প্রতিবেদন
গ্রেপ্তার ও সমন, ব্রাহ্মণবাদী আক্রমণ
gra

মনুস্মৃতি জ্বালিয়ে আমরা জাতপ্রথার শিকর উপড়ে ফেলার কাজ শুরু করলাম।

- বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেদকার

কয়েকদিন আগে (৪ সেপ্টেম্বর) আমাদের প্রিয় বন্ধু ও কমরেড ডঃ পার্থ সারথী রায়কে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা – ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (এনআইএ) – সমন জারি করে মুম্বাই তলব করে। সমনে জানানো হয়, এলগার পরিষদ-ভীমা করেগাঁও মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্যই তাকে ডাকা হয়েছে। ১০ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টায় তাকে মুম্বাইতে এনআইএ-র দপ্তরে হাজিরা দিতে আদেশ দেওয়া হয়।

পার্থ একজন কৃতি বিজ্ঞানী, বিজ্ঞান জগতে সুপরিচিত। কল্যাণীতে অবস্থিত ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট ফর সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ-এর সহযোগী অধ্যাপক এবং গবেষক। মলিকিউলার বায়োলজিতে, বিশেষ করে ভাইরাস নিয়ে তার গবেষনার কাজ বিশ্বের বিজ্ঞান মহলে সাড়া ফেলে দিয়েছে। আজকের কোভিড-১৯ সংক্রমণ অতিমারির বিরুদ্ধে যুদ্ধে তার গুরুত্বপূর্ণ অবদানকে স্বীকৃতি দিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা – ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (হু) – তাকে ভারতের নীতি-নির্ধারণকারী দলের অন্যতম সদস্য হিসাবে নিযুক্ত করেছে। পার্থর নির্দেশিত রণনীতি, করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জোট বেঁধে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ – কমিউনিটি পার্টিসিপেশন – রাজ্য সরকারের সহযোগিতায় পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলায় কার্যকরী করে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে।

পার্থর সবচেয়ে বড় পরিচয় অবশ্য গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তার নিরন্তর জড়িয়ে থাকা। মানবাধিকার ও রাজনৈতিক বন্দীর মুক্তির দাবিতে সর্বদা তিনি যেমন সরব থাকেন, তেমনই নিরন্ন, হতদরিদ্র প্রান্তিক মানুষের, বিশেষত দলিত ও আদিবাসীদের, অধিকার আন্দোলনে তিনি আছেন একেবারে সামনের সারিতে। পস্কো, নিয়মগিরি, নন্দীগ্রাম, লালগড়, নোনাডাঙা, ঝাড়খন্ডের পাথলগড়ি আন্দোলন, কোথায় নেই তিনি! যে কোনও প্রতিবাদী মিছিল, জনসভা, পথসভা, ঘরোয়া সভায় পার্থর সক্রিয় উপস্থিতি, প্রাঞ্জল, যুক্তিপূর্ণ বক্তৃতা এবং সদা আপন-করে-নেওয়া হাসিমুখ আমাদের মুগ্ধ করেছে, অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। এহেন ব্যাক্তিটিকে সমন জারি করে রাষ্ট্র রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করবে, সেটাই তো স্বাভাবিক।

পার্থকে সমন জারির খবর ছড়িয়ে পড়তেই দেশ-বিদেশের বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ, অধ্যাপক, শিক্ষক, সাহিত্যিক, নাট্যকর্মী, সঙ্গীত শিল্পী, ফিল্মমেকার সহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক, অধিকার ও গণআন্দোলনের কর্মী ও সংগঠন, নারী আন্দোলন, ছাত্রযুব সংগঠন, ট্রেড ইউনিয়ন, কৃষক সভা, এনজিও ইত্যাদি এবং সর্বোপরি নানান দলিত ও আদিবাসী সংগঠন প্রতিবাদে সোচ্চার হয়। জোরদার প্রতিবাদ জানায় ছোট-বড় রাজনৈতিক দলগুলিও। অতিমারির কারণে বিধিনিষেধ থাকলেও মিছিল, পথসভা করেও প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়। পার্থ অবশ্য শেষ পর্যন্ত মুম্বাই যাননি। এনআইএকে ই-মেল করে তিনি জানিয়ে দেন, যেহেতু তিনি কোভিড১৯ ভাইরাস নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছেন, তাই তিনি বিমানযাত্রার ঝুঁকি নিতে পারবেন না।

