আইসা আন্দোলনের ৩০ বছর
eeee

আইসা বা সিপিআই(এমএল) লিবারেশন নয়, এই ঘরানার রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর মধ্যে জীবনে প্রথম নাম শুনেছিলাম আইপিএফ-এর। তাও সিপিআই(এম)-এর পত্রিকায়। তখন আমি স্কুলে। তখনও আইসা জন্মায়নি। সিপিএমের ‘দা মার্ক্সিস্ট’ বলে একটা পত্রিকা বাড়িতে আসত, সেখানে। তখন উৎসাহ প্রচুর ছিল, কিন্তু ইংরেজি বিদ্যে ঢুঢু। মার্কসবাদী নানা লব্জ, সম্পূর্ণ অচেনা লাগত। যেমন শভিনিজম শব্দটার সঙ্গে প্রথম পরিচয় ওই পত্রিকাতেই, অভিধান দেখে মানেটা বোঝা গিয়েছিল, কিন্তু দীর্ঘদিন পর্যন্ত বানান দেখে উচ্চারণ করতাম চাউভিনিজম। এই বিদ্যে নিয়েই টুকটাক পড়াশুনো। এসব কেন ইংরেজিতে ছাপা হয়, সে নিয়ে তখনও প্রশ্ন জাগত, এখনও জাগে। নইলে আদ্যন্ত বাংলা মিডিয়াম আমার পড়াশুনোয় কিছু সুবিধে হত।

তা, ওই পত্রিকাতেই আইপিএফ-এর কথা জানা। কার লেখা মনে নেই। প্রচুর সমালোচনা ছিল। কিন্তু এ সংগঠন দ্রুত বাড়ছে, রণবীর সেনাকে টক্কর দেয়, এবং অস্ত্র হাতে লোকজনকে ভোটের লাইনে দাঁড় করায়, এইসব পড়ে খুব আগ্রহ জেগেছিল। বিহারকে তখন জঙ্গলের রাজত্ব মনে করা হত। থেকে থেকেই গণহত্যার খবর আসে। তার মধ্যে যারা লড়ে যাচ্ছে, তাদের প্রতি ১৬-১৭ বছর বয়সে সম্ভ্রম জন্মাবেই। এরই মধ্যে আজকালে খবর আসে ২২ এপ্রিল আইপিএফ-এর মাতৃরূপী সংগঠন লিবারেশন প্রকাশ্যে আসছে। জনসভা হবে এসপ্ল্যানেড ইস্টে। একই দিনে আরেকটা জনসভা ছিল শহীদ মিনারেও। গদরের আসার কথা। আমি তখন সিঙ্গুরে থাকি। তখনও স্কুলেই। লাফ মেরে ট্রেনে করে হাওড়া হয়ে সোজা এসপ্ল্যানেডে। কাউকে চিনতাম না। তাই একা একা। এসপ্ল্যানেডে তার আগে কোনোদিন গেছি বলে মনে পড়ে না, একা তো নয়ই।

