প্রতিবেদন
ফ্রান্সে স্কুলশিক্ষকের হিংস্র হত্যা ও মুসলমান-বিরোধী ভয়ঙ্কর ঘৃণা অভিযান
gara

ফ্রান্সের আতঙ্কজনক হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা ধ্বনিত হয়েছে সমস্ত মহল থেকে। সম্প্রদায়ের বিশ্বাসকে রক্ষা করার নামে এই ধরনের উন্মত্ত হিংস্রতা বাস্তবে বিপন্ন মানুষের পরিচিতির আবেগকে ব্যবহার করে শোষণ কায়েম রাখার হাতিয়ার। এই ধরণের অন্ধভক্তির পশ্চাদপদতা চূর্ণ করতে কাবার মূর্তিগুলি ভেঙে ছিলেন নবী মহম্মদ। ফরাসি মুসলমান সম্প্রদায়ের নেতারা এই হত্যাকে ধিক্কার জানিয়েছেন। গ্রাণ্ড প্যারিস মসজিদের হাফিজ সেমসএদ্দিন টুইট বার্তায় বলেন, “আমি আতঙ্কিত। আমি আরও আতঙ্কিত এই কারণে যে হামলাটি করা হয়েছে আমার ধর্ম ইসলামের নামে। এ মানা যায় না”।

ফ্রান্সের সাধারণ মানুষের লড়াইয়ের ওপর এই হত্যাকাণ্ড এক প্রবল আঘাত। দু’দিন অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই ফ্রান্সের প্রায় সমগ্র রাজনৈতিক মহল এককাট্টা হয়ে ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ সরকারের প্রস্তাবিত প্রকট মুসলমান-বিরোধী আইনটিকে আরও কঠোর করার পক্ষে “জাতীয় ঐক্য” গড়ে তোলার অভিযানে সামিল হয়ে পড়েছে। আর, মুসলমান সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিষোদ্গারে দুনিয়ার গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যম অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে উঠেছে।

প্যারিসের উপকণ্ঠে এক মিডিল স্কুলের ৪৭ বছর বয়সী ভূগোল শিক্ষক স্যামুয়েল প্যাটি স্কুল শেষে ফেরার পথে এক ১৮ বছর বয়সী যুবকের দ্বারা আক্রান্ত ও নিহত হন। প্রায় দুই ফিট লম্বা একটি ছুড়ি দিয়ে তাঁকে আঘাত করা হয় এবং শেষে শিরশ্ছেদ করা হয়। পুলিশ এসে পৌঁছনোর পর, পুলিশের বয়ান অনুযায়ী, হামলাকারী যুবকটি “আল্লাহু আকবর” ধ্বনি দেয় এবং সেখানেই পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। জানা যায় যে যুবকের নাম আব্দৌল্লাখ আন্তসনভ। চেচনিয়া থেকে ১২ বছর আগে ফ্রান্সে শরণার্থি হয়ে আসে তার পরিবার, সদ্য সে ফ্রান্সের নাগরিকত্ব পেয়েছে। ঘটনার দিন সে তার বাড়ি থেকে ৮০ কিলোমিটার জার্নি করে ওই স্কুলে আসে, কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করে, ছুটির পর ছাত্রছাত্রীদের কাছে জিজ্ঞাসা করে চিনে নেয় স্যামুয়েল প্যাটিকে, প্রায় আধা কিলোমিটার ফলো করে এবং তারপর রাস্তার ওপর এই নৃশংস হত্যাটি সংঘটিত করে।

