কংগ্রেস আমাদের কথায় গুরুত্ব দিয়েছিল, যোগী কিন্তু আমাদের কথায় কর্ণপাত করছেন না — ২০১২-র গণধর্ষণের ঘটনা আর হাথরসের ঘটনা কেন এক নয়
dare

(সিপিআই(এমএল) পলিটব্যুরো সদস্য কবিতা কৃষ্ণাণের এই লেখাটি দ্য প্রিন্ট ওয়েব পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ৬ অক্টোবর। ২০১২ সালের সঙ্গে আজ পরিস্থিতি কোন দিক থেকে আলাদা, ফ্যাসিবাদী জমানায় গণধর্ষণ ও হত্যার ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে, জাতপাতবাদী ঔদ্ধত্যের নিশান ওড়াতে ফ্যাসিবাদ কিভাবে রাষ্ট্রের সমস্ত শক্তিকে কাজে লাগায়, লেখাটিতে সেই বিশ্লেষণই লিপিবদ্ধ হয়েছে। লেখাটির গুরুত্ব বিবেচনা করে সেটির ভাষান্তর আমরা এখানে রাখছি।– সম্পাদকমণ্ডলী)

মাঝরাতে দেহটাকে পুড়িয়ে দেওয়া, ধর্ষিতা মেয়েটির পরিবারকে আটক করে রাখা, ঠাকুর জাতের আধিপত্যকে জাহির করতে দেওয়া — এ সবই হাথরসের বৈশিষ্ট্য।

দিল্লীর বাসে গণধর্ষণের ঘটনাটার পর ২০১২-১৩ সালে আমরা যখন রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানাচ্ছিলাম, সে সময় নারীবাদী প্রতিবাদকারীদের মধ্যে ক্রোধ এবং দীর্ঘদিন আন্দোলন জনিত পরিশ্রান্তি দেখা গিয়েছিল। প্রতিবাদ আন্দোলনে যারা যোগ দিয়েছিল তাদের মধ্যে শত-শত ভারতীয় তরুণ-তরুণী ছিল যারা প্রথম বারের মতো প্রতিবাদ আন্দোলনে শামিল হয়েছিল। তবে প্রতিবাদকারীদের ক্রোধ ও পরিশ্রান্তির মধ্যে আশার এক উজ্জ্বল ধারা, সামাজিক জাগরণ এবং প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের এক প্রতিশ্রুতি বহে চলেছিল। সেই প্রথমবারের মতো সমাজ ধর্ষণ সংস্কৃতি, ধর্ষিতার প্রতি দোষারোপ, এবং নিরাপত্তার নামে নারীদের স্বায়ত্ততার ওপর আক্রমণের নারীবাদী উদ্বেগের বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্ব দিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যে, রাষ্ট্র অবশেষে এটা স্বীকার করতে বাধ্য হবে যে, ধর্ষিতাদের লব্ধ অভিজ্ঞতার অনেক কিছুই যৌন হিংসা সম্পর্কিত বিদ্যমান আইনের বাইরে থেকে গেছে।

এবার ২০২০-তে হাথরসে এক দলিত মহিলার গণধর্ষণ ও হত্যা বলে জ্ঞাত ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী যে আন্দোলন হচ্ছে সেই পরিস্থিতির সঙ্গে ২০১২ সালের পরিস্থিতির যেমন মিল রয়েছে, তেমনি আবার অনেক দিক থেকে ভয়াবহ ধরনের পার্থক্যও রয়েছে।

এবারও জাত-ভিত্তিক নিপীড়ন ও ধর্ষণের ঘৃণ্য বাস্তবতার বিরুদ্ধে কাঙ্খিত সামাজিক জাগরণ দেখা যাচ্ছে। আবার এবারের আন্দোলনটা কিন্তু সমাজ পরিবর্তনের আকাঙ্খার শিখাটাকে অনির্বাণ রাখার ব্যাপার, যে শিখাটাকে নির্বাপিত করতে বদ্ধপরিকর কট্টর মনুবাদী জমানার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জাতপাত-বিরোধী ও পিতৃতন্ত্র-বিরোধী জাগরণেরও ব্যাপার।