এদিকে, পার্থকে সমন জারির পরের দিনই এনআইএ সমন জারি করে হায়দ্রাবাদের ইংলিশ অ্যান্ড ফরেনল্যাঙ্গুয়েজ ইউনিভার্সিটির কালচারাল স্টাডিজ-এর প্রবীন অধ্যাপক কে সত্যনারায়ণ এবং অভিজ্ঞ সাংবাদিক কে ভি কুর্মানাথকে। অধ্যাপক সত্যনারায়ণ দলিত সাংস্কৃতিক অন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে চর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন দীর্ঘদিন ধরে এবং তার কাজ আন্তর্জাতিক স্তরে সমাদৃত। আর, কুর্মানাথ সংবাদপত্রে লিখে চলেছেন দলিত শোষণ, অত্যাচার ও প্রতিরোধ আন্দোলনের নানা কাহিনী। এদেরও এলগার পরিষদ-ভীমা করেগাঁও মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৯ সেপ্টেম্বর মুম্বাই তলব করা হয়। প্রসঙ্গত, এরা দু’জনেই বিপ্লবী কবি ভারাভারা রাওএর জামাই, যাকে ইতিমধ্যেই ভয়ংকর ইউএপিএ ধারায় গ্রেপ্তার করে জেলবন্দি করা হয়েছে ওই ভীমা-করেগাঁও মামলাতেই। আশি বছরের জোয়ান কবি প্রায় দু’বছর বিনা বিচারে কারাবাস করছেন, আজ তিনি গুরুতর অসুস্থ এবং তার পরিবারের দাবি তার সুচিকিৎসা হচ্ছে না।

পার্থ সারথী রায়ের মতো অধ্যাপক সত্যনারায়ণ ও কুর্মানাথকে সমন দেওয়ায় বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে প্রতিবাদের ঝড় বয়ে আসে। হয়ত সেই সম্মিলিত প্রতিবাদের চাপেই দু’জনকে মাত্র একদিন জেরা করে ছেড়ে দেওয়া হয়।

ছাড় কিন্তু পায় না প্রতিবাদী দলিত সাংস্কৃতিক কর্মী সাগর তাতারাম গোর্খে, রমেশ মুরলীধর গেইচর ও জ্যোতি রাঘব জগতাপ। এরা তিনজনেই কবীর কলা মঞ্চএর সক্রিয় সদস্য। কবীর কলা মঞ্চ একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন, এরা বহুদিন ধরে গ্রামে গ্রামে ঘুরে গান-নাটক-কবিতার মাধ্যমে দলিত সমাজকে জাগ্রত করার কাজে লিপ্ত। বি আর আম্বেদকার ও জ্যোতিরাও ফুলের চিন্তাধারা এদের অনুপ্রেরণা। এর আগে, ইউপিএ আমলেই, এদের ‘মাওবাদী’ শাখা সংগঠন বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল এবং কয়েকজন সদস্য কে ইউএপিএ ধারায় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এখন এদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে আবার ইউএপিএ ধারাতেই এবং ভিমা-করেগাঁও মামলাতেই। নভেম্বর ২০১৮ ভীমা-করেগাঁও মামলায় যে চার্জশিট দেওয়া হয় তাতে তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল এরা পুণেতে এলগার পরিষদের সভায় জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে মানুষের মনে হিংসা ছড়িয়েছিল। গ্রেপ্তারির আগে এদেরকে বলা হয়, মাফ চাইলে ছেড়ে দেওয়া হবে, এদের জবাব ছিল, আমরা সাভারকারের না, আম্বেদকারের সন্তান, মাফ আমরা চাইব না।