এর বছর খানেকের মধ্যেই কলেজে। হাওড়ার কলেজ। হস্টেল। ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে পরিচয়। যোগ দিতে কিছুদিন সময় লেগেছিল। কয়েকদিনের মধ্যেই খবর আসে হিন্দি বলয় কাঁপাচ্ছে আইসা। জেএনইউ-তে জয়ী। একই সঙ্গে জয়ী বিএইচইউ এবং এলাবাহাদ ইউনিভার্সিটিতে। জয়ী ছাত্র সংসদের প্রতিনিধিরা কলকাতা এসেছিলেন কেউ কেউ। দেখা সাক্ষাৎও হয়। আইপিএফ-এর মতো আইসারও যে ব্যাপারটা চমৎকার লেগেছিল, তা হল দ্রুত বৃদ্ধি। তখন নব্বইয়ের শুরু। বাংলার সংস্কৃতিতে নতুন জোয়ার। সুমন চট্টোপাধ্যায় ফাটিয়ে গান গাইছেন। করন্দায় পাঁচজন খেতমজুর খুন হলেন, রক্ত উথলিয়ে সুমন গান ধরলেন, “মাঝ রাত্তিরে চাঁদের কাস্তে, ধারালো হচ্ছে আস্তে আস্তে”। সুমনের ওই অননুকরণীয় “আস্তে আস্তে” উচ্চারণ এখনও কানে লেগে আছে। সঙ্গে একদিকে চলছে কানোরিয়া আন্দোলন, অন্যদিকে তরুণ গায়করা বন্দীমুক্তির স্বপক্ষে গান গাইছেন। প্রেসিডেন্সিতে এরকমই এক অনুষ্ঠানে এক মহিলার গান শুনলাম, কী জোরালো গলা, ঠিক যেন জোন বেজ। তাঁর নাম, জানা গেল, মৌসুমী ভৌমিক। আরেকটা অনুষ্ঠানে দু-তিনটি ছেলে মঞ্চে উঠে দুদ্দাড় কী একটা যেন গেয়ে দিল। তাদের গ্রুপটারও নাম অদ্ভুত। চন্দ্রবিন্দু।

olld

 

চতুর্দিকে নতুন এক উত্থান। এরই মধ্যে বিহারের খবর আসে। লড়াই চলছে। বাম কনফেডারেশনের কথা ভাবা হচ্ছে। এবং সবচেয়ে আকর্ষণীয় যেটা, দ্রুত বদলের কথা ভাবা হচ্ছে। শুধু বাম নয়, নীতিশ কুমার নামক এক ভদ্রলোক এক সংগঠন গড়েছেন, তাঁদের জনভিত্তি আছে, সেই সংগঠনের সঙ্গে যৌথভাবে নির্বাচন লড়া হবে। জেতা যাবে কিনা জানা নেই, কিন্তু জরুরি যেটা, সেটা হল, বড় করে ভাবা হচ্ছে। স্বপ্ন দেখা হচ্ছে।

পশ্চিমবঙ্গে অবশ্য আমরা খুব কিছু করে ফেলেছিলাম এমন নয়। কাজের মধ্যে সাউথ সিটি কলেজে লিফলেট দিতে গিয়ে এসএফআই-এর হাতে মার খেয়ে এসেছিলাম। পলিটেকনিক কলেজের ছাত্রদের নিয়ে একটা সংগঠন প্রায় বানিয়েই ফেলাই হয়েছিল, কিন্তু ওই প্রায় অবধিই। পলিটেকনিকের ছাত্ররা আন্দোলন করেছিল ঠিকই, কিন্তু আমাদের বাদ দিয়ে। যাদবপুর এপিসি পলিটেকনিকের ছাত্র সংসদে অবশ্য জেতা গিয়েছিল। বার দুই জেএনইউ মডেলে আস্ত প্যানেল বানিয়ে ভোটে দাঁড়িয়েছিলাম নিজের কলেজে, কিন্তু সদলবলে পর্যুদস্ত। কলেজে তখন কার্টুন-দেওয়া পোস্টার খুব চলত। ছাত্রপরিষদ আইসাকে নিয়ে চিমটি কাটতে হলে একটা মেয়ের ছবি এঁকে নিচে আয়েষা লিখে কার্টুন আঁকত, মনে আছে। তখন বাবরি মসজিদ ভেঙে গেছে। কিন্তু, ভাবলে আশ্চর্য লাগে, আয়েষা নামের কোনো সাম্প্রদায়িক অভিমুখ ছিল না। থাকতে পারে, ভাবাটাই অসম্ভব ছিল। দিনকাল সম্পূর্ণ আলাদা ছিল।