pu

সে সময় আর এখন

২০১২ সালে দিল্লী সরকার, কেন্দ্রের ইউপিএ সরকার এবং শাসক দল কংগ্রেসকে প্রতিবাদের মধ্যে দিয়ে রক্ষণাত্মক অবস্থানে ঠেলে দেওয়া গিয়েছিল। ধর্ষিতা ও তার পরিবারের প্রতি তারা সংবেদনশীল, এবং যৌন হিংসার বৃহত্তর ইস্যুটির প্রতিও তারা গুরুত্ব দেয় – এমন হাবভাব দেখিয়ে তারা পরিস্থিতির প্রতি তাদের প্রতিক্রিয়া জানান দিয়েছিল। কংগ্রেস পার্টির নেতৃবৃন্দ ধর্ষিতার পরিবারের সদস্যদের সাথে দেখা করেছিলেন, তাদের বেদনা ও বিশ্বাস চূর্ণ হওয়ার বোধের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। মনমোহন সিং নেতৃত্বাধীন সরকার বিচারপতি ভার্মা কমিটি গঠন করেছিলেন, যে কমটি সমস্ত ধরনের নারীবাদীদের কথা ধৈর্য ধরে শুনেছিলেন: নারীবাদী স্কলার ও নারী আন্দোলনের কর্মীদের কথা, দলিত নারীবাদীদের কথা, এলজিবিটি কিউ নারীবাদীদের কথা, সংঘাত প্রবণ এলাকায় কর্মরত নারীবাদীদের কথা, কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থার বিরুদ্ধে সংগঠিত হওয়াদের কথা, এবং এরকম অন্যান্য নারীবাদীদের কথা। ভার্মা কমিটির সুপারিশগুলো প্রশ্নাতীতভাবেই নারীদের জন্য অধিকারের এক বিলের সূত্রপাত ঘটাল, যা সরকারগুলোর কাছে লিঙ্গ-ভিত্তিক অন্যায় ও হিংসার প্রতিটি ক্ষেত্রে সুরাহা করার চ্যালেঞ্জ হাজির করল, এবং তা রক্ষণশীল সামাজিক নৈতিকতা ও গণ উন্মাদনার বিপরীতে ডঃ আম্বেদকর অভিহিত সাংবিধানিক নৈতিকতার সুবিধাজনক অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিত থেকে। ভার্মা কমিটি যে সুপারিশগুলো করেছিলেন, তৎকালীন সরকার তার আংশিকই রূপায়ণ করেছিল। এ সত্ত্বেও গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয়ের কথা বাদ দিলে আইনে নিষ্পাদিত পরিবর্তনগুলো মূলত সঠিক লক্ষ্যেই পদক্ষেপ ছিল।

আজ ২০২০-তে উত্তরপ্রদেশ এবং কেন্দ্রে এমন সরকার রয়েছে যারা সংবিধানে প্রদত্ত নারী ও দলিতদের স্বাধীনতা ও অধিকার রূপায়ণের প্রতীকী হাবভাব দেখানোর প্রয়োজনও বোধ করে না। এর বিপরীতে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী রূপে আমাদের সামনে রয়েছেন যোগী আদিত্যনাথ যিনি মনুবাদী জাতপাতবাদী পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে চাপিয়ে দিতে এবং জাতপাত-বিরোধী ধর্ষণ-বিরোধী আন্দোলনকে দমন করতে রাষ্ট্র যন্ত্রের পুরো শক্তিকে কাজে লাগাচ্ছেন।

বিরোধী নেতৃবৃন্দ, দলিত ও নারী গোষ্ঠীগুলো ধর্ষিতার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করে তাদের প্রতি সংহতি জানাচ্ছেন – যেটা তাঁদের করা উচিত। কিন্তু সে সময় বিরোধী দলগুলো দুর্নীতি-বিরোধী ও ধর্ষণ-বিরোধী আন্দোলনে নেমে ইউ পি এ সরকারকে নিশানা বানানোয় যে সংবাদমাধ্যমগুলো তখন তাদের শাবাশ জানানোর ভূমিকা নিয়েছিল, তারাই এখন ধর্ষণ নিয়ে “রাজনীতি করার” অভিযোগে বিরোধীদের অভিযুক্ত করছে।

up

আজ কিন্তু ২০১২ নয়

তাদের সমস্ত ত্রুটি সত্ত্বেও ২০১২ সালে কংগ্রেস ধর্ষণকে অস্বীকার করার চেষ্টা করেনি, ধর্ষিতাকে মিথ্যাবাদী বলে দেগে দিতে যায়নি বা সাম্প্রদায়িক আখ্যান ছড়ানোর চেষ্টাও করেনি। এর বিপ্রতীপে ২০২০ সালে শাসক বিজেপি তার চিরাচরিত পাল্টা সাম্প্রদায়িক অভিযোগগুচ্ছ হাজির করার কৌশল অবলম্বন করে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে চাইছে। সে এমন সমস্ত ধর্ষণের ঘটনা তুলে আনছে যেগুলোতে অভিযুক্তরা হল মুসলিম, এবং সে দাবি করছে – ওই সমস্ত ঘটনাগুলোর প্রতিবাদ কেন করা হচ্ছে না। সে বলছে – কংগ্ৰেস-শাসিত রাজ্যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে তার প্রতিবাদ হচ্ছে না কেন।