গোর্খে, গেইচর ও জগতাপের গ্রেপ্তারের সঙ্গে ভীমা-করেগাঁও মামলায় এখনও পর্যন্ত ইউএপিএ ধারায় জেলবন্দীর সংখ্যা দাঁড়াল ১৫ জন। ৮ জুন, ২০১৮ প্রথম গ্রেপ্তার হন আইনজীবী সুরেন্দ্র গ্যাডলিং যিনি মানবাধিকার রক্ষার খাতিরে আইনি লড়াই লড়েছেন বহু মামলায়, দলিত কবি সুধীর ধাওয়ালে, নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক সোমা সেন, রাজনৈতিক বন্দিমুক্তি আন্দোলনের সংগঠক রোনা উইলসন এবং জাতীয় পুরষ্কার প্রাপ্ত সমাজ কর্মী মহেশ রাউত। এর পর ২৮ আগস্ট, ২০১৮ পুলিশ তল্লাসি চালায় ন’জনের বাড়িতে এবং পরে একে একে গ্রেপ্তার হন আরও ছ’জন – ২৬ অক্টোবর, ২০১৮ গ্রেপ্তার হন মানবাধিকার কর্মী ও লেখক অরুণ ফেরেরা এবং ভারনন গঞ্জালভেস; ঠিক তার পরের দিন গ্রেপ্তার করা হয় ছত্তিসগড় মুক্তি মোর্চা-র অন্যতম নেত্রী ও আইনের শিক্ষক সুধা ভরদ্বাজকে; ১৭ নভেম্বর, ২০১৮ গ্রেপ্তার হন বিপ্লবী কবি ভারাভারা রাও; এর পর কোভিড১৯ অতিমারীর মধ্যেই ১৪ এপ্রিল, ২০২০ গ্রেপ্তার করা হয় ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি-র উপাদেষ্টা সম্পাদক ও কলমনিস্ট গৌতম নাভলাখা এবং দলিত রাজনীতির তাত্ত্বিক লেখক আনন্দ তেলতুম্বড়েকে। শেষে ২৮ জুলাই, ২০২০ গ্রেপ্তার হন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হ্যানি বাবু। এদের সবাই এখন পুণের কুখ্যাত ইয়েরওয়ারা জেলের বাসিন্দা, প্রত্যেকেই বিচারাধীন। সকলেরই জামিনের আবেদন পুণে কোর্ট, বম্বে হাই কোর্ট এবং সুপ্রীম কোর্ট নাকচ করে দিয়েছে। মহারাষ্ট্রে বিজেপি সরকারের পতনের পরে, ২৫ জানুয়ারি, ২০২০ মহারাষ্ট্র পুলিশের হাত থেকে তুলে নিয়ে এই মামলার তদন্তভার দেওয়া হয় এনআইএকে।

গ্রেপ্তার হওয়া বন্দীদের বিরুদ্ধে এনআইএ যে অভিযোগগুলি এনেছে সেগুলির মধ্যে অন্যতম দু’টি হল : এক, এলগার পরিষদে বক্তৃতা করে ভিমা-করেগাঁওতে হিংসার উস্কানি দেওয়া; দুই, নরেন্দ্র মোদিকে হত্যার ষড়যন্ত্র (পুণে পুলিশের আনা রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনআইএ অজ্ঞাত কারণে বাতিল করে দিয়েছে)। মজার ব্যাপার হল, জেলবন্দীদের অধিকাংশই পুণের এলগার পরিষদের সভায় অংশগ্রহণ করেননি কিংবা ভিমা-করেগাঁওতে পা রাখেননি। তবে, এদের মধ্যে একটা মিল অবশ্য আছে – এরা প্রত্যেকেই দলিত-আদিবাসী অধিকার আন্দোলনের সাথী, প্রত্যেকেই সামাজিক ন্যায়ের পক্ষে সোচ্চার।