ফরাসি রাষ্ট্র পরিচালিত জাতিবিদ্বেষমূলক সন্ত্রাসের আবহের মধ্যেই শিক্ষকের মুণ্ডচ্ছেদের নারকীয় ঘটনাটি ঘটেছে এবং কদর্য এই হত্যাকাণ্ডের আতঙ্কজনক ঘটনাকে কাজে লাগিয়ে ফ্রান্সের সরকার তাদের মুসলমান বিরোধী অভিযান জোরালো করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ঘটনা প্রকাশ্যে আসতে না আসতেই প্রধানমন্ত্রী ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ একে “ইসলামিস্ট অ্যাটাক” বলে অভিহিত করেন এবং তাঁর সরকার ইসলামী ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ’ দমন করতে ইতিমধ্যেই যে আইনটি প্রণয়ন করার প্রস্তাব এনেছে তার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে এই ঘটনাটির দিকে তাকাতে বলেন। ইসলামী ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ’ বিরোধী প্রস্তাবিত আইনটি আগামী ৯ ডিসেম্বর ফ্রান্সের পার্লামেন্টে পেশ করতে চলেছে ম্যাক্রোঁ সরকার, এবং এখন তাকে আরও কঠোর চেহারা দেওয়া হবে।

নতুন এই আইনটি ফরাসি রাষ্ট্রের মুসলমান-বিদ্বেষী চরিত্রকে খোলাখুলি আইনি প্রতিষ্ঠা দিতে চায়। যে সমস্ত দেশ দখল করে ফ্রান্স উপনিবেশ গড়েছিল তার সবই ছিল মুসলমান জনাধিক্যের দেশ, ফ্রান্সের মুসলমানদের সিংহভাগই ফ্রান্সের পূর্বতন উপনিবেশগুলির জনগোষ্ঠি। ইউরোপের বাকি অংশের তুলনায় ফ্রান্সের মুসলমান-বিরোধী আধুনিক রেসিজমের রূপটিও তাই বিশিষ্ট ও গভীর। উপনিবেশের একদা প্রজা এইসব মানুষের বিরুদ্ধে ফরাসি অভিজাতদের ঘৃণা প্রায়শই খোলাখুলি চেহারা নেয় এবং অতি সম্প্রতি তাদের এই বিদ্বেষ খোলাখুলি প্রকাশ করাটা প্রায় গর্বের বিষয় হয়ে উঠেছে। ঐতিহাসিক বাস্তবতাকে স্বীকার করে রেসিজমের এই ফাঁদ থেকে ফ্রান্সকে মুক্ত করার বদলে একের পর এক শাসকেরা ক্রমাগত আরও বেশি বেশি এই পঙ্কিল আবর্তে ফ্রান্সকে নিমজ্জিত করেছে। ম্যাক্রোঁ সরকারের নতুন আইনটি ফরাসি মুসলমানদের ওপর ‘বিদেশী প্রভাব’ দূর করার লক্ষ্যে আনা হচ্ছে বলে ঘোষণা। আইনটি ফ্রান্সের মসজিদগুলির তহবিলের ওপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা, ইমামদের জন্য সরকারী সার্টিফিকেশন প্রোগ্রাম চালু করা, ফরাসি মুসলমানদের বিভিন্ন রকম ধর্মীয় সংস্থা দ্বারা পরিচালিত স্কুলগুলিকে নিষিদ্ধ করা এবং ‘রিপাব্লিকান মূল্যবোধের পরিপন্থী’ এমন সমস্ত সংস্থাকে ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা দেবে রাষ্ট্রকে। এটুকু ইতিমধ্যেই ঘোষিত, বর্তমান ঘটনার সুযোগে তাতে আরও কঠোর ধারা যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা।

sta

 