বছর তিরিশেক পরে, ঘুরে দাঁড়িয়ে সময়টাকে দেখলে, এই কথাটাই মনে পড়ে। দিনকালটাই অন্য ছিল। ফেসবুক ছিলনা, মোবাইল ফোন ছিল না, এমনকি সাধারণ ফোন, যাকে এখন ল্যান্ডলাইন বলা হয়, তাও যৎসামান্য। প্রতিটি মিটিং-এর শেষে পরের মিটিং এর দিনক্ষণ ঠিক হত। কেউ বাদ গেলে তার বাড়ি গিয়ে খবর দিয়ে আসতে হত। সেও ছিল এক উৎসব। এসব খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু যে ব্যাপারটা চোখে লাগে, তা হল দক্ষিণপন্থার উত্থান এবং তা ঘিরে যুবসমাজের একটা বড় অংশের উন্মাদনা। এই উদ্দীপনা একদা আমাদের অভিজ্ঞান ছিল। জেতা-হারা বড় কথা নয়। বদলে দেবার ইচ্ছে যাদের হত, তারা তখন বাঁ দিকেই ঝুঁকত, হার-জিতের তোয়াক্কা না করে। শুধু তথাকথিত বিপ্লবীরা নয়, ছোট্টো বৃত্তে সে এখনও ঝোঁকে, গ্রাম-গঞ্জ-মফঃস্বলের ছেলেমেয়েরা, যারা ঝা-চকচকে নয়, যাদের ইংরিজি পড়তে অসুবিধে হয়। আমি নিজেই যার অব্যর্থ উদাহরণ। এই তিরিশ বছর পরে, দুনিয়া সম্পূর্ণ বদলে গেছে, আমিও। রাজনৈতিক চিন্তাভাবনাও বদলেছে। তবু যদি কেউ প্রশ্ন করে, সেই সময়ের কোন জিনিসটা ফেরত চাই, নিঃসন্দেহে, সেটা হল গ্রাম-গঞ্জ-মফঃস্বলের বাংলাপড়া ছেলেমেয়েদের দুনিয়া বদলে দেবার উদ্দীপনা। রাজনৈতিক কম্পাসের ডানদিকে এভাবে হেলে পড়া আর নেওয়া যায় না।

--  সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায়  

ais

 

aees

সময়টা সিপিএমের দীর্ঘ শাসনকালের শেষ দিকের সেই উদ্ধত জামানা। ঔদ্ধত্যর আঁচ গায়ে বাজছিল বাংলার বৃহত্তর ছাত্র সমাজে। অধিকার হরণের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল ছাত্র সমাজ। সময়ের দাবিতে কলকাতার আইসা নেতানেত্রীদের সাথে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল আমার মতো বহু ছাত্রছাত্রীর – বগুলা, বহিরগাছি, তারক নগর এলাকাকে আলোড়িত করে শুরু হয়েছিল ছাত্র-যুব আন্দোলন। কলকাতা-বগুলা একাত্ম হয়ে গড়ে ওঠে এক বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের প্রয়াস। পরবর্তীতে কলকাতার আরও কমরেডদের যাতায়াতের মধ্যে দিয়ে তার ব্যাপকতা বাড়ে। আমাদের নতুন পথের দিশা দেখায়। অজানা কথা, কত মানুষের আত্মত্যাগের কাহিনী আমাদের উৎসাহিত করে, বাধভাঙ্গা উৎসাহে পৌঁছে যাই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। ‘মহিনের ঘোড়াগুলি’র গানে নতুন মাত্রা আনে। সবাই মিলে চিৎকার করে গাইতে থাকি ‘কথা দিয়া বন্ধু ফিরা না আইলা ...’ আরও কতো। লাস্ট ট্রেনে কমরেডদের রিসিভ করে প্রায় মধ্য রাতে চিৎকার করে সবাই মিলে গাইতে গাইতে পৌঁছে যেতাম তিন-চার কিমি দূরে কোনো কমরেডের বাড়ি। যেন মুক্তাঞ্চল।

