সম্পাদকীয়
সত্যের অপলাপ — মিথ্যার বেসাতি
ed

‘ভারতে সংখ্যালঘু মুসলিমদের প্রতি কোনও বৈষম্য করা হয় না, এখানে মুসলিমরা স্বস্তি ও শান্তিতেই রয়েছে।’ এ মন্তব্য দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর। কী উপলক্ষ্যে? ইরানের ব্রিগেডিয়ার জেনারেলকে ভারতে বহুত্বের সুস্থিতি চেনাতে। প্রমাণ হিসাবে তিনি তুলে ধরলেন খোদ তাঁর লক্ষ্ণৌ লোকসভা নির্বাচনী কেন্দ্রের নজির, যেখান থেকে বিজয়ী হওয়ার পিছনে শিয়া মুসলিমদের ব্যাপক সমর্থন পেয়েছেন বলে তিনি দাবি করেন। শুধু তাই নয়, মনে করেন তাঁর আগে প্রয়াত অটল বিহারী বাজপেয়ীও অনুরূপ সমর্থন পেতেন। রাজনাথজী লক্ষ্ণৌ থেকে ইরাক যাত্রার বিমান ব্যবস্থাও করে দিয়েছেন শিয়া তীর্থযাত্রীদের জন্য। ভাবখানা এমন যেন, আর কি চাই? উপযাচক হয়ে এইসব জানিয়ে ইরানী প্রতিনিধি জেনারেলকে কি বোঝাতে পেরেছেন সেটা বড় কথা নয়। বৈদেশিক কূটনীতিতে অনেক কথা বলতে হয় শুনতেও হয়। কিন্তু প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর এই বার্তা প্রকৃত তথ্যের নিরীখে সত্যের অপলাপ তথা মিথ্যার বেসাতি ছাড়া অন্য কিছু বলে গণ্য হতে পারে না।

সংবাদজগত যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। ভারতে মোদী জমানায় মুসলিম সম্প্রদায় রয়েছে খুবই নিরাপত্তাবিহীনতায়। এখানে উত্থান ঘটছে এমন এক রাজনৈতিক শক্তির যার মতাদর্শ হল হিন্দুত্ব, হিন্দু রাষ্ট্রবাদ। এদের ক্ষমতায় আসার এবং ক্ষমতার জোরে কাজ করার বিধ্বংসী পথ একই। প্রকৃত তথ্যের দিকে ফিরে তাকানো যাক। লড়াই কেবল ঘটনা ও রটনার মধ্যে নয়, লড়াই সত্য-অর্ধ সত্যের মধ্যে, সত্য-মিথ্যার মধ্যে। ভূয়োর স্বরূপ উন্মোচনে আসলকে প্রতিষ্ঠা করার লড়াই।

সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নিশানা করে প্রথমবার সাম্প্রদায়িক হিংসা সংঘটিত হয় ১৯৯২ সালে, মোদীর গুজরাটে ক্ষমতায় আাসার এক দশক আগে। দ্বিতীয় সবচেয়ে বড় সাম্প্রদায়িক হিংসার অভিযানটি চলে গুজরাটের বুকেই ২০০২ সালে, কেন্দ্রের ক্ষমতায় মোদীর আসার এক দশকের কিছু বেশী সময় আগে। মুম্বাই হিংসায় নিহতের সংখ্যা ছিল প্রায় এক সহস্র, আহতের সংখ্যা দুই সহস্রাধিক। গুজরাট হিংসা পরিণত হয় ব্যাপক গণহত্যায়, নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় দুই সহস্রাধিক, আহতের সংখ্যা কয়েক সহস্র। এছাড়া উত্তরপ্রদেশে যোগী সরকার ক্ষমতায় আসার পশ্চাৎপটে সংঘটিত হয়েছিল মুসলিম নির্মূলীকরণের মুজফ্ফরনগর অভিযান। যার পরিণামে নিহতের সংখ্যা ছিল প্রায় পঞ্চাশ, ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হন পঞ্চাশ হাজার। আর, ২০২০ সালে আরও একবার সংগঠিত করা হল সাম্প্রদায়িক হিংসা, খোদ দিল্লীর বুকে, সিএএ বিরোধী শাহীনবাগ আন্দোলনকে চূর্ণ করতে। নিহতের সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় পঞ্চাশ, আহতের সংখ্যা দাঁড়ায় দুই শতাধিক। এইসব হিংসার নারকীয়তায় আবালবৃদ্ধবনিতা কারও মেলেনি ছাড়। আক্রমণের ৫২ শতাংশ ঘটানো হয়েছে রটনা রটিয়ে। হত্যার ৮৬ শতাংশ উপলক্ষ ছিল গো-হত্যা, গো-মাংস ভক্ষণ, গো-মাংস বা গোরু পাচারের সম্পর্ক জড়িয়ে। ৫০ শতাংশ আক্রমণ সংঘটিত হয় বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে। সবচেয়ে জঘন্য সময়টা গেছে ২০১৭ সালে। মোদীর দ্বিতীয়বার ক্ষমতাসীন হওয়ার বছর না ঘুরতে যা দিল্লীতে ঘটানো হল তা কম নারকীয় নয়। অপরাধ সেখানেই থেমে থাকেনি। ‘মিনি পাকিস্তান’ বা ‘ইসলামোফোবিয়া’র জিগির তুলে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জামিয়া মিলিয়া, কাফিল খান থেকে সাফুরা জাগরার, পাইকারি হারে চালানো হয়ে আসছে দমনপীড়ন, মিথ্যা মামলায় বিনা বিচারে কারান্ধকারে বন্দী করে রাখাই হয়ে দাঁড়িয়েছে চল। হয় হিন্দুত্বের বশ্যতা স্বীকার করে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে থাকো, নয়ত শত্রু প্রতিপন্ন হও, উচ্ছেদ হও, বিতাড়িত হও! এই উদ্দেশ্যেই ফের কেন্দ্রের কুর্শি হাসিলের পরপরই নামিয়ে আনা হয়েছে দু-দুটি বজ্রাঘাত। একদিকে মুসলিম জনসংখ্যাপ্রধান কাশ্মীরের স্বশাসিত রাজ্যের বিশেষ সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হল। তারপরও চলছে কাশ্মীরের অন্তরাত্মাকে ক্রমাগত বিধ্বস্ত করে দেওয়ার ফ্যাসিবাদী হস্তক্ষেপ। অন্যদিকে মুসলিম সম্প্রদায়কে দাবিয়ে রাখার জন্যই চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে সিএএ-এনপিআর-এনআরসি’র জোয়াল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ বলেই রেখেছেন, এনআরসি হবে গোটা দেশে। যাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়ার তা নেওয়া হবে ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের আগেই। নাগরিকত্ব প্রদানের এই নয়া আইনগত সংশোধনীর মূল নিশানা মুসলিম জনগণ।

সিএএ প্রবর্তনের প্রয়াসের মধ্যে ঘোর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন খোদ রাষ্ট্রসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল। বিজেপি জমানায় মুসলিমরা মোটেই ভালো নেই।

তবে কোনোকিছুই একতরফা পার পেয়ে যাচ্ছে না। উত্থান ঘটছে পাল্টা প্রতিবাদ ও প্রতিরোধেরও।

খণ্ড-27
সংখ্যা-32