আসল বিষয়টা কিন্তু হল: ওই ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট জাত ও ধর্ম-ভিত্তিক পঞ্চায়েতগুলো কি ধর্ষিতার দ্বারা অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সমর্থনে এগিয়ে এসেছিল? না, তা হয়নি, এটা যোগী শাসিত হাথরসের বৈশিষ্ট্য। ওই ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে পুলিশ এবং জেলা প্রশাসন কি পেট্রল ঢেলে ধর্ষিতার দেহ পুড়িয়ে দিয়েছিল, এবং তা করার মধ্যে দিয়ে প্রিয়জনদের হাতে মর্যাদাপূর্ণ অন্ত্যেষ্টিকে প্রতিহত করেছিল? না, এটাও হাথরসের নিজস্ব এক বৈশিষ্ট্য। ওই ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে কি সরকার ধর্ষিতার পরিবার এবং দলিত টোলাকে অবরুদ্ধ করে রেখে সাংবাদিক এবং অন্যান্যদের সঙ্গে তাদের কথা বলাকে আটকে রেখেছিল? ওই সমস্ত ক্ষেত্রে কি ধর্ষণ-বিরোধী প্রতিবাদকে আটকানো হয়েছিল এবং অভিযুক্তদের সমর্থনে ঠাকুর জাতের আধিপত্যের হিংসাত্মক পৌরুষ জাহির করতে দেওয়া এবং তাকে উৎসাহিত করা হয়েছিল? না, তা হয়নি, এটাও হাথরসের বৈশিষ্ট্য। ওই সমস্ত ঘটনায় শাসক দল কি করদাতাদের জমা করা টাকার ব্যবহার করে একটা জনসংযোগ কোম্পানিকে নিয়োগ করেছিল যারা ধর্ষিতাকে মিথ্যাবাদী বলে ছাপ মেরেছিল এবং চার ঠাকুর যুবকের দ্বারা ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনাকে অসত্য বলে ঘোষণার উদ্যোগ নিয়েছিল? হাথরসের ঘটনা নিয়ে জনগণ যে রাগে ফুঁসছেন তা আসলে পৈশাচিক ধর্ষণ ও হত্যার বিরুদ্ধে, এবং ঠাকুর জাতের লোকেদের জাতের আধিপত্য জাহির করা ধর্ষণের ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়ার লক্ষ্যে রাজ্য সরকার সংঘটিত অপরাধের কারণে। ওই ক্রোধ মুখ্যমন্ত্রীর তখতে এমন এক ব্যক্তির বসার জন্যে যিনি নারী ও দলিতদের অধীন ও পদানত করে রাখার মনুস্মৃতির বিধানে অনুমোদন দেওয়ার ব্যাপারে কোনো রাখঢাক করেননি।

udd

এক ভিন্ন ধরনের চক্রান্ত

২০১২ সালে নারীবাদী এবং জাতপাত-বিরোধী আন্দোলনের কর্মীরা ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালে তাঁদের সাধারণত দেশদ্রোহ ও ইউএপিএ আইনে অভিযুক্ত করা হত না (যদি না তাঁরা সংঘর্ষ প্রবণ এলাকায় কাজ করতেন, যে এলাকাগুলোকে পূর্ববর্তী সরকারগুলোও সাংবিধানিক সুরক্ষার আওতার বাইরে রাখত)। এখন আমরা কিন্তু এমন এক ব্যবস্থার মুখোমুখি যা একদিকে সংগঠিত জাতপাতবাদী আধিপত্যের সুরক্ষায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, আর অন্যদিকে নারিবাদী, জাতপাত-বিরোধী এবং সমদর্শী নাগরিকত্বের জন্য আন্দোলনকে সন্ত্রাসবাদের সমতুল্য বলে গণ্য করে। আমরা এটা ভীমা কোরেগাঁওয়ে দেখেছি। দিল্লী পুলিশের ‘দাঙ্গা তদন্ত’র ক্ষেত্রেও এটা দেখেছি যাতে পিঁজড়া তোড় সংগঠনের নারীবাদীরা সহ সমদর্শী নাগরিকত্বের জন্য আন্দোলনকারীদের ইউএপিএ-তে অভিযুক্ত করে জেলে পোরা হয়েছে।

এখন আবার হাথরসের পুলিশ ধর্ষণ-বিরোধী এবং জাতপাত-বিরোধী প্রতিবাদীদের ‘আন্তর্জাতিক চক্রান্তের’ অংশ বলে অভিযুক্ত করছে যারা জাতপাতবাদী দাঙ্গাকে উস্কিয়ে তুলতে এবং উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীকে কালিমালিপ্ত করতে ব্যগ্ৰ।

হাথরসের ঘটনাকে ধরে যে আন্দোলন চলছে তা ন্যায় ও পরিবর্তন দাবি করছে – প্রতিশোধ চাইছে না। আর উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর আসনে অধিষ্ঠিত যোগী আদিত্যনাথ যে অন্যায় ও পশ্চাদমুখী মনুবাদকে রাষ্ট্রীয় নীতি হিসাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে। এই কারণেই মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে তাঁকে অপসারিত করাটাই হল ন্যায় ও পরিবর্তনের সম্ভাবনা সৃষ্টির প্রথম শর্ত।

খণ্ড-27
সংখ্যা-36