ঠিক কি ঘটেছিল ভীমা-করেগাঁওতে যার ফলে রাষ্ট্রশক্তি তার সমস্ত শক্তি নিয়োগ করে দেশের তাবড় তাবড় চিন্তাশীল ব্যক্তি, যারা শোষিত-নিপীড়িত মানুষের সংগ্রামের সাথে যুক্ত, তাদের কারাগারের অন্ধকার কুঠরিতে আবদ্ধ করে রাখা হচ্ছে? উত্তর পেতে দৃষ্টি ফেরাতে হবে ইতিহাসের পাতায় :

আজ থেকে দু’শ বছর আগে, মারাঠা যুক্তরাষ্ট্র বা কনফেডেরেসির একছত্র অধিপতি তখন পেশোয়া বাজিরাও ২। ‘পেশোয়া’ শব্দের অর্থব্রাহ্মণ, এবং কে না জানে জাতব্যবস্থায় ব্রাহ্মণরা প্রবল পরাক্রমশালী। এই ‘পেশোয়াই’ বা ব্রাহ্মণত্বের বলে বলীয়ান হয়েই বাজিরাও ২ যথেচ্ছাচারী, অত্যাচারী, স্বৈরতান্ত্রিক রাজা হয়ে উঠেছিলেন। জাতব্যবস্থায় যারা নিম্ন বর্ণের, বিশেষ করে অস্পৃশ্য মাহার সম্প্রদায়ের, তাদের আচারআচরণের ওপর তিনি আরোপ করেছিলেন অমানবিক বিধিনিষেধ। স্বাভাবিকভাবে, নিম্ন বর্ণের মানুষজন, যাদের আমরা আজ ‘দলিত’ বলি, তারা পেশোয়ার ওপর ক্ষিপ্ত ছিলেন এবং চাইছিলেন পেশোয়াই-এর অবসান।

১৮১৭ সালের শেষ লগ্নে বাজিরাও ২৮,০০০ সৈন্য নিয়ে ডেকান উপত্যকার পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত পুণেতে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির ঘাঁটি আক্রমণ করেন। কম্পানির বাহিনীতে কিছু অফিসার ছিলেন কিন্ত লড়াইয়ের উপযুক্ত সৈনিক ছিল না। ক্যাপ্টেন ফ্রান্সিস স্টৌন্টন তড়িঘড়ি শক্তসমর্থমাহার কৃষকদের জড়ো করে ৮০০ সেনার এক বাহিনী তৈরি করেন। ১৮১৮-র প্রথম দিনে পেশোয়া বাহিনী পুনে থেকে ৪০ মাইল দূরে ভীমা নদীর ধারে কোরেগাঁওতে কম্পানির মাহার বাহিনীর সম্মুখীন হয়। ৮০০ সেনা ২৮,০০০ সেনার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ১২ ঘণ্টা ভয়ানক যুদ্ধের পর পেশোয়া বাহিনী পিছু হটে। এই পরাজয়ের ফলেই অবশেষে পেশোয়া রাজত্বের অবসান ঘটে।

পরবর্তী কালে ইংরেজ সাহেবরা ভীমা-কোরেগাঁওতে নিহত ব্রিটিশ অফিসার ও মাহার সেনার নামাঙ্কিত একটি বিজয় স্তম্ভ তৈরি করে। ১ জানুয়ারী, ১৯২৭ আম্বেদকার ভীমা-কোরেগাঁওতে আসেন এবং বিজয় স্তম্ভটিকে দলিত শৌর্যের প্রতীক হিসাবে চিহ্নিত করেন। প্রতি বছর তাই ১ জানুয়ারী দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কাতারে কাতারে দলিত মানুষ ভীমা-কোরেগাঁওতে জড়ো হয়ে দলিত উত্থানের বিজয় উৎসব পালন করেন।