‘রিপাব্লিকান’ মূল্যবোধ তথা ‘ফ্রি স্পিচ’-এর নামে জাতিবিদ্বেষকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার প্রক্রিয়া ফ্রান্সে বেশ কয়েক বছর ধরেই চলছে। ২০০৪ সালে সরকারী স্কুলে ধর্মীয় চিহ্ন ধারণের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। আপাত দৃষ্টিতে এই নিষেধাজ্ঞা ইহুদি, ক্যাথলিক ও ইসলাম – এই তিন ধর্মের জন্যই প্রযোজ্য মনে হলেও বাস্তবে তা ছিল মুসলমান মেয়েদের পরিধানের ইসলামি ঘোমটা বা মস্তকাবরণের ওপর নিষেধাজ্ঞা। ফরাসি ইহুদি সম্প্রদায়ের অধিকাংশ ছেলেমেয়েরা কিন্ডারগার্টেন থেকে শুরু করে মিডিল স্কুল পর্যন্ত ইহুদিদের নিজস্ব স্কুলগুলিতেই পড়ে। এই স্কুলগুলি, সরকারী এফিলিয়েটেড হোক বা না হোক, ধর্মীয় ব্যাপারে স্বায়ত্ততা ভোগ করে, কারণ ইহুদিদের ধর্মাচরণের স্বাধীনতা ফ্রান্সে আইন দ্বারা সুরক্ষিত। সত্তর পঁচাত্তর বছর আগে হিটলারের নেতৃত্বে ইহুদি নিধন যজ্ঞে ফ্রান্সও সামিল হয়ে পড়েছিল এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিণতি তথা ন্যুরেনবার্গ ট্রায়ালের ফলশ্রুতিতে ইহুদিদের সাম্প্রদায়িক সুরক্ষার এই আইন চালু হয়। ফলত ফ্রান্সের স্কুলে ধর্মীয় চিহ্ন ধারণের ওপর নিষেধাজ্ঞা তাদের ওপর বর্তায়নি। ধার্মিক ক্যাথলিক খ্রীষ্টান পরিবারের ছেলেমেয়েরাও মূলত প্রাইভেট স্কুলেই পড়াশোনা করে। ফলত এই আইন তাদের ওপরও বর্তায়নি। আঘাতটা নেমেছে কেবল ফরাসি মুসলমানদের ওপর। অল্প কিছু মুসলমান পরিবার, যাদের আর্থিক ক্ষমতায় কুলিয়েছে, তাঁরা ছেলেমেয়েদের ক্যাথলিক প্রাইভেট স্কুলে পাঠিয়েছেন, বাকিরা মস্তকাবরণ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। একইভাবে ২০১০ সালে প্রকাশ্যে বোরখা পরা নিষিদ্ধ হয়। এখন সরাসরিভাবে ফরাসি মুসলমানদের বিরুদ্ধে নতুন আইনটি আসছে। আইন বলবত হওয়ার আগেই অবশ্য ক্র্যাকডাউন নেমেছে। প্যারিসের শিক্ষক হত্যার জঘন্য ঘটনাটির চারদিন আগে (১৩ অক্টোবর) ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেরাল্ড ডারমানিন তাঁর টুইট বার্তায় জানান যে ফ্রান্সের সরকার গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে অভিযান চালিয়ে ৭৩টি মসজিদ ও ইসলামি স্কুল বন্ধ করে দিয়েছে ‘রাডিকাল ইসলাম’ দমনের লক্ষ্যে, যদিও ‘রাডিকাল ইসলাম’ কী তার ব্যাখ্যা এবং তার সাথে ওই সংস্থাগুলির যোগাযোগের কোনও তদন্ত বা প্রমাণ সামনে আসেনি। এই অভিযানের বিরুদ্ধে যারা প্রতিবাদ করেছেন তাঁদের ওপর তীব্র পুলিশী নিপীড়ন নেমেছে। বস্তুত ফ্রি-স্পিচের নৈতিক পাহারাদার হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে চাওয়া ম্যাক্রোঁ সরকার সমস্ত ধরণের প্রতিবাদের ওপর পুলিশি নিপীড়ন নামানোর জন্য বিশেষ পরিচিত। মধ্যপ্রাচ্যে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে যুক্ত তার সরকার, হাজার হাজার মানুষকে আশ্রয়ের সন্ধানে নৌকোয় তুলে ভূমধ্যসাগরে ডুবিয়ে মারার কাজে লিপ্ত ছিল। ইয়েমেনে সৌদি আরবের নৃশংস হামলাকে মদদ দিতে ফ্রান্সের বেআইনি অস্ত্র সরবরাহের খবর ফাঁস করে দিয়েছিল যে সাংবাদিকেরা তাঁদের পরিচয় প্রকাশ্যে আনতে বাধ্য করেছিল ফ্রি-স্পিচের হোতা হতে চাওয়া এই ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর সরকার। এখন ‘ইসলামি বিচ্ছিন্নতাবাদ’ মোকাবিলা করার নামে ফরাসি মুসলমান জনসমূদায়কে সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন করাকে আইনসিদ্ধ করতে চাইছে। এবং এই লক্ষ্য পূরণে “জাতীয় ঐক্য” গড়ে তোলার হাতিয়ার বানাচ্ছে শিক্ষক হত্যার ঘটনাটিকে।

