আজও মশাল জ্বলছে : শ্রদ্ধার্ঘ্য কমরেড সঞ্জয়কে
ssar

৪৭ বছর আগে ৩ অক্টোবর আমার বন্ধু ও কমরেড সঞ্জয় বসু রায়, মায়ের দেওয়া আদরের নাম বুবলু, পার্টির নাম নন্দ, শহিদের মৃত্যু বরণ করেছিল। কলকাতায় আলিপুর জেল – ব্রেক করতে গেলে সিআরপিএফ তার পেটে পরপর তিনবার গুলি করে। সঞ্জয় আমাদের মধ্যে রেখে গেল তার অপূর্ণ স্বপ্ন – নিপীড়নমুক্ত এক বিপ্লবী ভারতবর্ষের স্বপ্ন।

১ অক্টোবর ১৯৭৩। কোনদিন ভুলব না ঐ দিনটি। ঐদিন আমরা কয়েকজন কমরেড একজোট হয়ে আলিপুর সেন্ট্রাল জেল গেরিলা কায়দায় আক্রমণ করেছিলাম, আমাদের পরিচিত কিছু নকশাল বন্দিদের কারাগার থেকে মুক্ত করার জন্য। আক্রমণের এই দুঃসাহসিক পরিকল্পনা যে ‘ফেল’ করতে পারে এটা নিয়ে আমরা, ক’টি আবেগউদ্দীপ্ত তরুণ, একেবারেই চিন্তিত ছিলাম না। নকশালবাড়ির আগুনই আমাদের এগিয়ে নিয়ে গেছিল।

জেলখানার পাগলা ঘণ্টি বাজল ও সঙ্গে সঙ্গে সিআরপিএফ গুলি চালাতে শুরু করে। নন্দ ও আমি গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে যাই। ওর পেটে গুলি লেগেছিল তিনটি আর আমার দু’টো – থুতনির নিচে ও বাঁ – হাতের উপর দিকে। জেল গেটের সামনে আমরা রক্তাক্ত অবস্থায় পড়েছিলাম। অন্য কমরেডদের কী হয়েছিল, জানতে পারিনি। কিছুক্ষণ বাদে আমাদের দু’জনকে পুলিশ ভ্যানে তোলা হয়। আমরা পড়েছিলাম পাশাপাশি। যেন কোনো একটা লম্বা সফরের আগের মুহূর্ত। মনে আছে বুবলু হাত বাড়িয়ে আমায় ছুঁয়ে বলল, “লড়ে যাও গুরু”। এই ছিল ওর সংগ্রামী, লড়াকু মানসিকতা।

আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল পিজি হাসপাতালে। ৩ অক্টোবর কার্জন ওয়ার্ডে কমরেড নন্দ শহীদের মৃত্যু বরণ করে।

সঞ্জয়ের সাথে আমার প্রথম আলাপ দিল্লির সেন্ট স্টিফেন্স কলেজ হোস্টেলে। আমরা আলাদা আলাদা ভাবে সেখানে গিয়েছিলাম আমাদের বন্ধুদের সাথে দেখা করতে (অজয় বসু ও সুমন্ত ব্যানার্জি যারা ঐ কলেজে পড়ত এবং পরে নকশাল আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল)। কলকাতায় ফিরে সঞ্জয়ের সাথে হঠাৎ দেখা গোল পার্কের পুরোনো বইয়ের দোকানের সামনে। সেই থেকে বন্ধুত্ব ও এক সাথে পার্টির কাজ করা। আমরা তিলজলা-বালিগঞ্জ লোকাল কমিটির সদস্য ছিলাম। একসাথে অন্যান্য কমরেডদের সঙ্গে আমরা গোপন কায়দায় পোস্টার লাগাতাম। গড়িয়াহাটার মোড়ে যশোদা ভবনের ছাদে গিয়ে বিরাট গ্যাস বেলুন উড়িয়ে দিয়েছিলাম তার গায়ে লেখা হয়েছিল ‘নকশালবাড়ি জিন্দাবাদ’। কখনও আবার দোতালা বাসের জানালা দিয়ে লিফলেট ফেলতাম। চৌরঙ্গীর মোড়ে আমেরিকান লাইব্রেরীর ছাদ থেকেও নিচে রাস্তায় লিফলেট ছড়িয়ে দিয়েছিলাম, দেখতাম মানুষজন তা তুলে নিয়ে, অবাক হয়ে ওপরের দিকে তাকিয়ে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে। রাতে গার্ডেন রীচের এক হস্টেলে আমরা সিল্ক স্ক্রিনে পোস্টার ছাপাতাম, তাতে শ্লোগান ছাড়াও থাকত স্টেন্সিল করা চারু মজুমদার ও মাও সে তুঙ-এর ছবি।

বুবলু মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে পার্টির হোলটাইমার হয়ে গিয়েছিল। মাঝে মাঝে আমাদের বাড়িতে থাকত। আমার মা-বাবা ওকে স্নেহ করত। ও বালিগঞ্জ এলাকায় কারখানার গেটে যেত শ্রমিকদের মধ্যে নকশালবাড়ির রাজনীতি ও শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কথা বলতে। যোগাযোগের চেষ্টা করত এমন শ্রমিকের সাথে যাকে পার্টি সদস্য করা যাবে। অসুস্থ শ্রমিকদের চিকিৎসার জন্য ওর মামার (ডাক্তার) চেম্বারে নিয়ে যেত। ও বিশ্বাস করত একদিন অত্যাচারিত ও গরিব মানুষ এক সাথে উঠে দাঁড়াবে, বিদ্রোহ করবে, নিয়ে আসবে এক নতুন দিন।

সঞ্জয় বসু রায়, বুবলু, নন্দ আমার কাছে বরাবরের অনুপ্রেরণা। নন্দর মতো অগুনতি শহীদ আছেন যাদের মৃত্যু পাহাড়ের চেয়েও ভারী। যারা আজও উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, পথ দেখাচ্ছে। পথ দেখাচ্ছে আজকের হাজারো তরুণকে, যারা দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সংগ্রামের মশাল।

- তপন সেন    

খণ্ড-27
সংখ্যা-38