১ জানুয়ারী, ২০১৮ ছিল ভীমা- কোরেগাঁওর ২০০ বছর পুর্তিপালন দিবস। আগের দিন, অর্থাৎ ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৭ পুণের শনিওয়ারওয়াদা দূর্গে এলগার পরিষদের সভার আয়োজন করা হয়। সভাটি আহ্বান করেছিলেন অবসরপ্রাপ্ত দুই বিচারপতি পি বি সাওয়ান্ত ও বি জি কোলসে-পাটিল এবং আম্বেদকারের পৌত্র প্রকাশ আম্বেদকার। ৩৫,০০০ মানুষ এই সভায় উপস্থিত হয়েছিলেন। বক্তাদের মধ্যে ছিলেন গুজরাতের বিধায়ক জিগ্নেশ মেভানি, রোহিত ভেমুলার মা রাধিকা ভেমুলা, আদিবাসী আন্দোলনের সোনি সোরি, ভীম আর্মির বিনয় প্রতাপ সিং এবং জেএনইউ-এর ছাত্র নেতা উমার খালিদ। জাত-ব্যবস্থা নিয়ে বেশ কয়েকটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও হয় এই সভায়। কবিগান গেয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয় সন্ত তুকারাম, মহাত্মা জ্যোতিরাও ফুলে, শিবাজি ও সাহু মহারাজকে। পরিবেশিত হয় প্রতিবাদী নৃত্যনাট্য এবং হিপ-হপ গান। জাতপ্রথা গুঁড়িয়ে দেবার প্রতীকী অর্থে রাধিকা ভেমুলা গাদা করা মাটির কলস ভাঙেন।

১ জানুয়ারী লক্ষ লক্ষ মানুষ জড়ো হতে থাকেন ভীমা-কোরেগাঁওতে। কিন্তু কোন এক অজানা কারণে বন্ধ হয়ে যায় জল সরবরাহ। যে বাসগুলিতে দূর থেকে আগত যাত্রীরা আসছিলেন তাদের ওপর হতে থাকে পাথর-বর্ষণ। একটি হোটেলে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। লেগে যায় মারামারি, সংঘাতে মৃত্যু হয় ২৮ বছরের যুবক রাহুল পতঙ্গলির। প্রতিবাদে ৩ জানুয়ারী মহারাষ্ট্র জুড়ে স্ট্রাইক ডাকেন প্রকাশ আম্বেদকার। স্ট্রাইক হয় সর্বাত্মক, হিংসার ঘটনাও ঘটে, মৃত্যু হয় একজনের, আহত হন ৩০০ জন।

ভীমা-কোরেগাঁওতে হিংসার ঘটনার পিছনে ছিলেন সম্ভাজি ভিদে এবং মিলিন্দ একবোটে, এই মর্মে এফআইআর দায়ের করেন প্রকাশ আম্বেদকার। প্রাথমিক তদন্তে এর যাথার্থতা প্রমানিত হয়। তৎকালীন মহারাষ্টের বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিস দোষীদের গ্রেপ্তার করার প্রতিশ্রুতিও দেন। কিন্তু সম্ভাজি ভিদের বিরুদ্ধে আজ পর্যন্ত কোনও তদন্ত হয়নি, কোনও ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। মিলিন্দ একবোটে গ্রেপ্তার হন ১৪ মার্চ, সুপ্রীম কোর্ট অন্তরবর্তী জামিনের আবেদন নাকচ করে দিলেও ১৯ এপ্রিল পুণের জেলা ও দায়রা আদালত তাকে বেকসুর খালাস করে দেন।