আইসা’র তিন দশকের মধ্যেকার দ্বিতীয় দশক ছিল সেটি। নদীয়া জেলার এক প্রান্তিক কৃষি-প্রধান এলাকা আইসার আন্দোলনে মুখর হয়ে উঠেছিল। স্কুলে স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের মাঝে প্রচার নিয়ে যাওয়া, কলেজে প্রচার, বারবার হামলার সম্মুখীন হয়েও মোটেই দমে না যাওয়া, রাস্তার দাবিতে শয়ে শয়ে ছাত্র-যুবর রানাঘাট অভিযান, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ত্রাণকার্য, কলকাতার পথনাটকের দলবল ডেকে প্রতিবাদী কনভেনশন, সম্মেলন। এলাকাভিত্তিক এবং শহর কলকাতায় বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রোগ্রামে বগুলা ইউনিটের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি ছিল অনেকটা সময় জুড়ে। ২০০৫-এ যাদবপুরের ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে আমরাও গলা মেলাতে পেরেছিলাম ‘লাঠির মুখে গানের সুর, দেখিয়ে দিল যাদবপুর’। কলকাতায় মহামিছিলে যোগ দেওয়ার অপরাধে বগুলা কলেজে সিপিএমের আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছিল আমাদের ছাত্র সাথীদের। তার জবাবে “ছাত্রছাত্রী সংহতি মঞ্চ” গড়ে যাদবপুর ও প্রেসিডেন্সির একঝাঁক ছাত্রছাত্রী বগুলা কলেজগেট ও হাঁসখালি থানায় বিক্ষোভ সংগঠিত করেছিল।

olddd

 

এসবেরও আগে একবার ২৮ জুলাই পার্টির ডাকা এক বাংলা বন্ধের দিনে ট্রেন অবরোধ করে গ্রেপ্তার হওয়ার সময় সেদিনের ‘নকশাল বাড়ি লাল সেলাম’ স্লোগান উপস্থিত জনতাকে চমকিত করেছিল। কলকাতায় অহরহ ঘটলেও প্রান্তিক মফস্বলে এক ঝাঁক ছাত্র যুব’র সেই স্লোগান নতুন মাত্রা পেয়েছিল সেদিন। ২০০৬ সালে সিঙ্গুরে আইসা ও কৃষিমজুর সমিতি (বর্তমানে যা আয়ারলা) ‘জমি-রক্ষা ক্যাম্প’ করে ছিল সারা নভেম্বর মাসটা – ক্যাম্পে ব্যানারে লেখা ছিল – “এখান থেকেই শুরু হোক এক অধ্যায়, আঙুলে আঙুল আগলে রেখেছি ঘাঁটি। মাথার ওপর একফালি চাঁদ উন্মাদ, পায়ের তলায় নাছোড়বান্দা মাটি” – কমরেড বিলাস সরকারের লেখা। আমরা এই ক্যাম্পে যোগ দিয়েছিলাম। প্রথম দিন থেকেই সিঙ্গুর আন্দোলনে জুড়ে গেছিল বগুলার আইসা কর্মিরা। সিঙ্গুর আন্দোলনে উপস্থিতি এবং তৎকালীন তীব্র বিতর্ক আমাদের মধ্যে এক গভীর রাজনৈতিক বোধের জন্ম দিয়েছিল। নদীয়া জেলার পার্টি কাঠামোর সাথে আমাদের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। বিশেষ করে প্রয়াত কমরেড বিমান বিশ্বাস তখন আমাদের সাথে প্রায়শই যোগাযোগ রাখতেন।

ইউনিভার্সিটির ছাত্র না হয়েও যাদবপুর ক্যাম্পাস তথা মেইন হোস্টেলে আমাদের প্রবেশ প্রায় অবাধ ছিল তখনকার আইসা ইউনিটের সৌহার্দপূর্ণ সহযোগিতায়। বিতর্ক আমাদেরও ছিল, ছিল নেতৃত্বের প্রতি আস্থাও। বিতর্ক কখনোই জনগণের স্বার্থের বাইরে মাত্রা ছাড়িয়ে যায়নি ব্যাক্তি স্বার্থে। সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে বর্তমানের যত লড়াই আন্দোলন, তার মধ্যে আজও সেদিনের উপস্থিতি খুঁজে ফিরি।

-- শঙ্কর রায়  

খণ্ড-27
সংখ্যা-28