডাউনের অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে অনেক ব্যতিক্রমী ও নজিরবিহীন সিদ্ধান্তই নেওয়া হচ্ছে সমাজের সর্বস্তরে সর্বক্ষেত্রে। তারই গতিতে গত ২৯ এপ্রিল প্রকাশিত এক গাইডলাইনে ইউজিসি জানায় যে, দেশের সমস্ত কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইনাল ইয়ার/সেমেস্টারের পরীক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা যাবে ৮০%/২০% পদ্ধতিতে অর্থাৎ এই পরিস্থিতিতে পরীক্ষাকেন্দ্রে গিয়ে কাগজে-কলমে পরীক্ষা দেওয়া কার্যত অসম্ভব তাই পরীক্ষার্থীদেরকে মূল্যায়নের ৮০% নম্বর দেওয়া হবে তাদের দেওয়া বিগত বর্ষ/সেমেস্টারগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ পাওয়া মার্কসের ভিত্তিতে আর বাকি ২০% দেওয়া হবে অভ্যন্তরীণ মূল্যায়ন ব্যবস্থা থেকে। কিন্তু মোদী সরকার তো ভারতবর্ষের শ্রমিক, কৃষক, মহিলা, ছাত্র-যুব ইত্যাদির মতো দেশ গঠনের স্তম্ভগুলোকে বরাবরই মারণ ঝটকা দেওয়াটাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে! কোভিড মোকাবিলার পরীক্ষায় সবদিক থেকেই চূড়ান্ত ব্যর্থ অপদার্থ মোদী সরকার নিজে তাই এখন ছাত্রসমাজকে পরীক্ষার ‘গুরুত্ব’ বোঝানোর মাস্টারি শুরু করেছে।

guri

 

গত ৬ জুলাই বিকালে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক হঠাৎই মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের পরামর্শক্রমে সব বিশ্ববিদ্যালয়কে পরীক্ষা নেওয়ার ‘ছাড়পত্র’ ঘোষণা করলো। সীমান্তের গুরুগম্ভীর আওয়াজেও যখন আর মানুষের চমক লাগছেনা তখন নতুন কোনো ধামাকা না করে কিভাবে টিকতে পারে এই সরকার, তাই লাগাও ফরমান। অমনি এই ‘ছাড়পত্র’কে হাতিয়ার করে মাঠে নেমে পড়লো ইউজিসি। জারি হয়ে গেল সর্বনেশে গাইডলাইন, যাতে ঢালা হল প্রচুর নীতিবাক্য -- হাতে-কলমে পরীক্ষা না নিয়ে চূড়ান্ত বর্ষের/সেমেস্টারের ছাত্রছাত্রীদের নাকি প্রমোট করানো বড়ই ভুল; পরীক্ষা দিলেই নাকি ছাত্রছাত্রীরা একমাত্র আত্মবিশ্বাস পায়। তাই স্নাতক স্তরের ফাইনাল ইয়ার/সেমেস্টারের পরীক্ষা সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে নিতেই হবে এবং প্রয়োজনে অনলাইন + অফলাইন জগাখিচুড়ি পদ্ধতিতেই পরীক্ষা নিতে হবে। ‘ম্যাজিশিয়ান’ সরকারের কোনও এক মন্ত্রবলে কিছুদিন আগেই আইসিএমআর বলে দিয়েছিল, ১৫ আগস্টের পুণ্য প্রভাতেই নাকি ভারতে উদয় হতে চলেছে করোনার ভ্যাকসিন! পরবর্তীতে বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকদের রীতিমতো সোচ্চার প্রতিবাদে এমন সময় বেঁধে অবৈজ্ঞানিক ও অযৌক্তিক ভবিষ্যদ্বাণী গোছের অদ্ভুতুড়ে দাবি থেকে সরে আসতে বাধ্য হয় তারা।

এরকমই কোনো মন্ত্রবলে কি মোদী সরকার ও ইউজিসি কোনো ‘স্বপ্নাদেশ’ পেয়েছে যাতে তারা সেপ্টেম্বরের মধ্যে করোনামুক্ত ভারত গঠনের সম্ভাবনা দেখছে? নাহলে যে স্বাস্থ্য সংকটের কারণে মন্ত্রী, সাংসদ, বিধায়কদের প্রাণ সংশয় থেকে বাঁচাতে ১০০ দিনের উপর বন্ধ থাকে পার্লামেন্ট সেই একই ঝুঁকির মধ্যে কিভাবে ছাত্রছাত্রীদেরকে পরীক্ষা দিতে ঠেলে দেওয়া যায়? কোনো মানবিক, বিবেচক সরকার ও শিক্ষা ব্যবস্থা এটা করতে পারে? তারা কি ধরেই নিয়েছে যে ভারতবর্ষের কোটি কোটি পরনে একটা চলনসই পোষাক না জুটলেও ছাত্রছাত্রীরা সবাই করোনাপ্রুফ জ্যাকেট পরে বসে আছে? নাকি অগ্রাধিকার দিয়ে মদের দোকান খুলে দেওয়া সরকার গোটা ছাত্র-যুব সমাজকে পেটের ভিতর থেকে আপাদমস্তক অ্যালকোহলিক করে ‘স্যানিটাইজড শরীর’ তৈরির কোনো অলীক স্বপ্ন দেখছে? যে দেশের মোটের উপর মাত্র ৪০% (IAMAI) ও নিয়েলসনের ‘ডিজিটাল ইন ইন্ডিয়া’ সমীক্ষা, ২০১৯-এর রিপোর্ট অনুসারে) মানুষের কাছে ইন্টারনেট সংযোগ লভ্য সেখানে কোন যুক্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের একই স্তরের পরীক্ষা ভিন্ন ভিন্ন মাধ্যমে নেওয়া চলতে পারে? পরিষ্কার ভাবেই এটা একটা ডিজিটাল বৈষম্যকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করে দেওয়ার চক্রান্ত!

asa

 

এই তুঘলকি গাইডলাইনের বিরুদ্ধে ব্যপকভাবে ফুঁসছে আসমুদ্র-হিমাচল ছাত্রসমাজ অথচ আরএসএস-বিজেপির ছাত্রশাখা এবিভিপি এই ছাত্রস্বার্থ-বিরোধী গাইডলাইনকে স্বাগত জানিয়েছে! আইসার মতো ছাত্র সংগঠন গোটা দেশ জুড়েই ইতিমধ্যে এই গাইডলাইনের কপি জ্বালিয়ে জোরালো ভাবে সংগঠিত করেছে প্রতিবাদ দিবস। পশ্চিমবঙ্গ সহ বেশ কয়েকটি রাজ্য সরকার ইতিমধ্যেই ইউজিসিকে চিঠিপত্র দিয়ে এই গাইডলাইনের প্রতি আপত্তি জানিয়ে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আবেদন জানিয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। যে সরকার নিজে সব বিষয়েই পরীক্ষা দিতে ফাঁকিবাজি করে সেই কিনা আজ দেশের ছাত্রসমাজকে ‘পরীক্ষায় ভীত’, ‘ফাঁকিবাজ’ ইত্যাদি বলে অপমান করতে উদ্যত। এই অবস্থায় যদি সরকার ও ইউজিসি শিক্ষার্থীদের জীবনের গ্যারান্টি দিতে না পারে তাহলে শিক্ষার্থীরা তাদের জীবন ও ভবিষ্যত নিয়ে তামাশাবাজ এই শাসককে সহবৎ শেখানোর গ্যারান্টি দিতেই পারে।

- সৌরভ  

খণ্ড-27