এখানে বলা প্রয়োজন, সম্ভাজি ভিদে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির গুরু, একসময় ছিলেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আরএসএস)-এর সদস্য, পরে ‘শিব প্রতিষ্ঠান হিন্দুস্তান’-এর প্রতিষ্ঠাতা। আর মিলিন্দ একবোটে ‘সমস্ত হিন্দু আঘারি’-র সভাপতি। অনুমান করা যায়, কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা ভীমা-কোরেগাঁওয়ের হিংসাত্মক ঘটনা ঘটানোর ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিলেন। পেশোয়াই-এর পরাজয়ের গ্লানি তারা আজও মুছে ফেলতে পারেননি, দলিত সচেতনতার উন্মেষ মেনে নিতে তারা অপারগ।

*** *** ***

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কাছে মুচলেখা দেওয়া ‘বীর’, ভি ডি সাভারকার এসেন্সিয়ালস্ অফ হিন্দুত্ব (১৯২৩) গ্রন্থে লিখেছিলেন, “ব্রাহ্মণ শাসনব্যবস্থা হিন্দুনেশনের মডেল। ১৮১৮ সালে এখানে সর্বশেষ এবং সবচেয়ে গৌরবময় হিন্দু সাম্রাজ্যের কবর দেওয়া হয়।”

এখানে সাভারকার পেশোয়া রাজত্বের কথাই বলেছেন, ১৮১৮ সালে ভীমা-কোরেগাঁওতে যার মরণ হয়েছিল। তার ‘সবচেয়ে গৌরবময় হিন্দু সাম্রাজ্যে’ অবশ্য অস্পৃশ্যদের গলায় হাঁড়ি ঝুলিয়ে রাখতে হত থুতু ফেলার জন্য, কোমরের পিছনে ঝাড়ু বেঁধে রাখতে হত পদচিহ্ন মুছে ফেলতে। পুনরায় সেই ঘৃণ্য রাষ্ট্র গঠনেরই স্বপ্নে বিভোর আজকের হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা।

হিন্দু জাতি-রাষ্ট্রের ধারণাটা দাঁড়িয়ে আছে মনু-নির্মিত চতুর্বর্ণ সমাজ কাঠামোর ভিতের উপর। আরএসএস-এর দ্বিতীয় সরসংঘচালক ‘গুরুজি’ মাধব সদাশিব গোলওয়ালকার তাই মনুকে ‘ভগবান’ আখ্যায় ভূষিত করেছেন। উই, আওয়ার নেশনহুড ডিফাইন্ড গ্রন্থে (১৯৩৯) তিনি লিখেছেন, “মনু, মানব ইতিহাসে প্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ আইন-প্রণয়েতা, যার নির্মিত সামাজিক নিয়মবিধি পৃথিবীর সমস্ত মানুষের কাছে শিক্ষণীয়।” গোলওয়ালকার রচিত আরেকটি গ্রন্থ বাঞ্চ অফ থটস্-এ (১৯৬৬) এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত লিখেছেন। এমনকি, মারাঠি দৈনিক নভ কাল-কে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে (১৯৬৯) উনি বলেছিলেন, “বর্ণ প্রথা ঈশ্বরের সৃষ্টি এবং যতই প্রচেষ্টা চলুক না কেন সেটা ধ্বংস করা যাবে না।”

আজকে সাভারকার-গোলওয়ালকারের উত্তরসূরিরা ক্ষমতার মসনদে আসীন। ব্রাহ্মণবাদী আধিপত্যবাদের সাথে ইদানীং হাত মিলিয়েছে কর্পোরেট লুঠতরাজী আধিপত্যবাদ – এটাই নয়া-হিন্দুত্ব, ব্রাহ্মণবাদের নয়া অবতার। সাম্য-মুক্তি-মৈত্রী-ন্যায়র মন্ত্রে দিক্ষিত সংবিধানকে চিতায় উঠিয়ে আজকের ক্ষমতাশালীরা মনুসংহিতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে উদ্যত। ভীমা-কোরেগাঁওর স্মৃতিকে মুছে ফেলে এরা মনুস্মৃতিকে ফিরিয়ে আনতে চায়।
যেভাবেই হোক এদের রুখতেই হবে। করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে।

- সুমিত  

খণ্ড-27
সংখ্যা-33