প্রশ্ন উঠেছে হত্যাকাণ্ডটি আটকাতে ফরাসি পুলিশ-প্রশাসনের ব্যর্থতা সম্পর্কেও। এই হত্যাকাণ্ডটির কিছুদিন আগেই আরও একটি হামলার ঘটনা ঘটে গেছে। অক্টোবরের ৫ তারিখ স্যামুয়েল প্যাটি তাঁর ক্লাসে ঘোষণা করেছিলেন যে পরদিন তিনি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ে বিতর্কের ক্লাসে সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘সার্লি এব্দো’-তে প্রকাশিত বিতর্কিত কার্টুনটি দেখাবেন। তিনি ছাত্রছাত্রীদের বলেন যে কার্টুনটি অনেককেই আঘাত করতে পারে, সেক্ষেত্রে তারা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে থাকতে পারে বা ক্লাসের বাইরে চলে যেতে পারে। কার্টুনটি ছিল একজন পুরুষের নগ্ন কদর্য ড্রয়িং যাকে মহানবী হজরত মহম্মদের চিত্ররূপ হিসেবে তুলে ধরেছে পত্রিকাটি। ২০১৫ সালে এই কার্টুনটি প্রকাশিত হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যে সার্লি এব্দোর অফিসে ও একটি বাজারে কুখ্যাত সন্ত্রাসী হামলায় মোট ১৭ জনকে হত্যা করেছিল কয়েকজন যুবক। গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে ফ্রান্সের আদালতে এই সন্ত্রাসবাদী হামলার বিচার শুরু হয়েছে, এবং সেই উপলক্ষ্যে সার্লি এব্দো পত্রিকায় সেই বিতর্কিত ব্যাঙ্গচিত্রটি পুনরায় ছাপা হয়। এরপর এক যুবক পত্রিকা অফিসের সামনে এসে ছুরি নিয়ে হামলা করার চেষ্টা করে। শিক্ষক স্যামুয়েল প্যাটি ক্লাসে ব্যাঙ্গচিত্রটি দেখানোর পরদিন থেকেই একজন গার্জেন সোশাল মিডিয়ায় প্রকাশ্যে প্রতিবাদ ও প্রচার শুরু করেন এবং আদালতে মামলা করেন ক্লাসে ‘পর্নোগ্রাফিক ছবি’ প্রদর্শনের অভিযোগ এনে। এতসবের পরও ফ্রান্সের পুলিশ প্রশাসনের চোখের সামনে শেষপর্যন্ত এরকম একটি হত্যাকাণ্ড কীভাবে সংঘটিত হতে পারল তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, বিশেষত এর আগেও এরকম হামলাগুলির ক্ষেত্রেই হামলাকারিরা ফরাসি ইন্টেলিজেন্সের নজরদারির আওতায় থাকা ব্যক্তি বলেই শেষ পর্যন্ত জানা গেছে।

- মলয় তেওয়ারী   
কলকাতা, ১৯ অক্টোবর ২০২০   

খণ্ড-27
সংখ্যা-38